দশ বছর আগে ঢাকার শের-এ-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শ্রী লঙ্কা ভিরাট কোহলির ভারতকে হারিয়ে প্রথম বার টি২০ বিশ্বকাপ জয় করে। তার পরের তিনটি বিশ্বকাপে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে না পারলেও, শ্রী লঙ্কানদের সামনে দ্বিতীয়বার টি২০ শিরোপা জয়ের সুযোগ আবার এসেছে, এবং শুক্রবার ৭ জুন তাদের প্রতিপক্ষ হবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ এবং শ্রী লঙ্কা যে গ্রুপে আছে, গ্রুপ ডি, সেখান থেকে বের হয়ে সুপার ৮ পর্বে পৌঁছানর জন্য ফেভারিট নিঃসন্দেহে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রোটিয়াস নামে পরিচিত আফ্রিকান দল ইতোমধ্যে তাদের ক্রিকেট ‘পাওয়ার’ প্রদর্শন করেছে – সোমবার (৩ জুন) তারা শ্রী লঙ্কাকে ৬ উইকেটে উড়িয়ে দেয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে শ্রী লঙ্কার পারফরম্যান্স আসলেই দলের গুণগত মানের প্রতিফলন, নাকি অন্যান্য বিষয় এখানে প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
যেমন, ইএসপিএন-ক্রিকইনফোকে শ্রী লঙ্কার কর্মকর্তারা জানিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে খেলার আগে ফ্লোরিডা থেকে নিউ ইয়র্ক আসার পথে শ্রী লঙ্কা টিমকে ৮ ঘণ্টা মায়ামি এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। নিউ ইয়র্কে হাতে এক দিন ছিল কিন্তু সেদিন প্র্যাকটিস না করে তারা বিশ্রাম নেয় এবং পরের দিন ম্যাচের জন্য ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠতে হয়, কারণ তাদের হোটেল স্টেডিয়াম থেকে বাসে প্রায় দু’ঘণ্টা দূরে ছিল।
নিউ ইয়র্কের উইকেট নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নাসাউ কাউন্টি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পিচের পেস এবং বাউন্স-এর কারণে শ্রী লঙ্কান ব্যাটাররা প্রোটিয়াস বোলারদের সামলাতে পারেনি, এবং ৭৭ রানে সবাই আউট হয়ে যান। সেটা তাদের ব্যাটারদের মানসিক অপ্রস্তুতির কারণে হতে পারে। তবে এই মাঠেই ৯ জুন পাকিস্তান ও ভারত মুখোমুখি হবে, এবং উইকেট যদি মানসম্পন্ন না হয় তাহলে সমালচনার ঝড় উঠবে।
ব্যাটিং-বান্ধব ডালাস
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলার আগে তারা একদিন প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে এবং ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামের উইকেট ব্যাটিং-এর জন্য ভাল বলেই মনে হচ্ছে। উদ্বোধনী ম্যাচে গত রবিবার (১ জুন) স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র এই মাঠে কানাডার ১৯৪ রান তাড়া করে ২.২ ওভার বাকি থাকতেই ম্যাচ ৭ উইকেটে জিতে নেয়।
তবে যে শ্রী লঙ্কা ২০১৪ সালে ঢাকার ক্রিকেট-প্রেমীদের মন জয় করেছিল, সেই টিমে ছিল কুমার সাঙ্গাকারা আর মাহেলা জায়াওয়ারদেনের মত কিংবদন্তী ক্রিকেটার।
যুক্তরাষ্ট্র আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে যে শ্রী লঙ্কা খেলবে, সেই দলে কোন কিংবদন্তী না থাকলেও, আছে অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের মিশ্রণ।
