মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে মনে হয় না- সালেহউদ্দিন

সালেহউদ্দিন

বাংলাদেশে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হলো– এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং অংশীজনের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রেদওয়ানুল হক।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে ইতিবাচক দুটি দিক কোনগুলো? কেন?

ড. সালেহউদ্দিন: জ্বালানি ও সারের ভর্তুকি তুলে দেওয়ার কথা বলেছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ। তবে সেটি বহাল রাখা হয়েছে। জ্বালানি খাত, বিশেষ করে কৃষির জন্য এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাছাড়া আমদানি পণ্যের মধ্যে কিছু ভোক্তাদ্রব্যের কর কমানো হয়েছে। এটি সামান্য হলেও মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। এর বাইরে করপোরেট ট্যাক্স হার না বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি ছিল ইতিবাচক। তবে সার্বিকভাবে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কোনো ভালো দিক প্রস্তাবিত বাজেটে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তবে বাজেটের আকার ছোট রাখা হয়েছে, এটি একটি ভালো দিক হতে পারে। সরকারি ব্যয়ের দিক থেকে তেমন কিছু কমানো হয়নি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এবারের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশ। এর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে? এ খাতে খরচ কমিয়ে আনার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন?

ড. সালেহউদ্দিন: আমরা দিন দিন ঋণনির্ভর হয়ে যাচ্ছি। দেশে ঋণ তো বাড়ছেই, এর সুদও বাড়ছে। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এটি কোনোমতেই ঠিক হচ্ছে না। কারণ, ঋণ এবং সুদ পরিশোধের সামর্থ্য থাকতে হবে। আমাদের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে; তাহলে কী দিয়ে ঋণ পরিশোধ করব। আর যদি রিজার্ভ বাড়েও, সামনের দিনগুলোতে সেটি আমাদের আমদানিতে দরকার হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে, তার ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার নিজেই যদি এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়, এর কী ধরনের প্রভাব দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর পড়বে?

ড. সালেহউদ্দিন: সাধারণত সরকারের ঋণ নেওয়াটাই আমরা নিরুৎসাহিত করি। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে বিপুল ঋণ নেওয়া মোটেও ঠিক হচ্ছে না। এমনিতেই ব্যাংক খাত নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত। তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে এ খাত থেকে সরকারের মোটা অঙ্কের ঋণ বেসরকারি খাতকে প্রভাবিত করবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?

ড. সালেহউদ্দিন: সরকারি ঋণের চাপে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে না। এতে কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে। এর ফলে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীরা কাঙ্ক্ষিত হারে কর দিতে পারবে না, অপরদিকে বিভিন্ন খাতে যে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু, আয় কমে গেলে সাধারণ মানুষ ভ্যাট কীভাবে দেবে?

ভয়েস অফ আমেরিকা: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। অনেকে এ নিয়েসমালোচনা করে বলছেন, বৈধ আয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশ, কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটে ১৫ শতাংশ কর দিলেই যেহেতু চলবে, এটি তাই কর ফাঁকিকে উৎসাহিত করতে পারে। নৈতিকতার প্রশ্নটি বাদ রেখেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ কতটা ইতিবাচক ফল দেবে বলে আপনি মনে করেন?

ড. সালেহউদ্দিন: খুব বেশি ইতিবাচক হবে না। পাচার করা টাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কেউ ফেরত আনবে বলে আমার মনে হয় না। এ বিষয়ে অতীতের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। এর আগেও এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তেমন কোনো অর্থ ফেরত আসেনি। দেশের অভ্যন্তরে থাকা অপ্রদর্শিত অর্থের কিঞ্চিৎ পরিমাণ হয়তো আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে আসবে। তবে সার্বিক খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে। এ সিদ্ধান্ত ভালো করদাতাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে করজাল বাড়ানোর যে পরিকল্পনা রয়েছে সে ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত সহায়ক হবে না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: মূল্যস্ফীতি গত দু’ বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপর। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এ জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো ও কৃচ্ছসাধনের ওপর মন্ত্রী জোর দিয়েছেন? এগুলো বাস্তবায়নের সক্ষমতা সরকারের কতটা রয়েছে? মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

ড. সালেহউদ্দিন: লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। মূল্যস্ফীতি হয়তো কিছুটা কমতে পারে। তবে সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে মনে হয় না। কারণ, বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেই। উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা হলেও সেটি খুব বেশি বাড়বে বলে মনে হয় না। তাছাড়া বাজার সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: জনপ্রশাসন খাতে খরচ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা; যা শীর্ষ পাঁচ ব্যয় বরাদ্দ খাতের একটি। অথচ আমরা প্রতিবছরই দেখি বাজেট বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। যার জন্য জনপ্রশাসনের অদক্ষতাকে সমালোচকরা একটি প্রধান কারণ বলে মনে করে থাকেন। বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি না করে জনপ্রশাসন খাতে এ বিপুল বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

ড. সালেহউদ্দিন: আমাদের প্রশাসনের ব্যয় কমানো হচ্ছে না, একটি মাথাভারী প্রশাসন হয়ে উঠছে। অথচ বাজেট বাস্তবায়নের হার ভালো নয়। সময়মতো কাজ হচ্ছে না, কাজের মানও ভালো হচ্ছে না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: করের আওতা না বাড়িয়ে যারা কর দেয় তাদের ওপরই করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে এবারের বাজেটে, বলে সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

ড. সালেহউদ্দিন: প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো জরুরি ছিল। সে ক্ষেত্রে করের আওতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। মূল্যস্ফীতি যেখানে বাড়ছে, সেখানে ভ্যাট নির্ভরতা ইতিবাচক কিছু নয়।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয় না। কেন? এবারের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? এর তিনটি ইতিবাচক দিক বলবেন? প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন কোন দিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, যা এবারের বাজেটে সেভাবে দেওয়া হয়নি।

ড. সালেহউদ্দিন: প্রতিরক্ষা খাত নিয়ে আলোচনা কেন হয় না– সেটি আমিও বলতে পারব না। কোনো সরকারই এ বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে না। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই এ বিষয়টি গোপন রাখে। কারণ, এটি জাতীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত।