নিজ ভাষায় শিক্ষা নিচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রায় তিন লাখ শিশু

নিজ ভাষায় শিক্ষা নিচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশুরা। ফাইল ছবি।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য ২০২২ সালে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম আওতায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। গত ২ বছরে এই ক্যাম্পগুলো নিজ দেশের ভাষায় প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা শিশু এই পাঠ্যক্রমের আওতায় এসেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ৬ হাজার শিক্ষাকেন্দ্রে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করছে শিশুরা।

আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষরা বলছেন, মিয়ানমার সরকার তাদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে, এখানে বাংলাদেশ সরকার তাদের শিশুদের নিজ দেশের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। তারা বিশ্বাস করেন, নাগরিকত্ব ফিরে পেলে সেখানে গিয়ে শিশুরা গৃহীত শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে বাস্তবজীবনে কাজে লাগাতে পারবে।

কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২ পূর্ব-এর মাঝি (নেতা) রফিক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “মিয়ানমার সরকার আমাদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে। এখানে বাংলাদেশে সরকার আমাদেরকে সেই সুযোগ দিয়েছে, আমরা অনেক খুশি।”

তিনি আরও বলেন, “কিন্তু এই শিক্ষা তো এখানে (বাংলাদেশে) বাস্তবে কাজে লাগাতে পারবে না। কারণ আমাদের ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। এখানে তো আমরা চাকরি করতে পারবো না। তাই, মিয়ানমারে ফিরে গেলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা চাকরি করতে গেলে এই শিক্ষার কাজে লাগাতে পারবে।”

রফিক জানান, তার ক্যাম্পে ৮৮ টি স্কুলে ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। সেখানে প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে বার্মা ও ইংরেজি ভাষার শিক্ষক রয়েছে।

রোহিঙ্গা শিশু এনায়েত রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, তার নিজেদের ভাষায় পড়তে অনেক ভালো লাগে, "লেখা-পড়া করতে পেরে আমি অনেক খুশি। বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই।"

৬ষ্ঠ শ্রেণির এই ছাত্র আরও বলেন, “সকালে মক্তবে কোরআন-হাদিস পড়ি। এরপর ক্যাম্পের স্কুলে পড়তে যাই। সেখানে ৩ ঘন্টার মতো পড়ি। বার্মা ভাষায় ও ইংরেজি ভাষায় স্কুলে পড়ানো হয়।”

২০২২ সাল থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য মিয়ানমার কারিকুলাম পাইলট প্রকল্প (এমসিপিপি) বাস্তবায়ন শুরু করে বাংলাদেশে ও জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গ্রেড ৬ থেকে ৯-এর শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।

ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেনের, ব্র্যাক বাংলাদেশেসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

রোহিঙ্গা রিফিউজি রেসপন্স কোঅর্ডিনেশন হাবের ‘২০২৩ যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা রোহিঙ্গা মানবিক সংকট’ তথ্য মতে- ২০২২ সালে রোহিঙ্গা শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য মিয়ানমারের কারিকুলাম চালু হওয়ার পর থেকে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৭০ জন শিক্ষার্থী এমসিতে স্থানান্তরিত হয়েছে।

তাদের মধ্যে ৪৬ হাজার ৫৬৯জন একসিলেরেটেড লার্নিং প্রোগ্রামে মিয়ানমার কারিকুলাম অনুসরণ করেছে।

নিজ ভাষায় শিক্ষা নিচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশুরা। ফাইল ছবি।

ক্যাম্প-১৩ রোহিঙ্গা ইউথ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক খিন মং ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “২০২২ সালে ক্যাম্পের স্কুলগুলোতে মিয়ানমারের ভাষায় এবং ইংরেজি ভাষায় শিশুদের পড়ানো হয়। প্রায় ৬ হাজার শিক্ষাকেন্দ্রে বর্তমানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পড়া-লেখা করছে। এটা ৩ লাখের কাছাকাছি হবে।”

তিনি আরও জানান, শিক্ষদের মধ্যে মিয়ানমারের ও বাংলাদেশের শিক্ষক রয়েছে। মিয়ানমারের শিক্ষকরা মিয়ানমারের ভাষায় পড়ান। আর বাংলাদেশের শিক্ষকরা ইংরেজি পড়ান।

তবে, তিনি অভিযোগ করেন অনেক শিক্ষক দক্ষ নন, "এখানে শিক্ষদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং না থাকায় অনেক শিক্ষক কার্যকরী পাঠদান দিতে পারছে না। কারণ শিক্ষকরা নিজেরাই অনেক বিষয় ঠিক মতো বোঝেন না।”

“বাংলাদেশে আশ্রয় থাকাকালে রোহিঙ্গা শিশুদের মিয়ানমার কারিকুলাম পাইলট প্রকল্প (এমসিপিপি) শিক্ষা কাজে না লাগলেও ভবিষ্যতে নিজ দেশে ফিরে গেলে তারা কর্মক্ষেত্রে অনেক ভালো করতে পারবে”- বলেও যোগ করেন খিন মং।

ব্র্যাকের মানবিক সংকট ব্যবস্হাপনা কর্মসূচির (এইচসিএমপি) পক্ষ থেকে ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানানো হয় যে, ব্র্যাকের ‍উদ্যোগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ও ভাসানচরে মোট ১,২০৫টি লার্নিং ফ্যাসিলিটিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৪,৫০০ জনের বেশি শিক্ষক মিয়ানমারের কারিকুলামের ওপর বিষয়ভিত্তিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

প্রায় ২,৪০০ প্যারা-প্রফেশনালের মাধ্যমে (যারা মূল শিক্ষকদের সহায়তা করে থাকেন) শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা ও হোস্ট কমিউনিটির ৬২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী শিক্ষা সহায়তা গ্রহণ করছে, যার ৫০ শতাংশই মেয়ে শিক্ষার্থী।

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করতে অন্তত ৬০০ জন কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবী মাঠে কাজ করছেন বলে উল্লেখ করা হয় ব্র্যকের পক্ষ থেকে।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, ৯টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও ভাসানচরে ৩৫০ জন শিক্ষকের মাধ্যমে ৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও কক্সবাজারের ৫টি উপজেলার ২০০ প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ থেকে ৬ বছর বয়সী হোস্ট কমিউনিটির বাচ্চাদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে।

এই শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে রোহিঙ্গা নেতা আমিন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “শিক্ষা একটি জাতির মেরুদন্ড। ক্যাম্পগুলোতে শিক্ষার প্রসার ঘটার পর বাল্যবিবাহ কমেছে। শিশু এবং অভিভাবকরা সচেতন হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন,“ আমরা চাই আমাদের শিশুরা নিজ দেশে ফিরে গিয়ে নিজের পরিচয়ে বাঁচুক। আমাদের মতো শিশুরা যেন কারও আশ্রয়ে থেকে মানবেতর জীবনযাপন না করুক। এইজন্য বিশ্ববাসীকে সহযোগিতা করতে হবে, যেন আমরা নাগরিকত্ব নিয়ে নিজ দেশে ফিরতে পারি।”

সর্বশেষ ৩১ মে বাংলাদেশে সরকার ও জাতিসংঘের পপুলেশন ফ্যাক্টশীট অনুযায়ী- বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা ৯ লাখ ৮১ হাজার ৬৪ জন। তারমধ্যে পরুষ ৪৯ শতাংশ, নারী ৫১ শতাংশ। তারমধ্যে শিশু ৫২ শতাংশ।