মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনাটা কাগুজে ধরে নিতে হবে- হোসেন জিল্লুর রহমান

হোসেন জিল্লুর রহমান

বাংলাদেশে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হলো– এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং অংশীজনের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।

প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো– এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় ভয়েস অফ আমেরিকার।

ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মলয় বিকাশ দেবনাথ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে ইতিবাচক দুটি দিক কোনগুলো? কেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: ইতিবাচক বা নেতিবাচক না বলে বরং বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কোন খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বরাদ্দের বিন্যাসগুলো লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কেমন সহায়ক হবে– সে নিয়ে কথা বলাটা দরকার।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এবারের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশ। এর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে? এ খাতে খরচ কমিয়ে আনার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: ঋণ কম নিলেই ঋণ পরিশোধ কম করতে হবে। সরকার গত এক দশক ধরে ঋণনির্ভর উন্নয়ন কৌশলনীতি পালন করে যাচ্ছে। এখন সহজ সুদে ঋণ নিলে এক ধরনের বাস্তবতা আবার উচ্চ সুদে ঋণ নিলে বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের সহজ শর্তে ঋণ নেওয়ার জায়গাগুলো সীমিত হয়ে পড়ছে। আর ঋণনির্ভর নীতির কারণে আজকে ১৪.২৪ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হয়। আরেকটা বাড়তি সমস্যা হলো– ঋণ নিলাম আর সেটার সদ্ব্যবহার করলাম না, তখন এটা বোঝা হয়ে যায়। কিন্তু ঋণ নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হতো। এখন যা করতে হবে তা হলো, ঋণ নির্ভরতার জায়গাটাকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এবং সেটা করতে হলে অন্য সম্পদ আহরণের আরও টেকসই সমাধান বের করতে হবে। আরেকটি হলো, সঠিক প্রকল্প নিতে হবে এবং ব্যয় দক্ষতা বাড়াতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে, তার ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার নিজেই যদি এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়, তাহলে কী ধরনের প্রভাব দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর পড়বে?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: একটা নেতিবাচক প্রভাব তো পড়বেই। সরকার যদি নিজেই ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নেয়, তবে বেসরকারি খাত কীভাবে নেবে। বাজেটটা আসলে বৈপরীত্যে ভরা। একটা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে যে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ২৩ থেকে ২৭ শতাংশে উন্নীত করা হবে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ নেওয়ার সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ হচ্ছে মূল বিনিয়োগ। আর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য অন্যতম প্রয়োজন হচ্ছে ব্যবসার পরিবেশকে উন্নত করা। কিন্তু দুর্নীতি এবং আমলাতন্ত্র যেভাবে চেপে বসেছে তাতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বিনিয়োগটা এক অর্থে কাগুজে বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আর কর্মসংস্থান এবারের বাজেটে একেবারেই উপেক্ষিত। গত এক দশক ধরেই দেখছি সরকার যে ধরনের কর্মকৌশল নিয়ে এগোচ্ছে, সেখানে কর্মসংস্থান গুরুত্ব পাচ্ছে না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করে বলছেন, বৈধ আয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশ, সেখানে কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট ১৫ শতাংশ। ফলে এতে কর ফাঁকিকে উৎসাহিত করবে। নৈতিকতার প্রশ্নটি বাদ রেখেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ কতটা ইতিবাচক ফল দেবে বলে আপনি মনে করেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আগেও ছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ সুযোগে পূর্বে কালো টাকা কতটুকু এসেছে, এর কোনো ডেটা নেই। সুতরাং কালো টাকা যদি আশানুরূপ না আসে, তবে এটা দুর্নীতিসহায়ক একটা পদক্ষেপ এবং বিভ্রান্তিকর। করদাতা কী সৎ থাকবে নাকি কালো টাকার দিকে যাবে। সার্বিকভাবে এ ধরনের পদক্ষেপ গোটা অর্থনীতিকে নৈতিকতাহীন বাস্তবতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: মূল্যস্ফীতি গত দু’বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপর। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এ জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো ও কৃচ্ছসাধনের ওপর মন্ত্রী জোর দিয়েছেন? এগুলো বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা সরকারের কতটা রয়েছে? মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এ বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনাটা কাগুজে ধরে নিতে হবে। ৯ শতাংশ তো আগেও ছিল, উন্নত যেমন হয়নি, তেমন কেন হয়নি তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যেমন– নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে কী আদৌ সে সুফল পৌঁছাবে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, প্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতা দেখানো দরকার, তার অনুপস্থিতি সুস্পষ্ট। আশা করি, ভবিষ্যতে সরকার সুনির্দিষ্ট করে দেখাবে, তারা কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনবে। সরকার তো আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে সব সেক্টরে। অর্থাৎ এগুলো মূল্যস্ফীতি বাড়ার লক্ষণ, কমার নয়।

