বর্ষা মৌসুমের প্রথম দিনেই (১ আষাঢ়) ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ। আর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ছে; এর ফলে দেখা দিতে পারে বন্যা।
ইতোমধ্যেই সিলেটে আবার বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার নদীর পানি। সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে পানির তোড়ে একাধিক স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। প্লালাবিত হয়েছে অনেক এলাকা।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) শনিবার (১৫ জুন) জানিয়েছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ছে। আর এই প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।
তবে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছে এফএফডব্লিউসি। বলেছে, আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত এই স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকতে পারে।
এদিকে, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও আশপাশের উজানে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। এর ফলে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদ-নদীসহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়তে পারে।
পানি বাড়ছে সুরমা-কুশিয়ারায়
টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সিলেটে আবার বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার নদীর পানি। এর ফলে, এই অববাহিকার বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে।
শুক্রবার থেকে কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে শনিবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদ সীমা ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় আবার বন্যার আশঙ্কা করছেন সিলেটের নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা।
এদিকে, সিলেট আবহাওয়া অফিস শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২০২ মিলিমিটার ও শনিবার সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে।
সিলেটের বৃষ্টিপাত ছাড়াও, উজানে অর্থাৎ ভারতের চেরাপুঞ্জিতে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৫১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টির এই পানি সিলেটের নদ-নদী দিয়ে নেমে আসে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শনিবার সকাল ৬টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১২ দশমিক ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। সকাল ৯টায় তা বিপদ সীমা ছাড়িয়ে যায়। সকাল ৯টায় এই পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো; যা বিপদ সীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপরে। এছাড়া শুক্রবার এই পয়েন্টে পানি প্রবাহের মাত্রা ছিলো ১১ দশমিক ৮৫ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে সুরমার বিপদ সীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার।
অন্যদিকে, কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে শুক্রবার থেকে বিপদ সীমার উপর দিয়ে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার সকাল ৬টায় বিপদ সীমার ৪৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো কুশিয়ারা। সকাল ৯টায় তা আরো বেড়ে ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
সুরমা-কুশিয়ারা নদীর এই দুই পয়েন্ট ছাড়াও, সবকটি পয়েন্টে পানি বাড়ছে এবং সারিগোয়াইন, লোভা, ডাউকি ও ধলাই নদীর পানি আবার বাড়তে শুরু করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় নদীর পানি আবার বাড়তে শুরু করেছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি দুইটি পয়েন্টে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য পয়েন্টেও পানি বাড়তে শুরু করেছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসেন বলেন, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২০২ মিলিমিটার ও শনিবার সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সিলেটে আরো বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে।
সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢল
টানা বর্ষণ আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে, সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজারসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া পাহাড়ি ঢলে ভেঙে গেছে সুনামগঞ্জের একাধিক স্থানের বেড়িবাঁধ।
পাহাড়ি ঢলে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় এবং তলিয়ে যাওয়ায়, বিভিন্ন এলাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে ছোট-বড় সব ধরনের যান চলাচল। গৃহহীন হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার।
এদিকে, সীমান্তের ওপার থেকে আসা জলপ্রবাহে, খাসিয়ামারা নদীর স্রোত তীব্রতর হয়েছে। এ কারণে, লক্ষীপুর ইউনিয়নের নোয়াপাড়া, ইদ্রিসপুর, চৌকিরঘাট বেড়িবাঁধ ভেঙে বিভিন্ন হাওরে পানি প্রবেশ করেছে। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র। গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া, আমনের বীজতলা, আউশ ও সবজি খেত তলিয়ে গেছে বল জানা গেছে।
অন্যদিকে, বোগলাবাজারে চিলাই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে এবং সুরমা ইউনিয়নের টিলাগাও-টেংরাটিলা সড়ক ভেঙে গেছে। মহব্বতপুর বাজার-লিয়াকতগঞ্জ বাজার সড়কে নোয়াপাড়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলা সদরের সঙ্গে লক্ষীপুর ইউনিয়নের ২৮টি ও সুরমা ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামসহ সীমান্তের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে।
বাংলাবাজার ইউনিয়নের পেকপাড়া, চৌধুরী পাড়া, মৌলারপাড়, চিলাইপাড়, পুরান বাশতলা গ্রামের অনেক ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
লক্ষীপুর ইউপি চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম বলেন, “খাশিয়ামারা নদীর স্রোতে আমাদের ইউনিয়নের নোয়াপাড়া, ইদ্রিসপুর ও চৌকির গাঁটে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে বেশ কিছু গ্রাম। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।”
শুকনো খাবার ও নিরাপদ পানি জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো করা হয়েছে বলে জানান লক্ষীপুর ইউপি চেয়ারম্যান।
সুরমা ইউপির চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ বলেন, খাশিয়ামারা নদীর স্রোতে সুরমা ইউনিয়নের কিছু বাড়িঘরে পানি উঠেছে, তাদের জন্য শুকনো খাবার ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বোগলাবাজার ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মিলন খান বলেন, চিলাই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে বোগলাবাজার ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পুকুরের মাছ ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার দোয়ারাবাজার সদর ইউনিয়নের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানিয়েছেন দোয়ারাবাজারে নিকট সুরমা নদী ২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, তিন দিন ধরে টানা বর্ষণ ও মেঘালয় থেকে নেমে আসা ঢলে উপজেলার সুরমা, চেলা, চলতি, মরা চেলা, খাসিয়ামারা, মৌলা, কালিউরি, ধূমখালিসহ উপজেলার সব নদী-নালা, হাওর ও খাল-বিলের পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
উপজেলার বিভিন্ন সড়ক ও বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী।
তিস্তা-তীরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করেছে। একইসঙ্গে তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) দুপুর থেকে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করে। সে দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল ৫১ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। পরে, রাতে পানি প্রবাহ আরো বাড়ে।
তবে, শনিবার (১৫ জুন) বিকাল ৩টার দিকে তিস্তার পানি বিপদ সীমার ৬৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই সময় তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় বিপদ সীমার মাত্র ২১ সেন্টিমিটার নিচে।
পানি বৃদ্ধিতে, লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কালমাটি, রাজপুর, গোকুণ্ডা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল; আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী, মহিষাশহর কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি; হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী, দোয়ানী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, বাঘের চর, ধুবনী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী এবং পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়নের তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বাড়ি ঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকার অনেক ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।
সদর উপজেলার গোকুন্ডা এলাকার কৃষক দেলোয়ার হোসেন জানান, তিস্তা ব্যারেজের ৪৪ জলকপাট খুলে দেয়ার কারণে লালমনিরহাটের তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে হুহু করে পানি প্রবেশ করেছে। এতে বাড়িঘরে পানি উঠেছে। পানি আরো বাড়লে, বন্যা দেখা দিতে পারে বলে জানান তিনি।
আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন এলাকার এরশাদ হোসেন বলেন, “শুক্রবার সকাল থেকে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে আমাদের ঘরে পৌঁছে গেছে। পানি আরেকটু বাড়লে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে হবে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, ভারতের সিকিমে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে সেখানে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। সেই পানি তিস্তায় প্রবেশ করছে এবং তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বন্যার কোনো আভাস পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
শনিবার দুপুর থেকে পানি প্রবাহ আগের তুলনায় কম রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী।