বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের প্রধান জলধারা তিস্তা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার নিচু অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এই অঞ্চলের নদ-নদী ভাঙন প্রবন হওয়ায়, পানি কমলে তীর ভাঙছে। ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে মানুষের।
কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
কুড়িগ্রামে তিস্তা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা সহ জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে প্রতিদিন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
শুক্রবার (২১ জন) তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি প্রবাহিত হয় বিপদ সীমার পর দিয়ে। তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদ সীমার ৫৫ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি ফুলবাড়ির শিমুলবাড়ি পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাফসান জানি জানান, শুক্রবার বিকাল ৩টায় দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপদ সীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে, তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদ সীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর, ধরলা নদীর পানি ফুলবাড়ি উপজেলার শিমুলবাড়ি পয়েন্টে বিপদ সীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে অন্য নদ-নদীর পানিও বিপদ সীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, পানি বাড়ার কারণে তিস্তা ও ধরলা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার জলবন্দী হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। তলিয়ে গেছে কাঁচা সড়ক। ডুবে গেছে বাদাম, পাট, ভুট্টা, মরিচ ও শাক সবজি ক্ষেত-সহ বিভিন্ন উঠতি ফসলের জমি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, কুড়িগ্রামে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা অন্তত ৪ হাজার। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ কে এম তাহমিদুল ইসলাম উলিপুরের বেগমগঞ্জসহ বিভিন্ন ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন।তিনি বলেন, একদিকে বন্যা, অন্যদিকে নদী ভাঙন মানুষের সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট বড় ১৬টি নদ-নদী। এগুলোর সবই ভাঙনপ্রবণ। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার সবচেয়ে বেশি ভাঙনপ্রবণ।
লালমনিরহাটে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
লালমনিরহাটে কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টি আর উজানের ঢলে তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে তিস্তা তীরবর্তী অঞ্চলের লোকজন। উজানের পানির চাপ সামলাতে ডালিয়া ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, উজানে পানি কমলেও ভাটিতে পানি প্রবাহ বেড়েছে। শুক্রবার বিকাল ৩টায় কাউনিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ২৯.৩০ মিটার; যা বিপদ সীমার ৫৫ সেন্টিমিটার বেশি।
দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে বিপদ সীমার ৪৭ সেন্টিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। তবে, পানির প্রবাহ আগামী ৭২ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আর, রংপুর জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
তিস্তায় আকস্মিক পানি বৃদ্ধির ফলে লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ও আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা এলাকার নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকেছে। তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চলগুলোর ঘরবাড়ি ও ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়ায় গবাদি পশু নিয়ে দুর্ভোগে রয়েছেন বাসিন্দারা।
লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী, দোয়ানী, নিজ শেখ সুন্দর, বাঘের চর, ডাউয়াবাড়ী এবং পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়নের তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে নদীভাঙন রয়েছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার জানান, আগামী ৭২ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের নদীসমূহের পানি বাড়তে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
নীলফামারীতে পানি কমেছে
এদিকে, নীলফামারীর উজান ও ভাটিতে গত দুই দিন পানি বাড়লেও শুক্রবার পানি কিছুটা কমেছে। ডিমলা উপজেলার তিস্তাপাড়ের পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খাঁন বলেন, “গত দুই দিন ধরে তিস্তা নদীর পানি কিছুটা বাড়লেও শুক্রবার কিছুটা কমেছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, ব্যারাজ পয়েণ্টে শুক্রবার সকাল ৬টায় তিস্তা নদীর পানি ৩৩, সকাল ৯টায় ৩৭, বেলা ১২টায় ৪৫ এবং বিকাল ৩টায় ৪৭ সেণ্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেখানে বিপদ সীমা ৫২ দশমিক ১৫ মিটার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদ্দৌলা জানান, তিস্তা নদীর পানি গত দুই দিনের তুলনায় কমেছে। শুক্রবার বেলা ৩টায় বিপদ সীমার ৪৭ সেণ্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যারাজের সবকটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সিরাজগঞ্জে নদী ভাঙন
সিরাজগঞ্জ জেলায় যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যেই যমুনার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় ভাঙন শুরু হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীতে ২৯ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে; তবে বিপদ সীমার ৮৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। যমুনা নদীর তীরবর্তী শাহজাদপুর, চৌহালী, কাজিপুর, বেলকুচি ও সিরাজগঞ্জ সদর উপর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে এবং আরও নতুন নতুন অঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। এতে যমুনার অভ্যন্তরীণ এলাকায় তিল, কাউন ও পাটসহ বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে।
শাহজাদপুর কাজিপুর, চৌহালী ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, ইতোমধ্যে গাছপালাসহ দেড় শতাধিক ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। শাহজাদপুরের চরাঞ্চলে কৈজুরী, খুকনী ও জালালপুরে ভাঙনের প্রভাব বেশি বলে জানান নাজমুল হোসেন
উজানের ঢলের প্রভাবে এই জেলায় পানি বৃদ্ধি আরো এক সপ্তাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।