বাংলাদেশে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে

প্রতীকী ছবি

জমি স্বল্পতা, উচ্চ শুল্ক, অপ্রতুল সঞ্চালন ব্যবস্থাসহ নানা কারণে দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোতে খুব একটা অগ্রগতি নেই। গত ১৫ বছরে সরকার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে যুক্ত করতে পেরেছে।

২০১৭ সাল থেকে ৫১৬ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে; যেখানে দেশের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ২৫,৯০৩ হাজার মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ পরিকল্পনা পরিদপ্তর-বিউবো তথ্যমতে, বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়া বিদ্যুতের মধ্যে সব মিলিয়ে মোট বিদ্যুতের মাত্র ৩ শতাংশ আসে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ থেকে।

এর মধ্যে ১১ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসে ৫১৯ মেগাওয়াট, অর্থাৎ ২ শতাংশ। আর রাঙামাটি কাপ্তাই হাইড্রো পাওয়ার প্লান্ট থেকে ২৩০ মেগাওয়াট আসে, অর্থাৎ ১ শতাংশ; যা তৎকালীন পাকিস্তান আমলে তৈরি হয়েছিল।

অবশ্য গত এক বছরে অনেকগুলো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন পেয়েছে, কিছু পরিকল্পনাধীন আছে। যেগুলোর কাজ শেষ হতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক বছর।

যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে, সেগুলো শেষ হলে নবায়নযোগ্য খাত থেকে মোট উৎপাদন সক্ষমতা হবে ২০২৭ সালের মধ্যে ৪৮৫০ হাজার মেগাওয়াট, যা সরকারের ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ (১০২০০ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাত থেকে আসার উৎপাদন সক্ষমতার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০ শতাংশের চেয়েও কম।

যদিও এই সময়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। যেটাকে সরকার নিউক্লিয়ার এনার্জি বলছে।

বিউবো তথ্যমতে, ২০২৭ সালে সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা হবে ৩৪ হাজার মেগাওয়াট। আর পাওয়ার মাস্টারপ্ল্যানের তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালে সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা হবে ৩৫ হাজার ৪ মেগাওয়াট।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১১তম। সেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে প্রথম চীন। এরপর যথাক্রমে আমেরিকা, ব্রাজিল, ভারত ও জার্মানি।

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বারবার ব্যর্থতা

রিনিউএবল এনার্জি পলিসি প্ল্যান (আরইপি-২০০৮) অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশ ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সেখানে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৪.৫৯ শতাংশ। সেখানেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫.৪১ শতাংশ পিছিয়ে আছে।

আবার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনও অগ্রগতি নেই। মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান (এমসিপিপি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ক্লিন এনার্জি থেকে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানী প্রকল্প

জমির দুষ্প্রাপ্যতাও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বড় চ্যালেঞ্জ: জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল

পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন তৈরি করাটাও যথেষ্ট খরচের বিষয়। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই ডলারে বিনিয়োগ করতে হয়। যেহেতু আমরা বেশির ভাগ জিনিসপত্র বাইরে থেকে আমদানি করি, যেটা এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আইইইএফের জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমাদের দুই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র করার ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের অন্তরায় বা সমস্যা আছে। ইউটিলিটি-স্কেল বা বড় পরিসরে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা জমি পাওয়া। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় আমাদের দেশে জমির দাম বেশি, দুষ্প্রাপ্যতাও আছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।”

তিনি আরও বলেন, “পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন তৈরি করাটাও যথেষ্ট খরচের বিষয়। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই ডলারে বিনিয়োগ করতে হয়। যেহেতু আমরা বেশির ভাগ জিনিসপত্র বাইরে থেকে আমদানি করি, যেটা এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

“বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অনেক সময় একক কোনও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না” – বলে উল্লেখ করেন শফিকুল আলম।

তিনি বলেন, “ফলে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের ইক্যুইটি ম্যানেজ করতে সমস্যা দেখা দেয়।”

“আর ছোট পরিসরে ছাদভিত্তিক যে সৌর প্যানেল, তা স্থাপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা ঋণ প্রকল্প আছে” – বলে যোগ করেন এই জ্বালানি বিশ্লেষক।

শফিকুল আলম বলেন, “কিন্তু সেখান থেকে ঋণ পাওয়াটা অনেক সময়ই কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে যেহেতু আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট রয়েছে, সৌর প্যানেলে যন্ত্রপাতি আমদানি করতেও সমস্যা হচ্ছে। আবার এখানে উচ্চ শুল্ক আছে, যার কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে অনেক ব্যয়বহুল হয়।”

যানবাহনের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে আমাদের আরও অনেক সময় লাগবে বলে মনে করেন শফিকুল আলম। তিনি আরও বলেন, “কারণ এখানে আমাদের অবকাঠামোগত সংকট রয়েছে। আমরা যদি বৈদ্যুতিক যানবাহন চালু করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রচুর চার্জিং স্টেশন লাগবে, সেগুলোর অগ্রগতিও কম।”

“পরিবেশবান্ধব এসব যানবাহনেও প্রচুর শুল্ক আছে, যা না কমালে এগুলো জনপ্রিয় করা সম্ভব হবে না” – বলে উল্লেখ করেন শফিকুল আলম।

সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প

সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনে উচ্চহারের ভ্যাট-ট্যাক্স বড় সমস্যা: শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী

আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রাটাই এখনও ঠিকঠাকভাবে নির্ধারণ করতে পারিনি। কোনো কোনো ডকুমেন্টে এটা ১০ শতাংশ বলা আছে, আবার কোথাও ৩০ শতাংশ। আমরা টার্গেট করছি ২০৫০ সালের, এগুলো সমন্বয় করতে হবে। আবার বড় বড় টার্গেটের চেয়ে ছোট করে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে, যেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের ক্ষেত্রে উচ্চহারের ভ্যাট-ট্যাক্স একটা বড় সমস্যা। সোলার প্যানেল ইনভার্টার, ব্যাটারিসহ যে কোনো যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা আছে, যেটা জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষেত্রে অনেকাংশেই শিথিল করা। সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রেও ট্যাক্স মওকুফ করা উচিত।”

“আমাদের ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের একটা বড় সুযোগ আছে” – বলে যোগ করেন শাহরিয়ার।

তিনি বলেন, “বিশেষ করে শিল্পকারখানার ছাদ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কর্তৃপক্ষ এতে খুব একটা আগ্রহী না।”

“আমাদের নীতিনির্ধারণী জায়গাতেও অনেকগুলো সমন্বয়ের অভাব রয়েছে” – বলে উল্লেখ করেন শাহরিয়ার। তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রাটাই এখনও ঠিকঠাকভাবে নির্ধারণ করতে পারিনি। কোনো কোনো ডকুমেন্টে এটা ১০ শতাংশ বলা আছে, আবার কোথাও ৩০ শতাংশ। আমরা টার্গেট করছি ২০৫০ সালের, এগুলো সমন্বয় করতে হবে। আবার বড় বড় টার্গেটের চেয়ে ছোট করে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে, যেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব।”

শাহরিয়ার বলেন, “সোলারের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে প্রচুর জায়গা লাগে। এখানে জমি পাওয়াটা একটু সমস্যা। এ ক্ষেত্রে সরকার একটা সহযোগিতা করতে পারে। সেটা হলো– অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা সোলার জোন করে দিতে পারে। কারণ, প্রাইভেট সেক্টরে জায়গা পাওয়া খুব সমস্যা। তাহলে এটার গতি পাবে বা আমাদের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারব।”

“আরেকটা হচ্ছে, অনেক প্রকল্প অনুমোদন পায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্প হয় না। তার প্রধান দুটি বাধা হচ্ছে জমি পাওয়া ও ট্রান্সমিশন লাইন” – বলে যোগ করেন শাহরিয়ার।

তিনি আরও বলেন, “সোলার এনার্জিতে যেহেতু প্রচুর জায়গা লাগে, তাই এগুলো দূরবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চলে করতে হয়। কিন্তু ওই সমস্ত জায়গা দেখা যায় যে ট্রান্সমিশন লাইন নেই। থাকলেও অনেক দূরে। আবার লাইন করার জন্য যে টাওয়ার বসবে, তার জন্য তো জায়গা লাগবে, যেটা পাওয়াও অনেক সময় কষ্টদায়ক হয়ে যায়।”

