গাজায় ইসরায়েলের হামলা, পদত্যাগ করতে প্রস্তুত মন্ত্রী

গাজা ভূখন্ডের নুসেইরাত ক্যাম্পে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা পরিচালিত একটি স্কুলে যেখানে মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শ্রেণীকক্ষের পাশ দিয়ে ছেলেরা হেঁটে যাচ্ছে, জুন ৭, ২০২৪।

ইসরায়েল শনিবার গাজায় বোমাবর্ষণের তীব্রতা বাড়িয়েছে। এদিকে, যখন ইসরায়েল তার সামরিক অভিযান পরিচালনার কারণে ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছে তখন যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদের একজন মন্ত্রী ইসরায়েলের সরকার থেকে পদত্যাগ করার হুমকি বাস্তবায়িত করতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। ।

প্রত্যক্ষদর্শী এবং এএফপি সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, গাজা ভূখন্ডের বিভিন্ন অংশ হামলার ঘটনায় কেঁপে উঠে এবং মনে হচ্ছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলিকে লক্ষ্য করে এ হামলাগুলো করা হয়েছে।

ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলি বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলে হামলা চালানোর পর নজরদারিতে থাকা সত্ত্বেও তাদের আক্রমণ অব্যাহত ছিল। গাজার একটি হাসপাতাল জানায় স্কুলটিতে হামলায় ৩৭ জন নিহত হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী স্বীকার করেছে যে তারা নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে হামলা চালিয়েছে। তারা বলেছে যে তারা ফিলিস্তিনি ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী হামাসের একটি ঘাঁটি লক্ষ্য করে এবং ১৭ জন "সন্ত্রাসীকে" হত্যা করেছে।

হামাস, যারা ২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন করছে, ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে "মিথ্যা তথ্য" প্রদানের জন্য অভিযুক্ত করেছে। গোষ্ঠটি বলে, ইসরায়েলের মৃত হিসাবে তালিকাভুক্ত তিনজন ব্যক্তি আসলে এখনও জীবিত।

ফিলিস্তিনি শরনার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা, ইউএনআরডব্লিউএ স্কুলটি পরিচালনা করে। তারা ৬,০০০ জন বাস্তুচ্যুত মানুষের আবাসস্থল বলে একটি আশ্রয়স্থলে আঘাত করার জন্য ইসরায়েলের প্রতি নিন্দা জানায়।

সংস্থাটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, এক্স-এ একটি পোস্টে বলে, "আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা স্কুলটিতে" "পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই" আঘাত করা হয়েছে।

তারা বলে, "জাতিসংঘের প্রাঙ্গণকে লক্ষ্যবস্তু করা বা সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা নতুন মান হয়ে উঠতে পারে না। এটি বন্ধ করতে হবে এবং এর জন্যে দায়ী সকলকে জবাবদিহি করতে হবে।"

ইসরায়েল গাজায় হামাস এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ পরিচালিত সংস্থাসহ বেসামরিক অবকাঠামোকে তাদের কার্যপরিচালনা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ করে। হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

'প্রতিরক্ষাহীন

হামাস পরিচালিত অঞ্চলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এখন তার নবম মাসে গড়ানো যুদ্ধটি গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে এসেছে। এখানে প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজন মারা গেছে বা আহত হয়েছে। গাজার ২৪ লক্ষ অধিবাসীদের অধিকাংশই বাস্তুচ্যুত।

একটি আঘাত দ্বারা হামলার পরিণতির এই ভয়াবহ বাস্তবতা এএফপি-এর একটি ভিডিওতে চিত্রিত হয়েছে। এতে পুরুষরা বোমা বিধ্বস্ত গাজা সিটির একটি ভবন থেকে যা কিছু বাঁচানো সম্ভব তা উদ্ধার করছে এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত গলিতে একটি আবৃত লাশ নিয়ে যেতে দেখা যায় ।

অদূরেই বসবাসকারী মাহের আল-মুগাইর শুক্রবারের হামলার বর্ণনা দিয়ে বলেন: "আমরা একটি ড্রোন থেকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার মতন শব্দ শুনি, তারপরে একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান থেকে আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র আসার শব্দ পাই।"

তিনি এএফপিটিভিকে বলেন, "তাই আমরা সেখানে খুঁজে দেখি এবং নারী ও শিশুদের টুকরো টুকরো দেহ খুঁজে পাই। এই শিশু ও নারীরা কী ভুল করেছে? তারা প্রতিরক্ষাহীন মানুষ, নিছকই বেসামরিক মানুষ।"

