ক্যারিবিয়ায় পরিকল্পিত সামরিক মহড়ার আগে বুধবার রাশিয়ার যুদ্ধ-জাহাজের একটি বহর কিউবার সমুদ্রে পৌঁছেছে। অনেকেই মনে করছেন ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমি সমর্থন যখন বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন এটি হচ্ছে রাশিয়ার শক্তি প্রদর্শনের নিদর্শন।
তিনটি জাহাজ হাভানা উপসাগরে প্রবেশ করে। সঙ্গে ছিল ছোট কয়েকটি নৌকা যা ওই সরু খাল দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। রাশিযা ও কিউবার পতাকায় সজ্জিত ঐ যুদ্ধ-জাহাজের বহরটিকে ২১ বার তোপধ্বণি দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। নাবিকরা দ্বীপটির কাছে যাওয়ার সময়ে ইউনিফর্ম পরে সামরিক কায়দায় দাঁড়িয়েছিল।
তাদের পেছনেই একটি পরমাণু শক্তি সম্পন্ন সাবমেরিন আসার কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী অনুমান করছে এই মহড়ায় অংশ নেবে কয়েকটি রুশ জাহাজ এবং সহায়তাকারি জলযান যেগুলি ভেনেজুয়েলায়ও থামতে পারে।
ভেনেজুয়েলা ও কিউবার দীর্ঘ দিনের বন্ধু হচ্ছে রাশিয়া এবং রাশিয়ার যুদ্ধ-জাহাজ ও বিমান মাঝেই মাঝেই ক্যারিবিয়ান এলাকায় যায়। কিন্তু এই উদ্যোগ নেয়া হলো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিখের প্রতিরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অস্ত্র রাশিয়ার ভেতরে আঘাত হানতে ইউক্রেনকে অনুমতি দিলেন তার দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের পর। প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন তাঁর সামরিক বাহিনী পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও “একই রকম পদক্ষেপ নিয়ে এর জবাব দিতে পারে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক চিন্তক গোষ্ঠী উইলসন সেন্টারের ল্যাটিন আমেরিকা প্রোগ্রামের পরিচালক বেনজামিন গেডান ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে পশ্চিমি সম্পৃক্ততা সম্পর্কে বলেন, “ সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যুদ্ধ-জাহাজগুলি ওয়াশিংটনকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এটা অত্যন্ত অস্বস্তিকর যখন প্রতিপক্ষ আপনার কাছে অন্য দেশে নাক গলায। এতে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ কিউবা ও ভেনেজুয়েলা সহ অন্যান্য দেশকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে রাশিয়া তাদের সঙ্গেই আছে”।
যদিও জাহাজের ঐ বহরে পরমাণু শক্তি সম্পন্ন একটি ডুবো জাহাজও রয়েছে , যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য এসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন যে গোয়েন্দা বিভাগ নিশ্চিত হয়েছে যে কোন জাহাজেই কোন পারমানবিক অস্ত্র নেই। তিনি বলেন রাশিয়ার এই মোতায়েন “যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোন প্রত্যক্ষ হুমকি নয়”। এই কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে এ সব কথা বলেন কারণ এই তথ্য প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে বলেছিলেন রাশিয়ার জাহাজগুলি এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকাল জুড়েই অবস্থান করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০০৮ সাল থেকে রাশিয়ার জাহাজগুলি হাভানায় নোঙ্গর করে আসছে। সেই সময় রাশিয়ার কয়েকটি জাহাজ কিউবার জলসীমায় প্রবেশ করে যাকে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমগুলি দুই দশকের মধ্যে এ ধরণের প্রথম আগমন বলে বর্ণনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র এপিকে বলেন কিউবার বন্দরে রাশিয়ার জাহাজ আসা “নৌবাহিনীর নৈমিত্তিক আগমন” তবে তিনি এটা স্বীকার করেন যে তাদের সামরিক মহড়া “বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এবং আমাদের নেটো মিত্রদের মহড়া তত্পরতা”।
বুধবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভ মস্কোতে কিউবার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ব্রুনো রড্রিগেজের সঙ্গে একটি বৈঠকের আয়োজন করেন। বৈঠকের পর সংবাদদাতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় লাভরভ ইউক্রেনের বিষয়ে তাদের অবস্থানের জন্য কিউবার কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান।
লাভরভ বলেন, “হাভানা একেবারে শুরু থেকেই (ইউক্রেনে )কি হচ্ছিল তার সঠিক ও সত্য কারণগুলিএবংবহু বছর ধরে পশ্চিম কি প্রস্তুত করছিল সঠিক মূল্যায়ন করেছে”।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যশানাল স্টাডিজে আমেরিকার কর্মসূচির পরিচালক রায়ান বার্গ বলেন রাশিয়ার সামরিক ও প্রতিরক্ষা নীতিতে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। মনে করা হয় ইউরোপে ওয়াশিংটনের কর্মতত্পরতার বিপরীতে এটা ভারসাম্য আনতে পারবে।
বার্গ বলেন, “এটাকে যদিও মনে করা হচ্ছে মস্কোর তরফ থেকে উস্কানিরও বেশি, রাশিয়া যে তার মিত্রদের সাহায্যে পশ্চিম গোলার্ধে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে এটা যেন তারই বার্তা। আর তারা যতক্ষণ এখানে থাকছে যুক্তরাষ্ট্রে সেনাবাহিনী সতর্ক থাকবে”।
এই বছরের এই মিশনের সময়টা রাশিয়ার উদ্দেশ্যের অনুকুল হতে পারে তবে এতে এ প্রশ্নও উঠছে যে ভেনেজুয়েলার সরকার এটিকে প্রেসিডেন্ট মাদুরুকে তৃতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হবার উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে পারে। ভেনেজুয়েলার নির্বাচন হবে ৮ জুলাই।
ভেনেজুয়েলার প্রধান বিরোধী জোট ক্ষমতাসীন দলের এক দশক ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার এবং গায়ানার সঙ্গে উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে সংকট সৃষ্টির বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন গায়ানার সঙ্গে উত্তেজনাকে মাদুরোর সরকার নির্বাচন বিলম্ব করার কিংবা বাতিল করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি ওয়ার কলেজের রিসার্চ প্রফেসার ইভান এলিস বলেন, “ এটা প্রায় অচিন্তনীয় যে মাদুরো ক্ষমতা হারানোর কোন ঝুঁকি নেবেন”।
তিনি আরও বলেন,“ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনীর সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সব চেয়ে জানা বিকল্পটি হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক সংকট সাজানো যা ভেনেজুয়েলার নির্বাচন স্থগিত করার একটি অজুহাত হবে। ঐ অঞ্চলে রাশিয়ার যুদ্ধ-জাহাজগুলির উপস্থিতি এমন সংকট সৃষ্টি করার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে যাকে মাদুরো কাজে লাগাতে পারবেন, আর সেটাই সম্ভবত হচ্ছে ব্যাপার।
ডিসেম্বর মাসে ভেনেজুয়েলার ভোটদাতারা একটি গণভোটে গায়ানার এসেকুইবো অঞ্চলকে নিজেদের দখলে নেয়ার পক্ষে ভোট দেন। এই অঞ্চলটি গায়ানার দুই-তৃতীয়াংশ এবং সমুদ্রতীরবর্তী তেলের খনি আছে সেখানে। ভেনেজুয়েলা বলছে এক শতাব্দিরও বেশি সময় আগে সীমান্ত নির্ধারণের সময় এই অঞ্চলটি চুরি করে নিয়ে নেওয়া হয়।
ভেনেজুয়েলার এই দাবি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে গায়ানা অপেক্ষা করছে কিন্তু মাদুরোর সরকার তাদের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিচ্ছেনা।
এই চলমান বিবাদে যুক্তরাষ্ট্র গায়ানাকে সমর্থন করে এবং গত বছরের শেষের দিকে ভেনেজুয়েলা যখন দেশটি প্রবেশ করার হুমকি দেয় তখন যুক্তরাষ্ট্র নজরদারি বিমানের মাধ্যমে গায়ানাকে সাহা্য্য করেছিল। গত মাসে গায়ানার সরকার তার রাজধানীর উপর থেকে দুটি শক্তিশালী এফ/এ -এইটিনএফ সুপার হরনেট জেট উড়ে যাবার অনুমতি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে । এতে দেশ দুটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার নিদর্শন পাওয়া যায়।
গায়ানার ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারাত জাগদেও ৬ জুন স্বীকার করেন যে রাশিয়ার জাহাজ বহর কোন “প্রত্যক্ষ হুমকি নয়”।
তবে এক সংবাদ সম্মেলনে জাগদেও বলেন, “সে যাই হোক, আমরা সতর্ক আছি এবং আমাদের নীতির মধ্যে এই বিষয়টিকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গেই রেখেছি”।