আসলে মূল্যস্ফীতি (শতকরা) দশের কাছে আছে- ফরাসউদ্দিন

ফরাসউদ্দিন

বাংলাদেশে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা চলমান। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হলো—এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং অংশীজনের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল্লাহ আমান।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে ইতিবাচক দুটি দিক কোনগুলো? কেন?

ফরাসউদ্দিন: প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে এর মধ্যে বাস্তবতার ছোঁয়া আছে। বাজেটটাকে খুব বড় করা হয়নি। জিডিপির প্রবৃদ্ধি একেবারে ৮ থেকে ৯ শতাংশ না বাড়িয়ে এটিকে ৬.৭৫ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। আর বক্তব্যে আছে দেশি শিল্পকে বড় এবং শক্তিশালী করার একটা সদিচ্ছা বাজেটে আছে বলে মনে হয়েছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এবারের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখার; যা মোট বাজেটের ১৪.২৪ শতাংশ। এর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে? এ খাতে খরচ কমিয়ে আনার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন?

ফরাসউদ্দিন: একটা জিনিস বুঝতে হবে। সেটি হচ্ছে একটি ঘাটতি বাজেট অথবা ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বড় হওয়ার কারণ হলো একটা উন্নয়নশীল দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বা বাজেটের ব্যর্থতা অর্থাৎ রাজস্ব আহরণের ব্যর্থতা। খুব জোর গলায় আমাদের করপোরেট খাত বলছে যে, জিডিপি এত বড় হয়েছে, আমাদের মাথাপিছু আয় এত বড় হয়েছে, কিন্তু কর-জিডিপি কেন পৃথিবীতে এত লোয়েস্ট?

আপনারা জানেন, করের এলাকাও কিন্তু চিহ্নিত। যেমন—সিপিডি, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার একটা সেমিনারে তারা বলেছে যে ৮৭ লাখ ধনী ব্যক্তি আছেন দেশে। তার মধ্যে মাত্র ৯ লাখ ব্যক্তি কর দেন। বাকি ৭৮ লাখ মানুষকে কিন্তু বুঝিয়ে শুনিয়ে কর দেওয়াতে পারলে আমাদের ঘাটতি কম হতো, ঋণ কম হতো, শোধ কম দিতে হতো।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, বড় ঋণ হয়ে গেছে। আমাদের বৈদেশিক ঋণের হার বেড়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। ওইটাকে প্রতিবিধান করার জন্য অন্তত দুই-তিনটা মেগা পরিকল্পনাকে ধীর করতে হবে। এবং ওইগুলোর যারা সাপ্লায়ার ক্রেডিট, যারা হোমওয়ার্ক করে, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই প্রকল্পগুলোকে ধীর করা এবং পুনঃতফসিল করা ঋণটাকে। এটা করলে আগামী তিন-চার বছর এই যে কঠিন সময়টা যাচ্ছে, সেটা একটু কমে আসবে এবং আমাদের বাজেটে ঋণের পরিমাণ যাতে কমে আসে, সেই সাথে আমরা যাতে রাজস্ব আদায় করতে পারি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে তার ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার নিজেই যদি এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়, এর কী ধরনের প্রভাব দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর পড়বে?

ফরাসউদ্দিন: এই বাজেটটা যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফের কঠিন তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়েছে, তার প্রমাণ আমি আপনাকে দিচ্ছি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আইএমএফ সেভিংস সার্টিফিকেট একদম পছন্দ করে না। অথচ এই দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য যে স্বাধীন রাষ্ট্র জাতির পিতা তৈরি করেছিলেন, মূল কারণ হলো জনকল্যাণ। সেবা নিশ্চিত করতে হলে কোনো রকমের ধার করার আগে সেভিংস সার্টিফিকেটের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে ধার করতে হবে। এখন তো সেভিংস সার্টিফিকেটের যে লভ্যাংশ, সেটা ব্যাংক ঋণের সুদের থেকেও তো কম।

কাজেই বিদেশ থেকে ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার চাইতে, এবং ২৭ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে ঋণ নেওয়ার চাইতে আমি মনে করব অন্তত ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা প্রত্যক্ষভাবে আমরা সেভিংস সার্টিফিকেট হিসেবে জনসাধারণের কাছে থেকে নেই। এতে শোধও কমবে, দায়টা নিজেদের কাছে থাকবে এবং প্রকৃতপক্ষে একটা সামাজিক সুরক্ষার ভেতরে পড়বে। এখন তো ওই খাতে দুর্নীতি অনেকটা দূর হয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সঞ্চয়পত্র কেনার তেমন সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই যারা সঞ্চয়পত্র কেনেন, তারা এই দেশেরই প্রবীণ লোক। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা অথবা বেসরকারি খাতে নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা। তারা যদি এটা নেন এবং এর লভ্যাংশ পান, তবে অবশ্যই এটাকে করমুক্ত করতে হবে। এবং এর সাথে সাথে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?

