টি২০ বিশ্বকাপঃ সুপার ৮ এর উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়

জয়ের আনন্দঃ দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাদা (ডানে) আর আনরিখ নরটিয়া। ফটোঃ ১৯ জুন, ২০২৪।

আইসিসি পুরুষদের টি২০ বিশ্ব কাপের সুপার ৮ রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে বুধবার (১৯ জুন) দক্ষিণ আফ্রিকা যৌথ স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রকে ১৮ রানে পরাজিত করেছে। দুই দেশের মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রোটিয়াস দল শুরু থেকেই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং কোন পর্যায়ে আমেরিকানদের নতুন কোন অঘটন ঘটানোর সুযোগ দেয় নি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইনিংসের ষষ্ঠ উইকেটে অ্যান্ড্রিস হাউস এবং হারমিত সিং প্রোটিয়াসদের বোলিং ছিন্ন-ভিন্ন করে ৯১ রানের জুটি গড়ে তুলে তাদের সমর্থকদের অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন দেখান। স্বপ্ন ভঙ্গ করেন দক্ষিণ আফ্রিকার পেস বোলার কাগিসো রাবাদা যিনি মাত্র ১৮ রানের বিনিময়ে ৩টি উইকেট দখল করেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমে ব্যাট করতে নেমে চার উইকেটে ১৯৪ রানের বিশাল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র শেষ নয় ওভারে ১০০ রান হাঁকিয়ে খেলায় প্রচণ্ড উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও, তাদের ইনিংস ছয় উইকেটে ১৭৬ রান করে শেষ হয়।

যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলতে এসে প্রথম রাউন্ডে পাকিস্তানকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা অল্প ব্যবধানে সুপার ৮ পর্বের জন্য কোয়ালিফাই করে। কিন্তু অ্যান্টিগার স্যার ভিভিয়ান রিচারডস স্টেডিয়ামে দুই দলের অভিজ্ঞতা এবং কোয়ালিটির ব্যবধান খেলা জুড়ে দৃশ্যমান ছিল।

প্রথমে ব্যাট করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের নির্ধারিত ২০ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ১৯৪ রান সংগ্রহ করে। এই বিশাল স্কোরের ভিত্ত ছিল কোয়েন্টিন ডি কক (৭৪) এবং এইডেন মারক্রাম (৪৬)-এর মধ্যে দ্বিতীয় উইকেটে ১১০ রানের জুটি।

যুক্তরাষ্ট্রের বোলারদের মধ্যে সৌরভ নেত্রাভালকর (২-২১) এবং হারমিত সিং (২-২৪) দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটারদের কিছুটা দমিয়ে রাখতে সক্ষম হন।

কোয়েন্টিন ডি ককঃ দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ ৭৪ রানের পথে, অ্যান্টিগার স্যার ভিভিয়ান রিচারডস স্টেডিয়ামে। ফটোঃ ১৯ জুন, ২০২৪।

রানের মাঝে কোয়েন্টিন ডি কক

টসে জিতে যুক্তরাষ্ট্র বল করার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং অ্যারণ জোন্সের সিদ্ধান্তর যথার্থতা প্রমাণ করেন বাঁ-হাতি পেস বোলার সৌরভ নেত্রাভালকর। তার দ্বিতীয় ওভারে রিযা হেন্ড্রিক্স বাউন্ডারির দিকে হাঁকানোর চেষ্টা করলে কোরি অ্যান্ডারসন ক্যাচ লুফে নেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্বোধনী জুটি, কোয়েন্টিন ডি কক এবং রিযা হেন্ড্রিক্স এই বিশ্ব কাপে এ’পর্যন্ত খুব একটা সুবিধা করতে পারে নাই। বিশেষ করে ডি ককের কাছ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা রানের আশা করছে।

ইনিংসের চতুর্থ ওভারে মিডিয়াম পেসার জাসদীপ সিং বল করতে আসলে ডি কক তিনটি ছয় এবং নতুন ব্যাটার এইডেন মারক্রাম একটি চার হাঁকিয়ে এক ওভারে ২৮ রান তুলে নেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা পাঁচ ওভার শেষ হবার আগেই ৫০ রান অতিক্রম করে।

