ড. ইউনূস: অর্থ আত্মসাতের মামলায় অভিযোগ গঠন করেছে আদালত

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে ঢাকার একটি আদালত।

বুধবার (১২ জুন) অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, অভিযোগ থেকে অভিযুক্তদের খালাসের জন্য দাখিল করা আবেদনগুলো খারিজ করে দিয়ে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন এ আদেশ দেন।

তিনি বলেন, একইসঙ্গে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৫ জুলাই দিন ধার্য করে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেছে আদালত।

আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ড. ইউনূসসহ অন্য অভিযুক্তরা এখন জামিনে আছেন এবং তাঁরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বিচার দাবি করেছেন।

দুদকের মামলা

এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এ বিষয়ে শুনানি শেষে ২ জুন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় আদালত।

ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালত এ অভিযোগপত্র গ্রহণ করে। পরবর্তী বিচার কার্যক্রমের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এ মামলা বদলির আদেশ দেন তিনি।

এর আগে, ৩ মার্চ এ মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন পান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

মামলায় অভিযুক্ত বাকি ১৩ জন হলেন—গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম, এস এম হুজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী ও জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, ইউনিয়নের প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম ও দপ্তর সম্পাদক মো. কামরুল হাসান।

আরও মামলা ও আপিল

এ বছরের ১ জানুয়ারি ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি ধারায় ৬ মাসের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে রায় দেয় ঢাকার একটি শ্রম আদালত। আরেকটি ধারায়, তাঁদের ২৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এই মামলা দায়ের করেছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

দণ্ডাদেশ ঘোষণার পর, ড. ইউনুসের আইনজীবীরা জামিন আবেদন করেন। আদালত আবেদন মঞ্জুর করলে কারাগারে যেতে হয়নি ড. ইউনূসকে।

রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় আদালতে সাংবাদিকদের ড. ইউনূস বলেছিলেন, “যে অপরাধ করিনি, সেই অপরাধর জন্য শাস্তি পেলাম।”

এই মামলা ছাড়াও, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। মামলাকে হয়রানিমূলক বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূসের পক্ষের আইনজীবীরা।

অন্যদিকে, শ্রম আদালতের দেয়া ৬ মাসের কারাদণ্ডের রায় চ্যালেঞ্জ করে, ২৮ জানুয়ারি (রবিবার) শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

বিস্তারিত শুনানির জন্য আদালত আপিল গ্রহণ করে এবং আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেয়।

পরে, রংপুর শ্রম আদালতে দায়ের করা মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। পাশাপাশি এ মামলার বৈধতার প্রশ্নে রুল জারি করে আদালত।

এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, ৩০ এপ্রিল (মঙ্গলবার) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য

এদিকে বাংলাদেশের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, দেশের যেকোনো নাগরিক আইন লঙ্ঘন করলে তার যেমন বিচার হয় ড. ইউনূসেরও সেভাবেই বিচার হচ্ছে।

বুধবার (১২ জুন) সচিবালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে এসব কথা বলেন তিনি৷

বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ফাইল ছবি।

আনিসুল হক বলেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশসহ পশ্চিমা দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ মামলা হিসেবে বিবেচনা করে। ঠিক সেভাবেই ড. ইউনূসের মামলা পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি মামলা করেছে। সে মামলার ব্যাপারে আমি বলেছি- মামলাটি আদালতে চলমান।

আনিসুল হক আরও বলেন, আদালতে যে মামলা চলমান, সে মামলা সম্পর্কে আইনমন্ত্রী কোনো কথা বলেন না। বিষয়টিও তাদের (ইউরোপিয়ান প্রতিনিধিদল) বলেছি।

তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় আমি বলেছি, তাঁর (ড, ইউনূস) বিরুদ্ধে কর না দেওয়ার মামলা রয়েছে। তার একটি মামলায় তিনি আপিল বিভাগ পর্যন্ত গিয়ে হারার পরে কর দিয়েছেন। অন্য মামলা যেগুলো রয়েছে সেগুলোও কর না দেওয়ার মামলা।

আনিসুল হক বলেন, ইউরোপীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে শ্রম আইন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি আইন, ডেটা প্রটেকশন ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে কথা হয়েছে। তাদের নির্বাচন কমিশন থেকে একটি টিম এসেছিল সেই টিমের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কী চিন্তা ভাবনা করছি, রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সর্বশেষ অ্যান্টি ডিসস্ক্রিমিনেশন বেল সম্পর্কেও তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারা ড. ইউনূসের মামলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল। এসব ব্যাপারেও তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা কবে নাগাদ শ্রম আইন পাস করতে যাচ্ছি এসব তারা জানতে চেয়েছিল। আমি তাদের বলেছি- আন্তর্জাতিক শ্রম আদালতে আমাদের বিরুদ্ধে যে নালিশ করা হয়েছিল সেই নালিশটার আমরা শেষ চাই। আমি তাদের বলেছি শ্রম আইন নিয়ে আমরা যথেষ্ট কাজ করেছি।”

তিনি আরও বলেন, “শ্রম আইন সংশোধন নিয়েও কাজ করছি। আমার মনে হয় বিষয়টা শেষ করে দেওয়া উচিত।”

ড. ইউনূসের বিষয়ে কী কথা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ড. ইউনূসের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের দেশ থেকে অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছে সেসব বিষয়ে তারা স্পষ্ট হতে চেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ড. ইউনূসের ব্যাপারে যেসব মামলা রয়েছে আমি তাদের সেসব বলেছি। বলেছি, তিনি শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন সেখানে মামলা হয়েছে। তাঁকে সাজা দেওয়া হয়েছে। ১০৮ জন শ্রমিক ব্যক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) আনিসুল হক বলেছিলেন, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে না।

তিনি বলেছিলেন, “ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি করার জন্য সরকার কিছু করছে না। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে না। যে মামলা হয়েছে, সেটা শ্রমিকেরা করেছিল, তারপর শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিদপ্তর তাঁর বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছে। আমি কেবল বলব, দেশ আমাদের সবার। নির্বাহী, আইনসভা কিংবা বিচার বিভাগ সব বিষয়ে দেশের অর্জনই দেশের মানুষের।”

আনিসুল হক আরও বলেন, “অকাট্য প্রমাণ থাকার পরও বিদেশে ছড়ানো হচ্ছে; তাঁর (ড. ইউনূস) বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা। আরও বলা হচ্ছে, আমরা তাঁকে হয়রানির জন্য এটা করছি।”

এ ছাড়া, সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার বিচার অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে চলছে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বিচার বিভাগ অত্যন্ত স্বচ্ছ। অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচার চলছে।”

তিনি আরও বলেন, “তার জামিন পাওয়ার বিষয়টিই প্রমাণ করে বিচার অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে চলছে।”

হাছান মাহমুদ বলেন, ড. ইউনূসের সংগঠনের বঞ্চিত কর্মীরা তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো দায়ের করেছে, সরকার এতে কোনো পক্ষ নয়।