ভয়েস অফ আমেরিকা: জনপ্রশাসন খাতে খরচ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা; যা শীর্ষ পাঁচ ব্যয় বরাদ্দ খাতের একটি। অথচ আমরা প্রতিবছরই দেখি বাজেট বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। যার জন্য জনপ্রশাসনের অদক্ষতাকে সমালোচকরা একটি প্রধান কারণ বলে মনে করে থাকেন। বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি না করে জনপ্রশাসন খাতে এ বিপুল বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: জনগণের নিকট টাকা পৌঁছাতে যদি অর্ধেক খরচ হয়ে যায় নিজের জন্য, তবে জনগণ কী পাবে? একদিকে যেমন জনপ্রশাসনের জন্য অনেক ব্যয় আবার অন্যদিকে অনেক জায়গায় জনবলের ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ বৈপরীত্যে ভরপুর। আবার জনপ্রশাসনের অনেক খরচ বিলাসিতার মধ্যে পড়ে। যেমন– দামি গাড়ি, মাত্রাতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে অনতিবিলম্বে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিধি দিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। আমাদের এখানে বিকেন্দ্রীকরণ নেই। স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা উত্তরোত্তর হ্রাস পাচ্ছে। আবার খরচ বাড়ছে কিন্তু সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: করের আওতা না বাড়িয়ে যারা কর দেয় তাদের ওপরই করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে এবারের বাজেটে, বলে সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: করের আওতা কেন বাড়াল না, এটা বলতে গেলে কর প্রশাসনে সংস্কার দরকার। সাধারণ জনগণ যাদের নির্দিষ্ট আয় এবং রাজনৈতিক শক্তি নেই, তাদের ওপর করের বোঝা বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে কালো টাকা সাদা করা হচ্ছে মাত্র ১৫ শতাংশ কর আদায় করে। এ ছাড়া সিমের ওপর অর্থাৎ টকটাইমের ওপর কর, এটা তো কর নিষ্ঠুরতা।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আলাদাভাবে জেন্ডার বাজেট করার দাবি অনেকে করছেন। আপনি কি একমত? জেন্ডার বাজেট হলে কী ধরনের সুবিধা হবে? কোন কোন দিককে জেন্ডার বাজেটে প্রায়োরিটি দিতে হবে?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: জেন্ডার বাজেটে কোনটা সম্পৃক্ত হবে তা দেখাতে পারাটাই হচ্ছে মূল কাজ। মুখে মুখে বলাই যায় সব বাজেটেই ৫০ শতাংশ জেন্ডার বাজেট করেছি। যেমন– কৃষিতে তো মেয়েরাও কাজ করে। জেন্ডার বাজেট সুনির্দিষ্টকরণ এর অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সরকারি এবং বেসরকারি দুই জায়গাতেই সুনির্দিষ্ট নজর দিতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয় না। কেন? এবারের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? এর তিনটি ইতিবাচক দিক বলবেন? প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন কোন দিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত; যা এবারের বাজেটে সেভাবে দেওয়া হয়নি।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এটা সত্য যে এটা খুব একটা আলোচনায় আসে না। আমি মনে করি, প্রয়োজনভিত্তিক প্রতিরক্ষা বাজেট করা দরকার। কেনাকাটায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাটা প্রয়োজন।