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস, যিনি ২০১৪ দলের অংশ ছিলেন এবং ৬টি টি২০ বিশ্ব কাপে খেলেছেন, তিনিও আছেন এই টিমে।
আরও আছেন শ্রী লঙ্কার সীমিত ওভার (ওডিআই) টিমের অধিনায়ক কুসাল মেন্ডিস, বর্তমান টেস্ট ক্যাপ্টেন ধানানজায়া ডি সিল্ভা এবং প্রাক্তন ওডিআই অধিনায়ক দাসুন শানাকা।
এই বিশ্বকাপ দলের কেন্দ্রে আছেন টিম ক্যাপ্টেন ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, একজন লেগ-ব্রেক বোলার যিনি ৬৬টি আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচে ১০৬ উইকেট নিয়েছেন। ব্যাটিং-এ এখনো হাজার রানে পৌঁছাতে না পারলেও, আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচে তাঁর দুটি অর্ধ-শতক আছে এবং তাঁর ১৩০ স্ট্রাইক রেট যে কোনও টিমের জন্য হবে আশীর্বাদ।
অল-রাউন্ডারের ছড়াছড়ি
হাসারাঙ্গাই একমাত্র অল-রাউন্ডার না।
দুনিথ ওয়েলেলাগে, ধানানজায়া ডি সিল্ভা এবং কামিন্দু মেন্ডিস অফ-স্পিন বোলার যারা ব্যাট হাতে মন্দ না। পেস বোলারদের মধ্যে ম্যাথিউস এবং শানাকাকে অল-রাউন্ডার হিসেবেই দেখা হয়।
অনেকের দৃষ্টি থাকবে দুশমান্থা চামিরার উপর। এই ডান-হাতি পেস বোলার সম্প্রতি কলকাতা নাইট রাইডারস-এর হয়ে খেলে ইন্ডিয়ান প্রেমিয়ার লীগ (আইপিএল) শিরোপা জয় করেছেন।
অর্থাৎ, শ্রী লঙ্কা টি২০ ফরম্যাটের জন্য একটি ‘আদর্শ দল’ বাছাই করেছে, যেখানে সবার কাছ থেকেই ব্যাটিং এবং বোলিং-এ কিছু আশা করা যেতে পারে।
শ্রী লঙ্কার বিপরীতে বাংলাদেশ টিম যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই দলেও আছে অভিজ্ঞতা এবং তরুণ প্রতিভা।
অভিজ্ঞতার শীর্ষে আছেন সাকিব আল-হাসান, যিনি ক্রিকেটের যে কোন ফরম্যাটে একজন বিশ্বমানের অল-রাউন্ডার। টি২০ ফরম্যাটে খেলেছেন ১২২টি ম্যাচ।
প্রায় আড়াই হাজার রান এবং ১৪৬ উইকেট নিয়ে আল-হাসান সর্বকালের টি২০ র্যাঙ্কিং-এর তিন নম্বরে আছেন – তাঁর উপরে শুধু পাকিস্তানের শাহিদ আফ্রিদি এবং শীর্ষে অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়াটসন।
তবে তিনি শুধু যে ব্যাটে-বলে বাংলাদেশের জন্য মূল্যবান হবেন, তাই না। অধিনায়ক নাজমুল হাসান শান্তর জন্য সাকিব আল-হাসান বড় পরামর্শদাতা হতে পারেন।
আকর্ষণীয় ব্যাটিং লাইন-আপ
খাতে-কলমে, বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন-আপ বেশ আকর্ষণীয় এবং ডালাসের ব্যাটিং-বান্ধব উইকেটে তাদের বড় মাপের স্কোর গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাকিব আল-হাসান ছাড়াও, দ্রুত ইনিংস গড়ার জন্য বাংলাদেশ লিটন দাস এবং মাহমুদউল্লাহ’র স্ট্রোক-প্লে উপর নির্ভর করবে। দু’জনই অভিজ্ঞ প্লেয়ার, এবং তাঁরা মনোযোগ ধরে রাখতে পারলে প্রতিপক্ষর বোলিংকে ছিন্ন-ভিন্ন করার ক্ষমতা রাখেন।