এই শিক্ষক বলেন, “তাই আমরা এটা করতে হলে সরকারকে উদ্যোগ নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মতো সোলার জোন করতে হবে। সেই জায়গাগুলো সরকার লিজ দিতে পারে বেসরকারি খাতে অথবা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে।”

বাংলাদেশের একটি পোশাক শিল্প কারখানা

নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে না গেলে টিকতে পারবে না তৈরি পোশাক শিল্প: চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভ

সৌরবিদ্যুতে যেখানে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, সেখানে আইএমএফের প্রস্তাবনা অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে ১৬-১৭ টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য সেটা ১৯-২০ টাকা হবে। এভাবে ৪ গুণ বাড়তি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনে যদি তাকে পণ্য উৎপাদন করতে হয়, তাহলে অন্যান্য যে কোনো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারবে না।

চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম জাকির হোসেন খান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আমাদের ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ বা কমাতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, ধরুন একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র তিন বছর আগে অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে তারা নিজেরা বিনিয়োগ করেছে, ব্যাংক থেকে ধার করেছে। এখন হঠাৎ করে ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে গেছে। ডলার রেট বেড়ে গেছে। এর কারণে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “যখন একজন ব্যবসায়ী এর পেছনে বিনিয়োগ করেছে, তখন তার একটা ধারণা ছিল তাকে মোট কত বিনিয়োগ করতে হবে, কিন্তু সেটা অনেক বেড়ে গেছে। গত ১০ বছরে বিশ্বে যে হারে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিনিয়োগ খরচ কমেছে, বাংলাদেশে সেই হারে কমেনি।”

এতে করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প– বলে মনে করেন তিনি।

জাকির হোসেন বলেন, “সৌরবিদ্যুতে যেখানে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, সেখানে আইএমএফের প্রস্তাবনা অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে ১৬-১৭ টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য সেটা ১৯-২০ টাকা হবে। এভাবে ৪ গুণ বাড়তি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনে যদি তাকে পণ্য উৎপাদন করতে হয়, তাহলে অন্যান্য যে কোনো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারবে না।”

জলবায়ু অর্থ বিশ্লেষক জাকির হোসেন বলেন, “রপ্তানিকারক অঞ্চলে ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনে ওই অঞ্চল কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের দরকার কিন্তু সেটা তারা করছে না। নেট মিটারিং সিস্টেমের মাধ্যমে কারখানাগুলো চাইলে বাড়তি উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের কাছে বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাত্র ৩০ শতাংশ ছাদে যদি সোলার বসানো যায়, তাহলে প্রায় ৩৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।”

তিনি বলেন, “সৌরবিদ্যুতের উৎপাদনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম অঞ্চল সবচেয়ে উপযোগী। কারণ, দেশের সবচেয়ে বেশি খাসজমি সেখানে। সেখানে সহজে জোনিং করে দেওয়া যায়।”

একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র

পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে: পাওয়ার সেল

সৌরবিদ্যুতেরও একটা বড় সমস্যা হচ্ছে এটা আমরা শুধু দিনের বেলায় পাব

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত শুধু সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ আছে। বায়ুবিদ্যুতের ওই রকম কোনও সম্ভাবনা নেই। আমরা সোলারকেই ব্যবহার করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সৌরবিদ্যুৎ-ভিত্তিক সেচ পাম্প স্থাপনের কাজ চলছে।” “সৌরবিদ্যুতেরও একটা বড় সমস্যা হচ্ছে এটা আমরা শুধু দিনের বেলায় পাব” – বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, “এখন আমার এক জায়গায় যদি ১ হাজার মেগাওয়াটের একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকে, তাহলে সন্ধ্যায় এই পরিমাণ বিদ্যুৎ হঠাৎ করে নাই হয়ে যাবে। তখন সঞ্চালন লাইনে বড় ধরনের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। তাই গ্রিড স্ট্যাবিলিটির জন্য বিকল্প একটা ব্যবস্থা আমাদের রাখতে হবে অথবা ব্যাটারি স্টোরেজ ব্যবস্থা রাখতে হবে; যাতে দিনের আলো না থাকলেও সোলার থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।” সেক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা স্থাপনের খরচ এখনও অনেক বেশি বলে দাবি করেন মোহাম্মদ হোসাইন।