ফরাসউদ্দিন: বেসরকারি খাতে দুইটা খারাপ দিক আছে। একটা হলো, ওখানে যে কার্টার করেছে, তারা ব্যাংকগুলোতে এত বেশি প্রফিট করে যে যারা ব্যাংকের বোর্ডে থাকেন, তারাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারী। আর দ্বিতীয় হলো, ওখান থেকে ধার করে যদি সরকার নিয়ে যায়। তখন তারা বলবে যে টাকা তো সরকার ধার নিয়ে যাচ্ছে, আমরা কোথায় পাবো? যদি আমরা সঞ্চয়পত্র থেকে নেই তাহলে ওটা থাকবে না।

এখানে খুব সুন্দর একটা সমীক্ষা আছে, বিবিএস করেছে। এখানে দেখা যায় ১৬-২৪ বছর বয়সী যারা আছে, তাদের ৪১ ভাগ লোক কাজে নাই, শিক্ষায় নাই। এবং তাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তারা একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় আছে। এদের জন্য বিনিয়োগ করাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিনিয়োগ যে আমি করব, সেটার তো পরিবেশ থাকা লাগবে। আবারও বলি, ১৯৯২ সালে উন্নয়ন সহযোগী একটি প্রতিষ্ঠানের অপ্রয়োজনীয় পরামর্শে ব্যাংকিং খাতকে দীর্ঘকালীন ঋণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটা তো ব্যাংকের কাজ না। কাজেই এখানে খেলাপি হবেই। বিনিয়োগ স্কোপ কিন্তু অবশ্যই সীমিত। কিন্তু আমি মনে করি, বাজেটে তাও লিখা আছে যে ইম্পোর্ট কম্পিটিং প্রোডাক্টসের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। এটা হলো বক্তব্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমস্ত উল্টা করা হয়েছে। এই দেশে গুঁড়োদুধ প্রস্তুত করা একেবারে সহজ। ৬ থেকে ৯ মাসে হয়ে যায়। আর দুধ খুব চমৎকার হয়। আমরা ৪-৫ বছর আগে অনুরোধ করে ডিউটিটা একটু বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু ৬ মাসের মধ্যে আবার এই বাজেটে ডিউটি কমানো হয়েছে। বাজেট কমানো মানে এটা আমদানি হবে।

আপনি এসি বলেন, ফ্রিজ বলেন—এই সমস্ত দৃষ্টিনন্দন হৃদয়গ্রাহী পণ্যের দেশীয় উদ্যোক্তারা অগ্রগতি করেছে। সেখানে তাদের যে কম্পোনেন্টগুলো আসবে, সেখানে ডিউটি দিয়ে দিছে। এগুলোর দাম বাড়বে অর্থাৎ নিম্নমধ্যবিত্তের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলোকে কিন্তু এখনও ঠিক করার সুযোগ আছে। কাজেই গুঁড়োদুধের ওপর, আসবাবপত্রের ওপর, ফ্রিজ-এসি এগুলো তৈরির যন্ত্রাংশ এবং ডিউটির ব্যাপারটা আবার এক্সামিন করে দেখা যায় যাতে বেশি বেশি উৎপাদন হয়। কেন আমরা আমদানির ওপরে শুল্ক করতে পারি না। বাংলাদেশের গাড়ির ওপর একটা শুল্ক রাখতে পারে—এটা ভালো হবে।

বাজেটের একটা স্ট্রং পয়েন্ট আমি বলি। বাজেটের সবচেয়ে স্ট্রং পয়েন্ট আমি দেখছি মেট্রো ইকোনমিকস। সাংস্কৃতিক স্থিতিশীলতা আনার একটা চেষ্টা করা হচ্ছে। চেষ্টার অংশ হিসেবে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি মাত্র ৫.৮% হয়েছে। এটা যে ৬.৭৫ শতাংশ হবে না, এটা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও বলেছে। কিন্তু বাজেটের মধ্যে এটির প্রতিফলন হয়েছে। সুতরাং বাজেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটাতে হলে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে অগ্রসর হতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করে বলছেন, বৈধ আয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশ, কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটে ১৫ শতাংশ কর দিলেই যেহেতু চলবে, এটি তাই কর ফাঁকিতে উৎসাহিত করা হবে। নৈতিকতার প্রশ্নটি বাদ রেখেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ কতটা ইতিবাচক ফল দেবে বলে আপনি মনে করেন?

