উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন যখন গত সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়ার পূর্বাঞ্চল সফর করেন তখন তার ঐ মিশনের একটা বড় অংশ স্পষ্ট ছিলঃ যত বেশি সম্ভব রাশিয়ার অন্ত্র পরিদর্শন করা।
বহুল ঘোষিত বেশ কয়েক দিনের ঐ সফরে কিম রাশিয়ার অন্যতম অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের ককপিটে উঠেন। তিনি পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম কৌশলগত বোমারু বিমান খুঁটিয়ে দেখেন এবং রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের একটি যুদ্ধজাহাজও ঘুরে দেখেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিমকে নিয়ে দেশের সবচেয়ে আধুনিক মহাকাশ রকেট উৎক্ষেপণ সাইট ভস্তোচনি কসমোড্রোম ঘুরে দেখান। সেখানে তিনি স্বীকার করেন যে রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরিতে সহায়তা করবে।
যদিও মস্কো এবং পিয়ংইয়াং তাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছে, ঐ বৈঠকে কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তির কথা ঘোষণা করা হয়নি যা কিছু পর্যবেক্ষককে বিস্মিত করেছে।
তবে মঙ্গলবার ( ১৮ জুন) ২৪ বছরের মধ্যে পুতিনের প্রথম উত্তর কোরিয়া সফর কেবল সৌজন্যমূলক নয়, বরং তারা আরও বেশি কিছু কাজ বা পদক্ষেপ থাকতে পারে বলে কিছু বিশ্লেষক মত প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, উভয় পক্ষ সম্ভবত ক্রমবর্ধমান সামরিক সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
“আমি এই সফরে কুশল বিনিময়ের পরিবর্তে কিছু আনুষ্ঠানিক ফলাফল আশা করব” বলে মন্তব্য করেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেক্সি মুরাভিয়েভ, যিনি জাতীয় নিরাপত্তা এবং ষ্ট্রেটিজিক স্টাডিজ নিয়ে কাজ করেন।
রুশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে পুতিন একটি "বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সফরে" মঙ্গলবার (১৮ জুন) পিয়ংইয়াং যাবেন। এই সফরে দু'দেশের মধ্যে একটি "স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ" চুক্তি সই হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
শুক্রবার, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা পুতিনের আসন্ন সফর নিয়ে জরুরিভিত্তিতে ফোনে আলোচনা করেছেন। সোলের মতে, উভয় পক্ষই সতর্ক করে দিয়েছে যে, পিয়ংইয়াং-এর উপর অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রস্তাব পুতিনের সফরের ফলে লঙ্ঘন হওয়া উচিত হবে না।
রাশিয়া কয়েক দশক ধরে চীনসহ উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগী। তবে এই সম্পর্ক কখনও কখনও দোদুল্যমান হয়ে পরে।
রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের একটি স্থায়ী সদস্য এবং তারা ভিটো দেয়ার ক্ষমতা রাখে। সম্প্রতি ২০১৭ সালে, রাশিয়া পিয়ংইয়াং-এর পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ সম্পর্কিত নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেছিল।
তখন থেকে পুতিন ও কিম একসঙ্গে কাজ করার কারণ খুঁজে পান কারণ তারা প্রত্যেকেই পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রচারণা চালাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০১৯ সালে আলোচনা থেকে সরে আসার পর কিম নাটকীয়ভাবে তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার সম্প্রসারণ করেছেন এবং বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্রদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে তা করা হয়েছে।
পুতিন ২০২২ সালে পূর্ণ মাত্রায় ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করেন এবং তখন থেকেই সেখানে পশ্চিমা সমর্থিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরপরই কিম মুষ্টিমেয় বিশ্ব নেতাদের একজন হয়ে ওঠেন যারা পুতিনের যুদ্ধকে সুস্পষ্টভাবে সমর্থন দেন।
স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকরা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্রসহ উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র খুঁজে পেয়েছেন। ফলে, উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে গোলা-বারুদ সরবরাহ করছে বলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে দাবি করে আসছে, তার সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে।
স্পষ্টতই জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাকে লঙ্ঘন করতে পারে এমন কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সাহসিকতার সাথে এই অগ্রগতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে মস্কো বলেছে তারা এখন নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে।
পুতিনের সফর
পুতিন এখনও সতর্কতার সঙ্গে পিয়ংইয়াং-এর সঙ্গে অগ্রসর হতে পারেন। তিনি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাগুলি পুরোপুরি বা খোলাখুলিভাবে পরিত্যাগ করবেন না। কারণ, মস্কো আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দায়িত্ববান পৃষ্টপোষক হিসাবে নিজেকে চিত্রিত করতে আগ্রহী বলে মুরাভিয়েভ মন্তব্য করেন।
মুরাভিয়েভ বলেন, রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে লঙ্ঘন করে “পশ্চিমাদের দিকে তার মধ্যাঙ্গুলি উচিয়ে ধরতে পারে।”
“বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার থেকে রাশিয়ার উপরে বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ রয়েছে। সুতরাং রাশিয়া যদি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে তবে ইউক্রেনে তার আগ্রাসী পদক্ষেপের ফলে রাশিয়া ইতিমধ্যে যা আসছে তার চেয়ে বেশি কী ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে?” তিনি প্রশ্ন ছুঁড়লেন।
পুতিন তার উত্তর কোরিয়া সফরকে উত্তর কোরিয়ার স্যাটেলাইট কর্মসূচির প্রতি আরও সমর্থন জোরদার করার জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
কিমের রাশিয়া সফরের পর উত্তর কোরিয়া দুটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। যদিও এর সাম্প্রতিকতম উৎক্ষেপণটি ব্যর্থ হয়েছে, তবে উত্তর কোরিয়া যে নতুন ধরণের ক্যারিয়ার রকেট ব্যবহার করেছে তা রাশিয়ার সহায়তার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলেন।
যদিও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বাধা হিসাবে রয়ে গেছে, উভয় পক্ষই সহযোগিতা করার জন্য অর্থনৈতিক উপায় খুঁজে পেতে পারে। যেমন উত্তর কোরিয়ার শ্রমিকদের রাশিয়ায় প্রেরণ করা, বলছেন রাশিয়ার ফার ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আর্টিওম লুকিন।
“রাশিয়া কখনোই বলেনি যে তারা উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পালন করা বন্ধ করবে। কিন্তু আপনি জানেন যে এই ধরণের কিছু জিনিসগুলো ম্যানেজ করার নানা উপায় রয়েছে – যেমন চীনের দিকে দৃষ্টি দিন,” লুকিন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন। “আমি মনে করি, রাশিয়াও কিছু ক্ষেত্রে একই পন্থা অনুসরণ করবে।”
রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র কর্মসূচিকে ঠিক কীভাবে সমর্থন করতে পারে, সে সম্পর্কে লুকিন মন্তব্য বা অনুমান করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি স্বীকার করেন যে রাশিয়া “একমাত্র প্রধান শক্তিধর দেশ, যারা উত্তর কোরিয়াকে এমন কিছু জিনিস সরবরাহ করতে পারে যার ফলে তারা নিরাপদ বোধ করতে পারে।”
লুকিন বলেন, রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া সহযোগিতা সম্প্রসারণ ইউক্রেন যুদ্ধকে ছাড়িয়ে যাবে কিনা তা জানা অসম্ভব, তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এখানে দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ কাজ করছে।
“আমি মনে করি রাশিয়া ও (উত্তর কোরিয়ার) মধ্যকার সম্পর্ক কার্যকরভাবে মিত্রতা বলাটা ন্যায্য”, বলেন লুকিন। “আমরা এখনও জানি না যে এই মিত্রতা সত্যিকারের জোটে রূপান্তরিত হবে কিনা, তবে সে সম্ভাবনা আমি নাকচ করে দিব না।”