সম্প্রতি (১ জুন) নিউ ইয়র্কে ভারতের সাথে প্রস্তুতি ম্যাচে দেখা গেল বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটিং-এর দুর্দশা, যেখানে অধিনায়ক শান্ত এবং উদ্বোধনী ব্যাটার সরকারের ব্যর্থতায় গোটা টিমের অবস্থার প্রতিফলন দেখা যায়। শান্তর উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে এবং তিনি উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব না দিলে টিমের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সমর্থকরা লিটন দাসের কাছ থেকে আরও অনেক বেশি আশা করবে – বিশেষ করে যাদের মনে আছে ২০১৯ সালের আইসিসি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের টনটন কাউন্টি মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাঁর ৬৯ বলে অপরাজিত ৯৪। সেরকম বোলিং- বিধ্বংসী ব্যাটিং খুব কমই দেখা যায় বাংলাদেশের কোন প্লেয়ারের কাছ থেকে।
বাংলাদেশের ব্যাটিং উদ্বোধনী জুটির তানজিদ হাসানের প্রতিভা নিয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা না। হাসান মাত্র ৭টি টি২০ ম্যাচে ৪৭.৪০ গড়ে ২৩৭ রান করেছেন। তাঁর ১২৬ স্ট্রাইক রেট ক্যারিয়ারের শুরুতে বেশ ভাল।
ফিজের এক দিন
টি২০ ব্যাটারদের খেলা হলেও বোলাররা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন, বিশেষ করে আপনার নাম যদি মুস্তাফিজুর রহমান হয়। ‘ফিজ’ নামে পরিচিত মুস্তাফিজুর সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র বোলার যার বিশ্বমানের প্লেয়ার হবার প্রতিভা ছিল এবং এখনো আছে।
প্রায় ১০০ টি২০ ম্যাচের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বাঁ-হাতি এই পেস বোলারের গতি হয়তো জাস্প্রিত বুম্রাহ বা শাহিন শাহ আফ্রিদি বা জফ্রি আরচারের মত না। কিন্তু তিনি সেই ঘাটতি তার পেস এবং মুভমেন্টে বৈচিত্র্য দিয়ে পুষিয়ে নেন। ভাল দিনে ‘ফিজ’ রোহিত শর্মা বা ভিরাট কোহলির মত ব্যাটারের জন্যও দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠতে পারেন।
বাংলাদেশের বোলিং ডিপার্টমেন্টে কিছুটা বৈচিত্র্য আছে যা এই টুর্নামেন্টে তাদের সুবিধা এনে দিতে পারে। সরকারের অফ-স্পিন আর মাহমুদউল্লাহ’র স্লো মিডিয়াম ক্যাপ্টেনের জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার।
মেহদি হাসানকে অল-রাউন্ডার বলা হয়। তিনি ৪৮ ম্যাচে ২৮ টি উইকেট নিয়েছেন, তিনি একজন নির্ভরযোগ্য স্পিনার। ব্যাটিং-এ তিনি ৩১৭ রান করেছেন ১৩.২ গড়ে। তাঁর কোন ৫০-এর কোন স্কোর না থাকলেও, তিনি ইনিংসের শেষের দিকে নেমে দ্রুত ১৫-২৫ রান করার সামর্থ্য রাখেন।
টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের রেকর্ড মোটেই ভাল না। অন্যদিকে, শ্রী লঙ্কা প্রথম পাঁচটি বিশ্বকাপের তিনটিতেই ফাইনালে পৌঁছায়। কিন্তু ২০১৪ সালের পর তিনটি বিশ্বকাপে তারা নক-আউট পরবেই যেতে পারে নাই।
যুক্তরাষ্ট্র আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে বাংলাদেশ যেমন এই ফরম্যাটে নিজের অবস্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে, তেমনি শ্রী লঙ্কা এই টুর্নামেন্ট তাদের ‘হারানো গৌরব’ পুনরুদ্ধার করার আশা রাখবে।