সপ্তম ওভারে বাঁ-হাতি স্পিনার হারমিত সিং হাত ঘোরানো শুরু করলে রানের গতি কিছুটা কমে। কিন্তু এর মধ্যে ডি কক হাফ সেঞ্চুরি সম্পন্ন করেন। তার ৫০ রান আসে মাত্র ২৬ বলে।

ম্যাচের ১২তম ওভারে – কোরি অ্যান্ডারসনের প্রথম ওভার – দক্ষিণ আফ্রিকা ১৭ রান তুলে নেয়, যার মধ্যে ছিল ডি ককের একটি ছয় এবং দুটি চার। দলের রান সংখ্যা দাঁড়ায় এক উইকেট হারিয়া ১২৫ – যেটা এই টুর্নামেন্টে তখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ স্কোর।

তবে ডি ককের সেঞ্চুরির আশা পূর্ণ হয় নি এবং তিনি আউট হন ব্যক্তিগত ৭৪ রানের মাথায়। হারমিত সিং-এর শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলে ডি কক একটি ফুলটস মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে বাউন্ডারিতে শয়ন জাহাঙ্গীর ক্যাচ লুফে নেন। পরের বলেই নতুন ব্যাটার ডেভিড মিলার সিং-এর হাতে ক্যাচ তুলে দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক অ্যারন জোন্স (ডানে) দলের সেরা বোলার সৌরভ নেত্রাভালকরকে পরামর্শ দিচ্ছেন। ফটোঃ ১৯ জুন, ২০২৪।

দক্ষিণ আফ্রিকা ডি ককের কাছ থেকে বড় একটি স্কোর প্রত্যাশা করছিল, কারণ তিনি টি২০ ক্রিকেটে ব্যক্তিগত ২,৩৮৯ রান নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শীর্ষ রান সংগ্রহকারী। কিন্তু এই বিশ্বকাপের প্রথম চার ইনিংসে ব্যাট করে মাত্র ৪৮ রান তোলেন।

নেত্রাভালকর ১৫তম ওভারে তার দ্বিতীয় স্পেলের জন্য বল করতে এসে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক মারক্রামের মূল্যবান উইকেটের পতন ঘটান। ব্যক্তিগত অর্ধশতকের মাত্র চার রান বাকি থাকতে মাক্রাম নেত্রাভালকরের বল ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে কাট করার চেষ্টা করলে আলী খান সামনের দিকে ডাইভ দিয়ে কঠিন এক ক্যাচ লুফে নেন।

হাইনরিখ ক্লাসেন (৩৬) এবং ট্রিস্টান স্টাবস (২০) অপরাজিত থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস প্রায় ২০০’র কাছে নিয়ে যান।

অ্যান্ড্রিস হাউসের খেলা

ব্যাট করতে নেমে যুক্তরাষ্ট্র শুরুতেই দ্রুত রান সংগ্রহের দিকে মনোযোগ দেয়। এইডেন মারক্রামের অফ-স্পিনের সুযোগ নিয়ে স্টিভেন টেইলর কয়েকটি বড় বাউন্ডারি হাঁকিয়ে রান রেট দশের ঘরে নিয়ে যান।

কিন্তু চতুর্থ ওভারে ৩৩ রানের মাথায় প্রথম উইকেটের পতন হয়। পেস বোলার কাগিসো রাবাদার বলে টেইলর মিড-অফে ক্লাসেনের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে ১৪ বলে ২৪ রান তুলে বিদায় নেন।

টেইলরের প্রস্থান আমেরিকানদের দমিয়ে দেয় নি। মারকো ইয়েন্সেনের তৃতীয় ওভারে হাউস এবং নিতিশ কুমার ১৭ রান তুলে নেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই পাল্টা আক্রমণ শুরুতেই কাটছাঁট করে দেন রাবাদা। তার দ্বিতীয় ওভারে নিতিশ কুমার লেগসাইড স্কয়ারের দিকে বাউন্ডারির সন্ধানে বল আকাশে তুলে দিলে ট্রিস্টান স্টাবস ক্যাচ লুফে নেন।

