বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বৃষ্টিপাত কমে আসায় এবং উজানের ঢল হ্রাস পাওয়ায়, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হয়েছে। একই সঙ্গে জেলাগুলোর নদ-নদীর পানিও কমেছে। তবে, লালমনিরহাটে তিস্তা অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ভোগান্তি কমেনি তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের মানুষের। এদিকে, উজানের ঢলে এক সপ্তাহ ধরে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট
গত দুই দিন আবহাওয়া রৌদ্রকরোজ্জ্বল থাকায়, বন্যার পানি কমেছে সিলেটের উপজেলাগুলোতে। সিলেট শহরে সুরমা নদীর পানি কমে বর্তমানে বিপদ সীমার তিন সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ঘর-বাড়ি থেকে নামতে শুরু করেছে পানি। কিছু এলাকায় পানি কমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে অনেক পরিবার বাড়িতে চলে গেছেন। তবে, সিলেট শহর এলাকার ড্রেন, ছড়া, খাল পরিষ্কার না থাকায় এবং এক ড্রেনের সঙ্গে অন্য ড্রেনের সংযোগ না থাকায় পানি নামছে না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছে, ড্রেনের ময়লা উঠে এসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বাসাবাড়িতেও জমে আছে ময়লা পানি।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানান, শুক্রবার (২১ জুন) সকাল ৬টা থেকে শনিবার (২২ জুন) সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময়ের পর আর কোনো বৃষ্টি হয়নি।
তবে, আগামী ৩ দিন সিলেট অঞ্চলের উপর দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫-৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।
শনিবার (২২ জুন) সকালে সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে কমে বিপদ সীমার নিচে নেমে এসেছে। তবে সুরমা ও কুশিয়ারার পানি অন্যান্য পয়েন্টে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে শনিবার সকাল ৯টায় বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। সিলেট পয়েন্টে শনিবার সকাল ৯টায় ১০ দশমিক ৭৪ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হয় সুরমা নদীর পানি।
শনিবার সকাল ৯টায় কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপদ সীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। শুক্রবার এই পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হচ্ছিলো বিপদ সীমার ৩৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে।
কুশিয়ারা নদীর প্রবাহ ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে অপরিবর্তিত রয়েছে। শুক্রবার এই পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হচ্ছিলো ১০ দশমিক ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শনিবার সকাল ৯টায়ও একই মাত্রায় প্রবাহিত হয়।
কুশিয়ারা নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে শুক্রবারের তুলনায় আরো কমেছে। শনিবার সকাল ৯টায় এই পয়েন্টে বিপদ সীমার ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো কুশিয়ারা। এর আগে শুক্রবার এই পয়েন্টে পানি প্রবাহ ছিলো বিপসীমার ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে।
এদিকে, শনিবার লোভা, সারি, ডাউকি, সারিগোয়াইন ও ধলাই নদীর পানি আরো কমেছে। তবে, বন্যা পরিস্থিতিতে পানিবন্দী মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছেন। বন্যাদুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রশাসন জানায়, শুক্রবার সকাল থেকে সূর্য ওঠায়, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সরকারি বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের সুরমা, খাসিয়ামারা ও চিলাই নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। পানি কমতে শুরু করায়, অনেকেই ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। তবে কিছু কিছু স্থানে এখনো পানি রয়েছে।
পানি নেমে যাওয়ায় সুনামগঞ্জের সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিভিন্ন এলাকায় খাবারের সংকট রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা দেয়া হলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
বাজিতপুর এলাকার মো. কামাল উদ্দিন বলেন, পানিতে দুই বার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথমবার ক্ষতির পরিমাণ কম হলেও দ্বিতীয়বার সব শেষ হয়ে গেছে। গ্রামের অনেকেরই এখন ঘরে থাকাই বিপজ্জনক হয়ে গেছে।
শ্মশানঘাট এলাকার উৎস রেস্টুরেন্টের মালিক বিশ্বনাথ রায় বলেন, নদীর পানি শুক্রবার থেকে নামতে শুরু করেছে। এতে এ এলাকার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে।