তিনি আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ ক্লিন এনার্জি থেকে উৎপাদন করা। এর মানে এই নয় যে শুধু সৌরবিদ্যুৎই আমরা ব্যবহার করব। এর মধ্যে নিউক্লিয়ার এনার্জি থাকবে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে, এগুলো থাকবে।”

শুল্কছাড় বা প্রণোদনার বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, “আমাদের পলিসিগুলো যথেষ্ট রিনিউএবল-বান্ধব। এর বাইরেও যেহেতু এগুলো পরিবেশবান্ধব বা কার্বন নিঃসরণ কম করে, তাই তাদের বাড়তি কী ধরনের সুবিধা দেওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। বিশেষ করে ইনভার্টার এবং ব্যাটারি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর জন্য ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়কেও আমরা এর মধ্যে যুক্ত করেছি।”

নেট মিটারিংয়ের সমস্যা সম্পর্কে তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। তারা ওইসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে কারও কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারে না। এই সমস্যাগুলোর সমাধানেও কাজ চলছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে এ বিষয়ে বৈঠক হয়েছে, আশা করি সমাধান পাওয়া যাবে।”

প্রতীকী ছবি

প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে জীবাশ্ম জ্বালানি: মোস্তাফিজুর রহমান

কয়লাভিত্তিক যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আছে, সেইগুলো খুব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়ুদূষণের বিষয়গুলো রোধ করা হবে বলেছিল সরকার। কিন্তু এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র যেখানে আছে, সেখানকার মানুষগুলো কী বলছে শুনে দেখেন, তারা কী পরিমাণ ভয়াবহতা মোকাবিলা করছে!

পরিবেশবিদরা বলছেন, বায়ুদূষণসহ অন্যান্য পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হলো জীবাশ্ম জ্বালানি। জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প শুধু বিদ্যুৎ খাতে নয়, পরিবহন খাতেও নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার ঘটাতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমাদের পরিবেশে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ যে দিন-দিন বাড়ছে তার অন্যতম প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি। আমাদের সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবে ভূমিকা রাখছে জীবাশ্ম জ্বালানির কণা।”

বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অনেকগুলো কারণ রয়েছে বলে উল্লেখ করে এই শিক্ষক বলেন, “এটার জন্য এককভাবে শুধু জীবাশ্ম জ্বালানি দায়ী করা ঠিক হবে না। তবে, জীবাশ্ম জ্বালানির কণার এতে ভূমিকা রয়েছে। আর বায়ুদূষণের কারণে কতজন লোক মারা যায়, তার সুনির্দিষ্ট গবেষণা নেই। তবে এর কারণে মানুষ যে বেশি রোগে ভুগছে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমি মনে করি, বায়ুদূষণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট গবেষণা হওয়ার প্রয়োজন।”

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, “আমাদের অন্যান্য বড়-বড় প্রকল্প নিয়ে সরকার যে ধরনের কথা বলেছিল, পরবর্তী সময়ে সেইগুলো আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, সবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “কারণ, কয়লাভিত্তিক যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আছে, সেইগুলো খুব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়ুদূষণের বিষয়গুলো রোধ করা হবে বলেছিল সরকার। কিন্তু এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র যেখানে আছে, সেখানকার মানুষগুলো কী বলছে শুনে দেখেন, তারা কী পরিমাণ ভয়াবহতা মোকাবিলা করছে! এখন রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নিয়েও বলা হচ্ছে, একদম নিউক্লিয়ার এনার্জি, কিছুই হবে না।”

পারমাণবিক যে বর্জ্য, তা ম্যানেজ করা এবং এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করার মতো যথেষ্ট সামর্থ্য এবং শক্তি লাগে, তার কিছু বাংলাদেশের নেই বলেও উল্লেখ করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

সরকারের পক্ষ থেকে ২০২০ সালে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেছিলেন, “যেহেতু আমাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই এবং জায়গা ছোট, সুতরাং প্লান্ট চালানোর ফলে যত গারবেজ আসবে, সব রাশান কর্তৃপক্ষ এ দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে তা ডিসপোজ করবে। এটা চুক্তিতে আছে।”