গাজার জরুরি পরিষেবা জানায়, শনিবার একই শহরে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান শেখ রাদওয়ান পাড়ায় মানা পরিবারের বাড়িতে বোমা হামলায় পাঁচজন নিহত এবং সাতজন আহত হয়েছে।

অন্যত্র, আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের চিকিত্সকরা বলেন, মধ্য গাজার বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি রকেট হামলায় ছয়জন নিহত এবং বাকীরা আহত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন সেখানে বন্দুক যুদ্ধ সংঘঠিত হয়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলে, তারা গত দিনে দেইর আল-বালাহ এবং বুরেজে "কয়েক ডজন সন্ত্রাসী সেল এবং অবকাঠামোতে" আক্রমণ করেছে। রাফাতেও সেনারা অভিযান চালাচ্ছে।

রাজনৈতিক পরিণতি

ইসরায়েল ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আদালত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে এবং বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

জাতিসংঘে ইসরায়েলের দূত, গিলাদ এরদান শুক্রবার বলেন, তিনি "বিরক্ত" যে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধের সময় শিশুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া একটি দেশ হিসেবে জাতিসংঘের আসন্ন তালিকায় থাকবে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আগামী মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ভাষণ দিবেন। তিনিও তার ডানপন্থী সরকারের কাছ থেকে চাপের মুখে পড়েছেন।

ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীপরিষদ দপ্তরের সদস্য বেনি গ্যান্টজ শনিবারের জন্য একটি সংবাদ সম্মেলন ঘোষণা করেন। তিনি গত মাসে নেতানিয়াহুকে গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য এই সময়সীমা দিয়েছিলেন।

গ্যান্টজ, একজন মধ্যপন্থী প্রাক্তন সামরিক প্রধান, যুদ্ধ মন্ত্রীপরিষদ দপ্তরে যোগদানের আগে নেতানিয়াহুর অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ইসরায়েলি মিডিয়া অনুমান করে যে , তিনি সম্ভবত পদত্যাগ করার হুমকি বাস্তবায়িত করতে পারেন।

অবশ্য, এই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেতানিয়াহু সরকারের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে না। নেতানিয়াহু সরকার তার ডানপন্থী লিকুদের সাথে ডানপন্থী চরমপন্থা এবং অতি-গোঁড়া ইহুদি দলের একটি জোট।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি নতুন রোড ম্যাপ প্রস্তাব করার পর নভেম্বরে এক সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতির পর সংঘাতটিতে প্রথম যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতা করার সর্বসাম্প্রতিক প্রচেষ্টা শুরুর এক সপ্তাহ পরে স্থবির হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।

নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যুদ্ধ শেষ করার জন্য চাপের মুখে বাইডেন বলেন, তিনি ছয় সপ্তাহের জন্য লড়াই বন্ধ করার জন্য পরিকল্পনা করেন। আর ইতোমধ্যেই ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দীদের বিনিময়ের জিম্মি মুক্তির ও প্রস্তাব দেয়া হয়।

এই পরিকল্পনায় গাজায় মানবিক সহায়তা বিতরণ জোরদার করারও কথা রয়েছে।

বিশ্ব শক্তির জি -সেভেন গ্রুপ এবং আরব রাষ্ট্রগুলি এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে। সাথে ১৬ জন বিশ্বনেতা হামাসকে চুক্তিটি মেনে নেওয়ার জন্য বাইডেনের আহ্বানে যোগ দিয়েছেন।

হামাস এখনও বাইডেনের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। ইসরায়েল আলোচনার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছে তবে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীটিকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছে।

প্রধান মতবিরোধের বিষয়গুলির মধ্যে হামাসের একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলের পূর্ণ প্রত্যাহারের উপর জোর দেওয়ার দাবি রয়েছে, যেই দাবিগুলো ইসরায়েল প্রত্যাখ্যান করেছে।

একটি নতুন কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে, সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তার অষ্টম মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরায়েল এবং প্রধান আঞ্চলিক অংশীদার মিশর, জর্ডান এবং কাতার সফরে যাচ্ছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই শীর্ষ কূটনীতিক "হামাসকে দেওয়া প্রস্তাবটি গ্রহণ করার গুরুত্বের উপর জোর দিবেন" যাতে "ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়েরই উপকার হবে।"