ঋণের ফাঁদে আটকা বাজেট এবং লুটেরাদের লাভবান করার বাজেট- তাসলিমা আখতার

তাসলিমা আখতার

বাংলাদেশে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হলো– এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং অংশীজনের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।

প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো– এ বিষয়ে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান ও আলোকচিত্রী তাসলিমা আখতারের সঙ্গে কথা হয় আমাদের।

ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মলয় বিকাশ দেবনাথ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে ইতিবাচক দুটি দিক কোনগুলো? কেন?

তাসলিমা আখতার: বাজেটের ইতিবাচক দিক হিসেবে অনেকে বাহবা দিচ্ছেন বাজেট সংকোচন, এমপিদের গাড়ি কেনায় শুল্ক আরোপ, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কারা প্রকৃত উপকারভোগী তা না দেখে, টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়া কিংবা মান বৃদ্ধির বদলে শিক্ষা খাতে দালানকোঠাসহ এমনই নানা দিককে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ের সামগ্রিক দিক ও প্রভাব পর্যালোচনা জরুরি। না হলে করদাতা জনগণের জন্য এটি কতটা মঙ্গল বয়ে আনবে– তার অঙ্ক বারবার ভুল হতে থাকবে। বাজেটে সরকারের আয়-ব্যয় খাতে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা এবং বণ্টনব্যবস্থা বৈষ্যম্যহীন হচ্ছে কিনা, সেই মানদণ্ডের আলোকেই বাজেট পাঠ জরুরি বলে মনে করি। সেই আলোকে অল্প কথায় বলা যায়, অর্থনীতির দুর্যোগের ঘনঘটাময় পরিবেশে আরেক দফা অশনিসংকেত নিয়েই যেন প্রস্তাবিত বাজেট হাজির হলো ৬ জুন ২০২৪। ঋণের জালে আটকেও বাজেটের স্লোগান ‘সুখী সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট’বাংলাদেশের অঙ্গীকার। দেশের ৫৩তম এই বাজেট ‘ঋণের ফাঁদে আটকা বাজেট এবং লুটেরাদের লাভবান করার বাজেট’বললে ভুল হবে না। যেখানে কর-ঋণ ও মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত হবে নিম্ন আয়ের জনগণ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এবারের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশ। এর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে? এ খাতে খরচ কমিয়ে আনার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন?

তাসলিমা আখতার: বাজেটে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণের সুদ গুনতে দেশের অর্থনীতি বিরাট বিপদের দিকে হাঁটছে। এটি বাজেটের ১৪.২৪ শতাংশ। পরিস্থিতি যা, তাতে দেশি এবং বিদেশি দুই খাতের ঋণ এবং ঋণের সুদ দুই-ই পরিশোধ করতে হবে ঋণ করে। দেশীয় ব্যাংক খাতে এর প্রভাব পড়বে। ঋণের দুষ্টচক্রে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বে দেশের অর্থনীতি। বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে ডলারে। ফলে ব্যাংক খাত ও বৈদেশিক রিজার্ভে টান পড়বে। রিজার্ভ কমলে আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মূলধনি পণ্য, কাঁচামাল, শিল্পের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ওপর চাপ বাড়বে।

এই খাতে খরচ কমাতে সরকারকে প্রত্যক্ষ কর, মুনাফা কর, অধিক আয়ের ওপর করহার বৃদ্ধি করতে হবে। অবৈধ আয় চিহ্নিত করে তা বাজেয়াপ্ত ও অবৈধ আয়ের উৎস বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি অর্থ পাচার বন্ধ করা এবং ঋণখেলাপিদের অনাদায়ী ঋণ আদায় বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে সরকারকে। সাধারণ জনগণ, মাঝারি ও খুদে উদ্যোক্তাদের ওপর কর ভ্যাট ট্যাক্সসহ নানারকম করের বোঝা চাপানো কমাতে হবে। মেগা প্রকল্পসহ নানা প্রকল্পে খরচ কমানো ও ঋণ কমাতে হবে। সর্বোপরি দলীয় সুবিধা বিবেচনায় প্রশাসন খাতসহ নানা খাতে ব্যয় কমাতে হবে। দলীয় ও লুটেরাদের সুবিধায় কর সীমানা নির্ধারণ বন্ধ করতে হবে। এসবই সম্ভব হবে যদি বাজেট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে তার ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার নিজেই যদি এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়, তাহলে কী ধরনের প্রভাব দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর পড়বে?