এদিকে, অনেরক ইউনিয়নে জলাবদ্ধতা কাটছে না। শ্রীপুর, পলিরচর, আফছন নগর, ডালার পার ও হাওড় পাড়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নেহার নিগার তনু বলেন, পানি কমতে শুরু করেছে। তবে, দুর্গত মানুষের ত্রাণ সহায়তা পেতে কোনো সমস্যা হবে না। পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা রয়েছে।
হবিগঞ্জ
হবিগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি তিনটি পয়েন্টে; শেরপুর, মার্কুলী ও আজমিরীগঞ্জে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যায় এ পর্যন্ত ৭৮৩ হেক্টর আউশ ও ১৭৫ হেক্টর শাকসবজির ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নোমান হোসেন বলেন, বন্যার পানি কিছুটা কমছে। বন্যায় এ উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া এলজিআরডি'র ৫৭ কিলোমিটার পাকা সড়কের ক্ষতি হয়েছে বলে জানান নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান।
এদিকে, জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যার্তদের জন্য ২ হাজার ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে। এছাড়া, ৫১০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট
লালমনিরহাটে তিস্তা অববাহিকার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও, ভোগান্তি কমেনি তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের মানুষের।
তিস্তা নদী ব্যারাজ এলাকায়, শনিবার সকাল ৬টায় বিপদ সীমার ৫১ সেন্টিমিটার এবং সকাল ৯টায় আরো কমে ৫৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো।
গত বুধবার সকালে তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়ে তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে স্বল্প সময়ের জন্য বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে, শুক্রবার সকাল থেকে পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। তবে, এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
সদর উপজেলার গোকুন্ডা, কালমাটি, আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন, চর এলাকা ও নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের অনেক বাড়ি-ঘরে এখনো পানি রয়েছে। পানিতে ডুবে আছে আমন ধানের বীজতলাসহ অনেক ফসলি জমি।
এদিকে, নদীর চর ও নিম্নাঞ্চলে পানিতে তলিয়ে যাওয়া রাস্তা জেগে উঠেছে, তবে, জমে আছে কাদামাটি। ফলে এখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। উঁচু বাড়িঘর থেকে পানি নেমে গেলেও, ঘরের বাইরে জমে আছে কাদামাটি।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের নদীসমূহের পানি সমতলে হ্রাস পেতে পারে। তবে, ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর বাবার পানি বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানান তিনি।
যমুনার পানি বৃদ্ধি
এদিকে, উজানের ঢলে এক সপ্তাহ ধরে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
জেলার অন্যান্য নদ-নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবাহ যমুনায় মিশে যাওয়ার ফলে, গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১২ সেন্টিমিটার।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন বলেন, জেলার শাহজাদপুর, কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন ফসল পানিতে ডুবে গেছে এবং কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে।
নাজমুল হোসেন আরো জানান, আগামী ৪/৫ দিন যমুনার পানি বাড়তে পারে এবং বিপদ সীমা অতিক্রম করতে পারে। এবার সিরাজগঞ্জে মাঝারি বন্যার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, ভাঙন রোধে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ।তবে, প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন বলেন, ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
বৃষ্টির পূর্বাভাস
আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া দফতর।
শনিবার (২২ জুন) নিয়মিত বুলেটিনে আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে; রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
সেই সঙ্গে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। আরো বলেছে, সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
সিনপটিক অবস্থা সম্পর্কে আবহাওয়া দফতর বলেছে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র মাঝারি অবস্থায় রয়েছে।
আবহাওয়া অফিস বলেছে, শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় রাজশাহীতে। আর, শনিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় বান্দরবানে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ৫৪ মিলিলিটার রেকর্ড করা হয় নেত্রকোণায়।