জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সোমবার গাজায় ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে আট মাস ধরে চলা যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে তাদের প্রথম প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির একটি পরিকল্পনার অনুমোদন দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পেশ করা প্রস্তাবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা করা যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানানো হয়, যেটা আমেরিকা বলছে ইসরায়েল মেনে নিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের রেসোলিউশনে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসকে যুদ্ধ বিরতি পরিকল্পনা মেনে নেয়ার আহবান জানানো হয়। হামাস প্রথম দিকে বলেছিল তারা তিন ধাপ-বিশিষ্ট প্রস্তাবকে ‘ইতিবাচক’ দৃষ্টিতে দেখছে।
রেসোলিউশনে ইসরায়েল এবং হামাসকে “কোন বিলম্ব এবং পূর্বশর্ত ছাড়া প্রস্তাবের সব পর্ব পুরোপুরি বাস্তবায়ন” করার আহবান জানানো হয়।
নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের ১৪জন রেসোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়, এবং রাশিয়া ভোট দানে বিরত থাকে।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড ভোটের পরে বলেন, পরিষদ “হামাসকে যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা মেনে নেয়ার জন্য পরিষ্কার বার্তা পাঠিয়েছে।” তিনি বলেন ইসরায়েল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যে পরিকল্পানা সারা বিশ্বের দেশগুলো সমর্থন করে।
“যুদ্ধ আজকেই শেষ হতে পারে, যদি হামাস একই কাজ করে,” তিনি পরিষদকে বলেন। “আমি আবার বলছি, লড়াই আজকেই শেষ হতে পারে।”
ইসরায়েল এবং হামাস তিন ধাপের যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা গ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে প্রস্তাবের প্রতি জাতিসংঘের সব চেয়ে ক্ষমতাশালী সংস্থায় ব্যাপক সমর্থন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য দু’পক্ষের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, বাইডেন পরিকল্পনার অংশবিশেষ উপস্থাপন করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, হামাসের সামরিক এবং প্রশাসনিক সক্ষমতা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে ফেলার আগে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করাই যাবে না।
হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ
হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ-এর নেতারা সোমবার প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য কাতারে সমবেত হন। বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, যে কোন চুক্তির লক্ষ্য হতে হবে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, গাজা থেকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি প্রত্যাহার, ইসরায়েলের গাজা অবরোধের সমাপ্তি, গাজার পুনর্নির্মাণ এবং গাজায় জিম্মি এবং ইসরায়লি জেলে ফিলিস্তিনি বন্দী বিনিময়।
জাতিসংঘে আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত আমার বেনজামা, যিনি নিরাপত্তা পরিষদে আরব অঞ্চলের প্রতিনিধি, ভোটের পর বলেন, এই রেসোলিউশন “তাৎক্ষনিক এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে অগ্রগতি।” তিনি বলেন এই রেসোলিউশন “ফিলিস্তিনিদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে, কারণ এর বিকল্প হচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর চলমান হত্যাযজ্ঞ এবং দুর্ভোগ।”
“আমরা এই রেসোলিউশনের পক্ষে ভোট দিয়েছি কূটনীতিকে একটি সুযোগ দেয়ার জন্য। যাতে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বন্ধের লক্ষ্যে চুক্তিতে পৌঁছানো যায়,” বেনজামা বলেন।
গত বছর ৭ অক্টোবর হামাস অতর্কিতে দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা করলে যুদ্ধের শুরু হয়। হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরাইয়েলি নিহত হয় যাদের অধিকাংশ বেসামরিক, এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। জিম্মিদের ১২০জন এখনো হামাসের হাতে রয়েছে, আর ৪৩জন মারা গেছেন বলে ধারনা করা হয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে ৩৬,৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে যাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু, এবং ৮৩,০০০ এর বেশি আহত হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৮০ শতাংশ দালান-কোঠা ধ্বংস হয়েছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ২৫ মার্চ এক রেসোলিউশনে গাজায় মুসলিমদের জন্য পবিত্র রমজান মাসে মানবিক যুদ্ধবিরতির আহবান জানায়। যুক্তরাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থাকে কিন্তু যুদ্ধে কোন বিরতি হয় নি।
বাইডেনের ঘোষণায় কী ছিল?
বাইডেন ৩১ মে যে নতুন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার ঘোষণা দেন, তাতে বলা হয়, ছয় মাসব্যাপী প্রাথমিক ধাপে ফিলিস্তিনি বন্দীর বিনিময়ে জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে, গাজার জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে এবং ভূখণ্ডের সকল এলাকায় ফিলিস্তিনিরা ফিরে আসবে।
প্রথম ধাপে মানবিক সাহায্যের নিরাপদ বিতরণের কথাও বলা হয়েছে। বাইডেনের মতে, এর ফলে প্রতিদিন ৬০০ ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে পারবে।
রেসোলিউশনে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় ধাপে “বাকি জিম্মিদের মুক্তি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে লড়াইয়ের স্থায়ী অবসান” হবে।
তৃতীয় ধাপে গাজার জন্য একটি “বহু বছরব্যাপী পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনা চালু করা হবে এবং মৃত জিম্মিদের দেহাবশেষ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।”
রেসোলিউশনে “সকল বিষয়ে মতৈক্যে এবং দ্বিতীয় ধাপ শুরু না হওয়া পর্যন্ত যাতে আলোচনা চলতে থাকে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, মিশর আর কাতারের কাজ করার প্রস্তুতিকে” স্বাগত জানানো হয়।
রেসোলিউশনে গাজার ভূগোল বা জনগোষ্ঠী বদলানোর প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। রেসলিউশনে “আলোচনার মাধ্যমে দুই-রাষ্ট্র সমাধান, যেখানে দুটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন পাশাপাশি শান্তিতে, নিরাপদ এবং স্বীকৃত সীমান্তের ভেতরে বসবাস করবে, সেই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের অবিচল অঙ্গীকার” পুনরায় ব্যক্ত করা হয়।
আরও জোর দেয়া হয় “গাজা ভূখণ্ড এবং পশ্চিম তীরকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে একীভূত করার গুরুত্বের উপর।” এই বিষয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকার সম্মত হয় নাই।