তাসলিমা আখতার: দেশীয় ব্যাংক থেকে বড় অংশ ঋণ নির্ধারণের লক্ষ্য মানে আরেক দফা বিপদ যোগ করবে অর্থনীতিতে। বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমবে। একই সাথে কর্মসংস্থানের পরিসর কমবে এবং শিল্প উৎপাদন খরচ বাড়বে।

যেহেতু দেশের অর্থনীতি বেসরকারি খাত এবং বিশেষভাবে মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর নির্ভরশীল। সরকার ঘাটতি বাজেট পূরণে যে হারে ব্যাংক ঋণ করার ভাবনা হাজির করেছে, তাতে সামগ্রিকভাবে বেসরকারি খাত এবং বিশেষভাবে ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ পাবেন না। সে ক্ষেত্রে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। অর্থনীতির ধস মোকাবিলা করতে সরকার ব্যর্থ হবার লক্ষণ বাজেটে ইঙ্গিত দিচ্ছে।


ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?

তাসলিমা আখতার: আইএমএফের পরামর্শে বাজেটে সংকোচনের নীতিতে কমবে বেসরকারি বিনেয়োগ প্রবাহ। ঘাটতি বাজেট ও ঋণের সুদ পরিশোধে বরাদ্দ বাড়ায় অর্থনীতিতে ঋণ নির্ভরতা ও ব্যাংকের তারল্য সংকট বাড়বে। শিল্প উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হবার সম্ভাবনা আছে। পাশাপাশি জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমার সাথে সাথে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। এ ছাড়া এবারের বাজেট প্রস্তাবনায় সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর অবকাশ ও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবার ফলে বেসরকারি অঞ্চলে সুবিধা থাকছে না। অর্থনীতির এই ঘোলাটে পরিস্থিতির প্রভাব বিরাট অংশের মানুষের ভেতরে ছড়িয়ে পড়বে। বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনিয়োগবান্ধব এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক বাজেট করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে তেমন লক্ষণ নেই।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করে বলছেন, বৈধ আয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশ, সেখানে কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট ১৫ শতাংশ। ফলে এতে কর ফাঁকিকে উৎসাহিত করবে। নৈতিকতার প্রশ্নটি বাদ রেখেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ কতটা ইতিবাচক ফল দেবে বলে আপনি মনে করেন?

তাসলিমা আখতার: ‘কালো’ বা ‘সাদা’ টাকার শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত সরকার এবং মূলধারার অর্থনীতিবিদদের। অপ্রদর্শিত আয় ও সম্পদের মালিক ব্যক্তি-গোষ্ঠী-প্রতিষ্ঠান ও পাচারকারীদের কোনো শর্ত ছাড়া প্রশ্নাতীত ছাড় প্রস্তাব করেছে চলতি বাজেটে। এ যেন সাধারণ ক্ষমা কিংবা বিশেষ পুরস্কার। ফলে নিয়মিত বৈধ সৎ করদাতাদের ওপর চাপ বাড়বে। ‘অবৈধ সম্পদ আরোহণকারী তোষণ ও রক্ষার’ বাজেটে পরিণত হবে প্রস্তাবিত বাজেট।

এই ছাড় কোনোভাবেই অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে না। প্রতিবছরই এই সুযোগ দিলেও অপ্রদর্শিত সম্পদকে করের আওতায় আনা যায়নি। এই বিশেষ ছাড় ক্ষমতাবান বিশেষ ব্যক্তি-গোষ্ঠী-প্রতিষ্ঠানকে সরকারের ছত্রছায়ায় রক্ষা পাবার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। সরকারের অগণতান্ত্রিক সকল তৎপরতা টিকিয়ে রাখতেই দুর্নীতিগ্রস্তদের সুযোগ অবারিত করে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন হয়, সেটা বুঝতে খুব বেগ পেতে হয় না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: মূল্যস্ফীতি গত দু’বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপর। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এ জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো ও কৃচ্ছসাধনের ওপর মন্ত্রী জোর দিয়েছেন? এগুলো বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা সরকারের কতটা রয়েছে? মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