ফরাসউদ্দিন: এই টাকার দুটো ভাগ আছে। একটা হলো অপ্রদর্শিত আয়, যেটা সৃষ্টি হয় সরকারের ভ্রান্ত পলিসির ফলে। আপনি জমি বিক্রি করলেন ১০ কোটি টাকা, রেজিস্ট্রি অফিসে এটা ২ কোটি টাকার বেশি দিয়ে করবে না। কাজেই ৮ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় হয়ে গেল আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এ রকম একটা অংশ আছে। আর বড় অংশটা হলো কালো টাকা। প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে, সম্ভবত ১৯৮৭ সালে এটা প্রথম শুরু হয়। আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন বাংলাদেশের ৮১ শতাংশ কালো টাকা।

সাদরেল রেজা আমিন, উনি বিআইডিজিসির ডিজি ছিলেন, উনি বলছেন ৪১ শতাংশ। যাই হোক, এটা খুব বড় একটা অংশ। এটাকে মূলধারায় আনতে পারলে খুব ভালো হয়। অর্থনীতি বড় হয়। কিন্তু এখানে কথা হলো যে স্ল্যাব উল্লেখ করা আছে, সেই স্ল্যাব অনুযায়ী কর দিতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একটা ঘোষণা থাকবে, কালো টাকা সাদা করলে আর কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করতে পারবে না।

মানি লন্ডারিং, ঋণ খেলাপ, কর ফাঁকি দেওয়া এক সূত্রে গাঁথা। এখানে একদম সিমেন্টের ওয়াল করে দেন, যাতে বের হতে না পারে। এটা সম্ভব, অতীতেও হয়েছে। তাছাড়া আরেকটি ঘোষণা করতে হবে যে ০১-০৭-২৬ তারিখে যাদের কাছে কালো টাকা থাকবে, তাদের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হবে। আদালতে এটা গ্রাহ্য করা হবে না। এই অ্যাকশনগুলো নিলে আশা করছি কালো টাকা মূলধারায় ফিরে আসবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: মূল্যস্ফীতি গত দু’বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপর। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এ জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো ও কৃচ্ছসাধনের ওপর মন্ত্রী জোর দিয়েছেন? এগুলো বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা সরকারের কতটা রয়েছে? মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

ফরাসউদ্দিন: আপনি এমন একজনের সাথে কথা বলছেন, যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ করার সময় মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা দুইয়ের নিচে। সেই আবহাওয়া তো এখন সৃষ্টি করা যাবে না। কিন্তু আমাদের সামনে খুব উজ্জ্বল দুইটা দৃষ্টান্ত আছে। জাতির পিতা ১৯৭২ সালে টিসিবি সৃষ্টি করেন, ম্যাসিভভাবে ইম্পোর্ট করলেন এবং অনেক গিফট পেলাম আমরা, ওগুলোকে সব কনজ্যুমার সাপ্লাইস করপোরেশনের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে অনেক কম মূল্যের মাধ্যমে বিতরণ করলেন। মডিফায়ার রেশনিং করলেন, স্ট্যাট্যুটরি রেশনিং করলেন। স্বাধীনতার পর মূল্যস্ফীতি প্রথম বছর ছিল ৬১ পার্সেন্ট। পরের বছরে ৪২ পার্সেন্টে নামে। আস্তে আস্তে কমতে থাকে খুব। আরেকটা হলো ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ এক প্রলয়ংকরী বন্যা হয়। তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রিত্বের ফার্স্ট টার্ম চলছে। তিনি যেটা করলেন, সরকারিভাবে ১৫ লাখ টনের খাদ্যশস্য মজুত করলেন। পরে অত্যন্ত যোগ্য অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া, তাঁর মাধ্যমে ভিজিডি প্রোগ্রাম করে দেড় কোটি মানুষকে ৯ মাস ধরে বাজারমূল্যের শতকরা ২৫ ভাগ কম দরে বিতরণ করলেন।

