বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানের সম্পদ দেখভালে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দিয়েছে আদালত

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক প্রধান (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। ফাইল ছবি।

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানের জব্দ করা স্থাবর সম্পদ দেখভালে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দিয়েছে আদালত।

বৃহস্পতিবার (৬ জুন) ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন।

সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুদকের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।

তিনি বলেন, “বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানের ক্রোক করা স্থাবর সম্পদ দেখভালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করার আবেদন করে দুদক। এ নিয়ে শুনানি শেষে দুদকের আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত।”

মাহমুদ হোসেন জানান, গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটের সার্বিক অবস্থা জানাতেও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানার পর এসব ফ্ল্যাট দেখভালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেবেন আদালত।

তিনি বলেন, “অবশ্য গোপালগঞ্জের ২৮টি পুকুর দেখভালে জেলার মৎস্য কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। কক্সবাজারের সম্পত্তি দেখভালে জেলা প্রশাসককে আদেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের পূর্ণাঙ্গ আদেশ পাওয়ার পর জানা যাবে, কোন সম্পত্তি কোন সংস্থাকে দেখভালের আদেশ দিয়েছেন আদালত।”

দুদক এখন পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী, তিন মেয়ে ও স্বজনের নামে ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি খুঁজে পেয়েছে।

বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে ৩৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) পাওয়া গেছে। নথিতে ওই সব ব্যাংক হিসাবে কত টাকা রয়েছে, তার উল্লেখ নেই।

বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাব এবং র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। তখন তিনি আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন।

বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ

বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জিশান মির্জা, বড় মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর এবং ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোম্পানির শেয়ার জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

২৬ মে (রবিবার) ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালতে মামলার অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম এ আবেদন করেন।

শুনানি শেষে আদালত আবেদন মঞ্জুর করেন।

এর আগে গত ২৩ মে বেনজীর আহমেদের সব ব্যাংক হিসাব ও কক্সবাজারের তার ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এরপর আরও সম্পদের খোঁজ পাওয়ায় তা জব্দের আবেদন করে দুদক।

একটি জাতীয় দৈনিকে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে তাঁর নানা অর্থ সম্পদের বিবরণ তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, বেনজীরের বিপুল সম্পদের মধ্যে রয়েছে- গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামে এক অভিজাত ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র।

এ ছাড়াও, তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে।

প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়, ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে বেনজীর আহমেদের দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার কাছের এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি রয়েছে। দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের রয়েছে দুই লাখ শেয়ার।

পূর্বাচলে রয়েছে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গা জুড়ে ডুপ্লেক্স, যার আনুমানিক মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা। একই এলাকায় আছে ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরও ১০ বিঘা জমি।

৩৪ বছর ৭ মাসের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন-ভাতা বাবদ মোট আয় ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকার মতো হওয়ার কথা।

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দেন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। পরে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে।

বেনজীর ও তাঁর পরিবারের জন্য দুদকের কমিটি

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২২ এপ্রিল দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান কমিশন সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন।

তিনি বলেন, ৩১ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ১ ও ২ এপ্রিল আরও কয়েকটি ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমে একই ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে দুদক সচিব বলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ এর বিধি নম্বর ৩ অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

দীর্ঘ ঈদের ছুটি শেষে ১৮ এপ্রিল প্রথম বৈঠকে সাবেক আইজিপির দুর্নীতির বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয় বলে জানান সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন।

সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তদন্ত শেষ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

এর আগে, পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। ২২ এপ্রিল (সোমবার) হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহউদ্দিন রিগ্যান। রিটে দুদক চেয়ারম্যান ও সচিবসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়।

টিআইবি

সংবাদপত্রে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পদের যে খতিয়ান প্রকাশিত হয়েছে, সেটা তাঁর জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে খুবই অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ আহরণ বাংলাদেশে এখন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এই যে সাবেক আইজিপির বিশাল সম্পদের খতিয়ান প্রকাশিত হয়েছে, তা হতবাক করার বিষয়।”

“রিপোর্টে সম্পদের যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেটিকে নির্ভরযোগ্য বলতে হবে ।” তাদের কাছে (পত্রিকার) লিখিত প্রমাণ আছে বলেও মনে করেন তিনি।

সিঙ্গাপুরে বেনজীর

বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ৩১ মে (শুক্রবার) ও ১ জুন (শনিবার) সংবাদ প্রকাশ করে যে, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ৪ মে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন।

৪ মে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেছেন এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর গেছেন, ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ঢাকার সংবাদ মাধ্যমগুলো।

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও তিন মেয়ের স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে এ পাঁচজনের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে তাঁদের নামে থাকা শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশও দেওয়া হয়। চলমান এই পরিস্থিতি তৈরির আগেই ৪ মে সপরিবারে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন অবসরে যাওয়া পুলিশের এই কর্মকর্তা।

বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, ৪ মে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে তিন মেয়ে, স্ত্রীসহ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যান তিনি। স্ত্রী জীশান মির্জার চিকিৎসাজনিত কারণে তাঁরা সে দেশেই অবস্থান করছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য

এদিকে ১ জুন (শনিবার) ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে সরকার নিশ্চিত নয়।

“তার দেশত্যাগের বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনী নেবে না। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীই বেনজীর আহমেদের বিচার হবে;” আরও বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, র‌্যাব ও বেনজীর আহমেদ

২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দফতর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়।

ওই কর্মকর্তারা হলেন র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, র‍্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খান। তাঁদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।

এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র‍্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত।

বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‍্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র‍্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছেন বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।