অসাধারণ জুটিঃ যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্ড্রিস হাউস (বাঁয়ে) এবং হারমিত সিং তাদের ৯১ রানের পার্টনারশিপের সময় রান নিচ্ছেন। ফটোঃ ১৯ জুন, ২০২৪।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সব চেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে আসে সপ্তম ওভারে, যখন অধিনায়ক অ্যারন জোন্স মাত্র পাঁচ বল খেলে কোন রান না করেই বাঁ-হাতি স্পিনার কেশাভ মাহারাজের বলে আউট হন।

প্রাক্তন নিউ জিল্যান্ড আন্তর্জাতিক প্লেয়ার কোরি অ্যান্ডারসন রান রেট বাড়ানোর চেষ্টায় আনরিখ নরটিয়ার দ্বিতীয় ওভারের দ্বিতীয় বল বাউন্ডারির ওপারে পাঠালে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থকদের মাঝে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয়। কিন্তু নরটিয়া পরের বলেই অ্যান্ডারসনের লেগ স্টাম্প ফেলে দেন।

ইনিংসের ঠিক মাঝখানে, ১০ ওভারের পর যুক্তরাষ্ট্র স্কোর দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ৭৩ রান। অর্থাৎ ১৯৫ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নাগালের বাইরে চলে যেতে শুরু করে।

কঠিন কাজ দুরূহ হয়ে পরে যখন তাব্রেইজ শামসি তার প্রথম ওভারে শয়ন জাহাঙ্গীরকে এলবিডব্লিউ ফাঁদে ফেলেন।

তবে ১৫তম ওভারে অ্যান্ড্রিস হাউস হঠাৎ জ্বলে উঠে নরটিয়ার ওভারে ১৯ রান হাঁকিয়ে ব্যক্তিগত হাফ সেঞ্চুরি সম্পন্ন করেন। ক্রিজের অপর প্রান্তে হারমিত সিং স্লগ হিটিং-এ যোগ দেন, শামসির বোলিং ছিন্ন-ভিন্ন করেন।

খেলার ১৮তম ওভারে – শামসির শেষ ওভার – হাউস এবং সিং ২২ রান হাঁকিয়ে অসম্ভব জয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেন। কিন্তু ১৯তম ওভারে রাবাদার নতুন ওভারের প্রথম বলে হারমিত সিং বাউন্ডারিতে স্টাবসের হাতে ধরা পড়েন। ষষ্ঠ উইকেটে হাউস এবং সিং ৯১ রান যোগ করেন।

রাবাদা তার শেষ ওভারে মাত্র দুটি রান দেন এবং একটি উইকেট সংগ্রহ করেন।

রোমান্টিক আমেরিকান গল্প

যুক্তরাষ্ট্রর সুপার ৮-এ পৌঁছানোর ঘটনা নিঃসন্দেহে এই বিশ্বকাপের একটি রোমান্টিক গল্প, কারণ ক্রীড়া জগতের এই পরাশক্তি এই প্রথম বার ক্রিকেটের কোন বিশ্বকাপে খেলতে নেমেছে।

প্রথম রাউন্ডে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক উদ্বোধনী ম্যাচে কানাডাকে হারিয়ে স্বাগতিক হিসেবে তাদের উপস্থিতির ঘোষণা দেয়। কিন্তু পরের ম্যাচে আমেরিকানরা প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে হারিয়ে সবাইকে হতবাক করে দেয়। ভারতের কাছে অল্পের জন্য পরাজিত হলেও, আয়ারল্যান্ডের সাথে ম্যাচ আবহাওয়ার কারণে পরিত্যাক্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রর দ্বিতীয় পর্বে অগ্রসর হওয়া নিশ্চিত হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকা ১০০ ভাগ জয়ের রেকর্ড নিয়ে গ্রুপ ডি-তে শীর্ষ স্থান নিশ্চিত করে। তবে তারা বাংলাদেশ এবং নেপালের বিরুদ্ধে বলতে গেলে কানের কাছ দিয়ে পার পেয়ে যায়। নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধেও তারা এক পর্যায়ে মাত্র ১২ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছিল, কিন্তু অবশেষে ১০৪ রানের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।