কিন্তু এখন কী করা যায়? কালকেও খবরে এসেছে বোরো ফসল চমৎকারভাবে ফলেছে। সরকার মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এই যে খাদ্য বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, তাদের দমন করার জন্য কোনো ঘোষণা নেই। তো এ ক্ষেত্রে কৃষকদের তাদের ফসলগুলো ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করার সুযোগ দিতে হবে। বাজারদরের ২৫ শতাংশ কমে বিক্রি করলে খাদ্যদ্রব্য মজুত করা লোকজন খাদ্যদ্রব্য বাজারে আনতে বাধ্য হবে। এবং মনিটর করতে হবে এদের। গত দেড় বছর মূল্যস্ফীতি বলা হচ্ছে ৯-এর ওপরে। আসলে এটা ১০-এর কাছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবিএস বলছে ১০.০৭, কিন্তু বিডিএস বলছে ১৫-এর কাছাকাছি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: জনপ্রশাসন খাতে খরচ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা। অথচ আমরা প্রতিবছরই দেখি বাজেট বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। যার জন্য জনপ্রশাসনের অদক্ষতাকে সমালোচকরা একটি প্রধান কারণ বলে মনে করে থাকেন। বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি না করে জনপ্রশাসন খাতে এ বিপুল বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

ফরাসউদ্দিন: আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত হওয়ার উপায় নাই, আমি বলি বিষয়টা। প্রকৃত সত্য হলো, গত ছয় বছরে বাজেট বাস্তবায়ন শতকরা সবচেয়ে কম হলো ৮১ ভাগ এবং সবচেয়ে বেশি হলে ৮৫ ভাগ। কিন্তু এটা সংশোধিত বাজেটে, সম্পূর্ণ বাজেটে নয়। প্রথম দশ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ৪৯ ভাগ, মে-জুন মাসে আরও হয়তো ৪০ ভাগ বাস্তবায়ন হয়ে যাবে। এখানে প্রথম কাজ হলো অর্থবছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি করা। বিশ্বাস করুন, মে-জুনে যে দুর্নীতিটা হয়, এই যে প্রকল্পগুলো পানির তোড়ে চলে যায়, নদীভাঙনে প্রকল্প চলে যায়, এই যে সিংহভাগ পুকুরচুরি হয়, এটার জন্যই আমরা লজ্জা পাই। এবং ১লা জুলাই বা ৩০ জুন অর্থবছর করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। জানুয়ারি দিয়ে অর্থবছর শুরু করতে পারেন। তখন শিক্ষাবছর, নবান্ন, নতুন ফসল ঘরে আসে। এখন সময় আসছে, প্রকল্প পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন করার।

ভয়েস অফ আমেরিকা: করের আওতা না বাড়িয়ে যারা কর দেয়, তাদের ওপরই করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে এবারের বাজেটে, বলে সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

ফরাসউদ্দিন: যখন সরকারের আমলা নির্ভরতা বেড়ে যায়, তখনই এমন হয়। অলরেডি সমীক্ষা আছে যে ২৭ লাখ লোকের কর দেওয়া উচিত। সমীক্ষা আরও বলছে সোয়া কোটি মানুষের কাছে ৫ হাজার মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় আছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি খুব বেশি হারে বাড়ছে। এবং ২০৩০ সালে আমরা ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতি হয়ে যাবো। কাজেই দুর্নীতি দমন ছাড়া প্রশাসনিক খরচ কমবে না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য সব ক্ষেত্রেই অভিন্ন ভ্যাট হার নির্ধারণ করাটা কতটা কার্যকর হবে? এবারেই কি এটি করা উচিত ছিল? কতদিনের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জনের টার্গেট নেওয়া উচিত?

ফরাসউদ্দিন: ১৯৯১ সালে যখন ভ্যাট মূল্য সংযোজন করটা এখানে সংযুক্ত করা হয়। যখন কষ্টেসৃষ্টে মূল্য সংযোজন ভ্যাট ১৫% করা হলো, তখনই ৫৫% এডিপি ভাগ সংরক্ষণ হয়ে গেল। শুধু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো ছাড়া, যাদের মূসক ২০-২৫ পার্সেন্ট হয়, বাকি সবার ক্ষেত্রে একেবারে ১৫ ভাগ মূসক ধার্য করা উচিত। আদায়কৃত অর্থের শতভাগ সরকারি কোষাগারে যাতে মজুত হয়, সেই বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে।