বাংলাদেশে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা চলছে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হলো—এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং অংশীজনের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে কতগুলো সদিচ্ছার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই বলে মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আদিত্য রিমন।
ভয়েস অফ আমেরিকা: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে ইতিবাচক দুটি দিক কোনগুলো? কেন?
রাশেদ খান মেনন: আপনি তো উল্টো দিক থেকে শুরু করলেন। আমি তো এই বাজেটে ইতিবাচক কিছু দেখি না। শুধু এখানে কতগুলো সদিচ্ছার কথা ব্যক্ত করা আছে। যেগুলো বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল পায়নি। আমার কাছে এই বাজেট খুব আশাজাগানিয়া মনে হয়নি।
ইতিবাচক দিক বলতে এখানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপ থাকার পরও বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হয়েছে। শিল্প খাতে অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে, পরিবেশগত বেশি কিছু বিষয়ও এখানে আছে।
এই বাজেট তো একটা সংকটের প্রেক্ষাপটে এসেছে। সংকট হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, রপ্তানি ব্যয় কমে যাওয়া এবং রেমিট্যান্স কমে যাওয়া। এসব সংকটের দিক থেকে আমি একটা সাহসী বাজেট আশা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের অর্থমন্ত্রী সেই পুরোনো ধারায় হাঁটলেন। এমনকি যারা এই বাজেট নিয়ে প্রশংসা করছেন, তারাও খুব বেশি করতে পারছেন না।
ভয়েস অফ আমেরিকা: সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এবারের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখার; যা মোট বাজেটের ১৪.২৪ শতাংশ। এর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে? এ খাতে খরচ কমিয়ে আনার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন?
রাশেদ খান মেনন: এখানে দুই ধরনের সুদ আছে। একটা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ, আরেকটি হচ্ছে বৈদেশিক। এখন পর্যন্ত যদিও সেটা একটা সীমার মধ্যে আছে। কিন্তু সেটা ইতোমধ্যে ঝুঁকির জায়গায় চলে গেছে। ফলে একদিকে রাজস্ব ঘাটতি, আরেকদিকে এই সুদ—দুটি মিলিয়ে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে আমাদের একটি ঘাটতি বাজেট দিতে হচ্ছে। এই যে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করার সংস্কৃতি, তা যদি একবার শুরু হয়ে যায়, তখন এর থেকে বেরিয়ে আসাটা বেশ কঠিন। সেদিক থেকে উচিত ছিল প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট হওয়া। একইসঙ্গে বাস্তবতাও বোঝা উচিত। রিটার্ন কতখানি আসবে, সেটা বুঝেই প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে তার ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার নিজেই যদি এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়, এর কী ধরনের প্রভাব দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর পড়বে?
রাশেদ খান মেনন: ইতোমধ্যে বিনিয়োগে প্রভাব পড়েছে। কারণ সরকার যে ঋণ নিয়েছে, তাতে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট শুরু হয়ে গেছে। তার মধ্যে এখন আবার সরকার ঋণ নিলে ব্যাংকগুলো বলবে—আমাদের পক্ষে বেসরকারি খাতে আর ঋণ দেওয়া সম্ভব না। এতে বিনিয়োগ আরও কমে যাবে। কর্মসংস্থান হবে না। তার প্রভাব এসে পড়বে প্রবৃদ্ধির ওপর।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
রাশেদ খান মেনন: বৈদেশিক বিনিয়োগ নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছি না আমরা। তার বৈশ্বিক একটা কারণ তো আছেই। কিন্তু বড় কারণ হচ্ছে দেশে ডলার সংকট। কারণ, বিদেশিরা বিনিয়োগ করলে সে তো তার মুনাফা নিয়ে যেতে চাইবে। কিন্তু তারা তো মুনাফা নিয়ে যেতে পারছে না ডলার সংকটের কারণে। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো তার টিকিট বিক্রির টাকাও নিতে পারছে না। বাংলাদেশে এখন অনেক এয়ারলাইন্স টিকিটে বিক্রিও বন্ধ করে রেখেছে। ফলে এ ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ হবে না। অন্যদিকে ব্যাংক থেকে সরকারই যখন সব টাকা নিয়ে যাবে, তখন বেসরকারি বিনিয়োগও হবে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।
ভয়েস অফ আমেরিকা: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করে বলছেন, বৈধ আয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশ, কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটে ১৫ শতাংশ কর দিলেই যেহেতু চলবে, এটি তাই কর ফাঁকিতে উৎসাহিত করা হবে। নৈতিকতার প্রশ্নটি বাদ রেখেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ কতটা ইতিবাচক ফল দেবে বলে আপনি মনে করেন?
রাশেদ খান মেনন: প্রথমত, আজকে যে যুক্তিতে কালো টাকা সাদা করার কথা বলা হয়েছে, সেটি আমি গ্রহণ করি না। আজকে যিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন, তাঁর অতীতের বক্তব্য যদি শোনেন, দেখবেন তিনিই সবচেয়ে বেশি আপত্তি তুলেছিলেন কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে। খালেদা জিয়াকে অনেক সমালোচনা করেছিলেন কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে। সুতরাং আজকে যে যুক্তিতে কালো টাকা সাদা করা কথা বলা হচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য না।
দ্বিতীয়ত, এখানে নৈতিকতা তো নেই। যেখান থেকে খুশি কালো টাকা আনো। তার সঙ্গে এখানে একটা কথা বলা হয়েছে—কোনো সংস্থা এই কালো টাকার ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারবে না। এটা দুর্নীতিকে প্রচণ্ডভাবে উৎসাহিত করবে। তারপর আমরা এভাবে খুব বেশি টাকা সাদা হতে দেখিনি।
তৃতীয়ত, আমি সৎভাবে আয়ের ৩০ শতাংশ কর দেব, আর অসৎভাবে আয়ে ১৫ শতাংশ কর দেব—এটা কোনো মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য না।
ভয়েস অফ আমেরিকা: মূল্যস্ফীতি গত দু’বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপর। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এ জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো ও কৃচ্ছসাধনের ওপর মন্ত্রী জোর দিয়েছেন? এগুলো বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা সরকারের কতটা রয়েছে? মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
রাশেদ খান মেনন: মূল্যস্ফীতি কমাতে গেলে অর্থনৈতিকভাবে যে দিকনির্দেশনা দরকার, তা এই বাজেটে নেই। মূল্যস্ফীতির বড় সম্পর্ক হচ্ছে খাদ্যমূল্যের সঙ্গে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হওয়ার খুব বেশি কারণ নেই। আমরা প্রচুর খাদ্য উৎপাদন করছি। ধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ, মাছে দ্বিতীয়, পোলট্রি শিল্পে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে চলে এসেছি। সেখানে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি এত বেশি কেন হচ্ছে?
সবার ধারণা হলো সিন্ডিকেট প্রথা। সিন্ডিকেট প্রথা না ভাঙা পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে না। বাজার নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকছে না। সিন্ডিকেট কারা করে তা সরকার জানে না, বিষয়টি এমন না। সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এই সিন্ডিকেট তৈরি করে। যেমন ৪-৬ জন ব্যবসায়ী তেল আমদানি করে। এটা ৪০-৫০ জনের হাতে দিয়ে দিলে বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি হতো। তখন দামও কম থাকত। তিন বছর আগে বলেছি, উপজেলায়-উপজেলায় গুদাম করো। সরকার করেনি। ফলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমছে না।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। সেখানে সরকার বলছে কৃষিঋণ, টিসিবি দিয়ে তা পূরণ করবে। কিন্তু এটা দিয়ে কিছুই হবে না। এটা করতে হলে অনেক বেশি টিসিবি ও ন্যায্যমূল্যের দোকান বাড়াতে হবে। এ জন্য আমরা বলেছি, সস্পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থায় যেতে হবে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য সব ক্ষেত্রেই অভিন্ন ভ্যাট হার নির্ধারণ করাটা কতটা কার্যকর হবে? এবারেই কি এটি করা উচিত ছিল? কতদিনের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জনের টার্গেট নেওয়া উচিত?
রাশেদ খান মেনন: ভ্যাট তো মূলত পরোক্ষ কর। এটা ১৫ কোটি টাকার মালিক যিনি, তিনি যে ভ্যাট দেন, আমিও একই ভ্যাট দিই। ভ্যাট দিয়ে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব নয়। প্রায় ৮৭ লাখ লোক কর দেওয়ার যোগ্য হলে মাত্র ২৭ লাখ ট্যাক্স দেয়। এই যে ৫০ লাখের অধিক লোক ট্যাক্স দেয় না, তাদেরকে এর আওতায় আনতে পারলে রাজস্ব বাড়বে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: জনপ্রশাসন খাতে খরচ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা, অথচ আমরা প্রতিবছরই দেখি বাজেট বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। যার জন্য জনপ্রশাসনের অদক্ষতাকে সমালোচকরা একটি প্রধান কারণ বলে মনে করে থাকেন। বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি না করে জনপ্রশাসন খাতে এ বিপুল বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
রাশেদ খান মেনন: জনপ্রশাসনে খরচ হবেই। কারণ এটার পরিচালনা ব্যয় আছে। এটাকে যতখানি কমিয়ে আনা যায় ততই ভালো। কিন্তু আমরা এখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য বিশাল দামে গাড়ি ক্রয় করছি। তাদের জন্য বাড়ি তৈরি করা। সচিবদের জন্য আলাদা-আলাদা ফ্ল্যাট তৈরি করা, এইগুলো কমিয়ে নিয়ে এনে মূলত নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা দরকার। এখানে এখন গ্যাপটা প্রায় এখন ১ : ১০ হয়ে আছে। আমরা এটাকে ১ : ৫ করার কথা বলছি। এটা না করতে পারলে আমাদের পরিচালন ব্যয় বাড়তে থাকবেই। আর সামগ্রিকভাবে আমাদের বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা কম। আমাদের বাজেটের প্রথম ৯ মাসে ৩৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় না। কিন্তু দেখা যায় যে শেষের ৩ মাসে তারা সব ব্যয় করতে থাকে। ফলে অনেক অপচয় হয়।