তাসলিমা আখতার: গোড়াতেই গলদ হয়ে আছে মূল্যস্ফীতির অঙ্কের তথ্য বিভ্রাটে। সরকারের ভাষ্যে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ৯%-এর বেশি। অন্যদিকে বিআইডিএস বলছে মূল্যস্ফীতি ১৫%। আবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির মতে, মূল্যস্ফীতির হিসাব গড় হিসাবে করা হয়; যা শুধু সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত পণ্য বাস্কেটের ভিত্তিতে হিসাব করলে মূল্যস্ফীতি মূলত ২০%-এর বেশি। ফলে সরকার আসলে কত থেকে কত হারে কমাতে চায়, সেটিও অস্পষ্ট। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটের চ্যালেঞ্জ বলা হলেও বাস্তবে যথাযথ পরিকল্পনা নেই। উল্টো পরোক্ষ কর ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। প্রস্তাবিত বাজেটে শুধু সুদের হার বাড়িয়েই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ভাবনা অবাস্তব। ডলারের বিপরীতে দরপতন, বিপুল পরিমাণ ঘাটতি বাজেট, ক্রয়ক্ষমতা কম, কম মজুরি, জাতীয় ন্যূনতম মজুরির অনুপস্থিতি, ঋণ ও ব্যাংক সংকটের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।

অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতির নিষ্ঠুরতার ভাগীদার হবে শ্রমজীবী মেহনতি ও নিম্ন আয়ের মানুষ। যেখানে এই সংকট থেকে মুক্ত হতে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী পোশাক শ্রমিকসহ শ্রমজীবীদের রেশনিং, ফ্যামিলি কার্ড ও শ্রম খাতে বরাদ্দ দেবার দাবি ওঠে, সেখানে বাজেটে তার যথাযথ প্রতিফলন নেই। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ড বা আগামীতে কাদের এই কার্ড দেওয়া হবে, তা জনগণের কাছে অস্পষ্ট। যতদূর জানা যায়, ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় সুবিধা ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এগুলো ব্যবহৃত হয়।


সামাজিক সুরক্ষা খাতের সুবিধা থেকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে কিছুটা স্বস্তির জায়গা তৈরি করতে পারত। কিন্তু শুভঙ্করের ফাঁকি আছে সামাজিক সুরক্ষা খাতেও। এই খাত থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, স্কুল-কলেজে শিক্ষাবৃত্তি, সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের কলোনি নির্মাণ, সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ইত্যাদিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। টাকার অঙ্কে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়লেও তা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় যায় না। ফলে সামাজিক সুরক্ষা খাতের যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: জনপ্রশাসন খাতে খরচ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা, যা শীর্ষ পাঁচ ব্যয় বরাদ্দ খাতের একটি। অথচ আমরা প্রতিবছরই দেখি বাজেট বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। যার জন্য জনপ্রশাসনের অদক্ষতাকে সমালোচকরা একটি প্রধান কারণ বলে মনে করে থাকেন। বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি না করে জনপ্রশাসন খাতে এ বিপুল বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

তাসলিমা আখতার: সরকারের অন্যতম বড় ব্যয় খাত জনপ্রশাসন। অথচ যে কোনো জনমুখী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতি গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে শিক্ষা খাতকে টপকে এগিয়েছে জনপ্রশাসন খাত। ২০২৪-২৫ বাজেটের ২২.২% এ খাতে প্রস্তাব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যয়ের বড় অংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ। এ বছর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের অনেকটা গেল নির্বাচনের আগে পুলিশ ও প্রশাসনকে হাতে রাখতে পদোন্নতি এবং নানা সুবিধা প্রদানের ফলাফল বলা যায়।

জনগণকে সেবা দেওয়া জনপ্রশাসনের কাজ। অথচ এখানে চরম দুর্নীতি ও লালফিতার দৌরাত্ম্য চলছে এই খাতে। সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান এক-একটা দুর্নীতির বিরাট আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখানে বিনা ঘুষে জনগণ কোনো সেবা পাবেন, তা ভাবা কঠিন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হাসপাতাল, আদালত থেকে কারাগারসহ সর্বত্র সততার সাথে কোনো কাজ করতে চাইলে সেই সেবা পাওয়া বা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে যখন একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে, বিপুল সংখ্যক লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে, তখন সরকার জনগণের জন্য ব্যয় বাড়াতে পারছে না। অথচ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যহীনভাবে প্রশাসন পরিচালনা ব্যয় বাড়িয়ে যেতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। প্রকৃত অর্থে জনগণের রায়ের ওপর নির্ভর না করা আমলাতন্ত্রনির্ভর সরকারের পরিণতি এটাই হতে বাধ্য। জনপ্রশাসন খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ বাড়িয়ে আমলাতন্ত্রকেও দলীয় ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার হাতিয়ারে পরিণত করার নানা প্রচেষ্টার প্রতিফলন বাজেটে হবে, এটাই স্বাভাবিক।