ভারতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের জয়, শক্তি বাড়লো কংগ্রেসেরও

বিজেপির সিনিয়র নেতাদের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তেলেগু দেশম পার্টির নেতা এন চন্দ্রবাবু নাইডু এবং জনতা দল (ইউনাইটেড) নেতা নীতীশ কুমার। ৫ জুন, ২০২৪। এপি।

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের সব ফল ঘোষণার শেষে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সর্বমোট ২৪০ আসন পেয়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের থেকে ১৪১ আসন বেশি পেয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস পেয়েছে ৯৯ আসন। তবে কংগ্রেসের ফল খুবই ভালো হয়েছে কারণ ২০১৯ সালে যেখানে কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৫২ আসন, সেখানে এবারে তারা পেয়েছে ৯৯ আসন – গতবারের তুলনায় যা ৪৭ আসন বেশি।

বিজেপির সমস্যা হল, গত দু’বারের (২০১৪, ২০১৯) মতো একক ভাবে সরকার তারা গঠন করতে পারবে না। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে প্রয়োজন লোকসভায় মোট ৫৪৩ আসনের অর্ধেকের থেকে একটি বেশি আসন, অর্থাৎ ২৭২। তাদের হাতে ৩২টি আসন কম রয়েছে, যে কারণে সরকার গঠন করতে তাদের বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (এনডিএ) অন্যান্য শরিকের সাহায্য নিতে হবে।

শরিকদের সাহায্য নিয়ে ভারতের অষ্টাদশ সরকার গঠনের লক্ষ্যে মঙ্গলবার রাত থেকেই দফায় দফায় বৈঠক শুরু হয়েছে দুই প্রধান দল অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের তেলেগু দেশম পার্টির (টিডিপি) প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের জনতা দল ইউনাইটেডের (জেডিইউ) সঙ্গে। জেডিইউ- এর নেতৃত্বে রয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার, যিনি গত বছরে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট গঠনের সময় ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে ছিলেন।

এই জোট গঠনের প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই সহজ হবে না বলে মনে করছেন বিজেপির নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিমবঙ্গের এক বিজেপি নেতা যিনি এই মুহূর্তে দিল্লিতে রয়েছেন তিনি টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, “চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতিশ কুমার দু’জনেই তাদের বিভিন্ন দাবি বিজেপির কাছে রেখেছেন। দুই রাজ্যই বিশেষ রাজ্যের তালিকায় থাকতে চাইছে বলে জানতে পেরেছি। যার অর্থ, তারা কিছু বিশেষ সুবিধা – বিশেষত বাড়তি অর্থ বরাদ্দ – কেন্দ্রের থেকে চাইছেন। এছাড়াও, তাঁরা কেন্দ্র সরকারের অধীনে কোন কোন মন্ত্রক নেবেন তা নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছে। তবে কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।” বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক স্তরে সব পক্ষই মুখ খুলতে নারাজ।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, রাহুল গান্ধী ও সনিয়া গান্ধী।(ফাইল ছবি)

জোটের চ্যালেঞ্জ

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩০৩টি আসন, যা এবারে কমে ২৪০এ দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে বিজেপির ভোটের হার জাতীয় স্তরে ১.২ কমে গিয়েছে; ৩৭.৭ থেকে হার কমে হয়েছে ৩৬.৫ শতাংশ। অন্যদিকে কংগ্রেসের ভোটের হার ১৯.৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ২১.২ শতাংশ – অর্থাৎ কংগ্রেসের ভোটের হার বেড়েছে ১.৬ শতাংশ। তবে মাত্র এক শতাংশ ভোটের হার কমার অর্থ বিজেপি তাদের প্রধান নির্বাচনী জনভিত্তি ধরে রাখতে পেরেছে।

টিডিপি এবং জেডিইউ-এর মতো যে দু’টি আঞ্চলিক দলের সমর্থনে বিজেপিকে এখন দল চালাতে হবে তারা পেয়েছে যথাক্রমে ১৬ এবং ১২ আসন। এছাড়াও, আরো একাধিক আঞ্চলিক দল বিজেপির সঙ্গে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে এদের নিয়েই চলতে হবে বিজেপিকে যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

“এর অন্যতম কারণ গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে এবং পরবর্তীতে গত ১০ বছর কেন্দ্রে সরকার চালানোর সময় নরেন্দ্র মোদী শরিকদের নিয়ে সরকার চালাননি। এর কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে যা নিয়ে তাকে চলতে হবে,” বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক শান্তনু চক্রবর্তী।

এই বাধ্যবাধকতা যে রয়েছে তা গত ১২ ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ ফল ঘোষণার পরেই চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতিশ কুমার তাদের দাবিদাওয়া পেশ করেছেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই ধরনের দাবি আগামী দিনে আসতেই থাকবে এবং তা নিয়েই বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-কে এগোতে হবে।

আঞ্চলিক দলের ফল

বিজেপি, কংগ্রেস, টিডিপি এবং জেডিইউ- এর বাইরে যে আঞ্চলিক দলগুলি ভালো ফল করেছে তার মধ্যে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি, তারা পেয়েছে ৩৭ আসন। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস – তারা তাদের আসন সংখ্যা ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৯ করতে পেরেছে। তামিলনাড়ুর দ্রাবিড়া মুনেত্রা কাঝাগম যারা পেয়েছে ২২ আসন, মহারাষ্ট্রের উদ্ভব ঠাকরে গোষ্ঠীর শিবসেনা পেয়েছে ৯ আসন এবং ওই রাজ্যেরই শরদ পাওয়ারের দল ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি পেয়েছে ৮ আসন। এনডিএ’র অপর দুই শরিক মহারাষ্ট্রেরই শিবসেনার সিন্দে গোষ্ঠী এবং বিহারের লোক জনশক্তি পার্টি পেয়েছে যথাক্রমে সাত এবং পাঁচ আসন। আম আদমি পার্টি পেয়েছে তিনটি আসন, বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল চার এবং ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগ তিন আসন।

দুই কমিউনিস্ট দল সিপিআই-মার্কসিস্ট এবং সিপিআই-লিবারেশন যথাক্রমে পেয়েছে চার এবং দু’টি আসন। আরো বেশ কিছু দল তিন বা তার কম সংখ্যক আসন পেয়েছে। এদের মধ্যে এনডিএ এবং ইন্ডিয়া জোট – দুই প্রধান ব্লকের বেশ কিছু সদস্য রয়েছে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়

পশ্চিমবঙ্গের চিত্র

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস মোট ৪২ আসনের মধ্যে ২৯ আসন পেয়েছে যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৯টি বেশি। তৃণমূলের ভোটের হার প্রায় আড়াই শতাংশ বেড়ে ৪৩.৩ থেকে পৌঁছেছে ৪৫.৭ শতাংশে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোটের হার ৪০.৭ থেকে নেমে হয়েছে ৩৮.৭। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোটের হার কমেছে ২ শতাংশ আর আসন সংখ্যা ১৮ থেকে নেমে গিয়েছে ১২তে।

গত কয়েক বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নানান দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। এই দুর্নীতির অভিযোগের কারণে সাধারণ মানুষ এবং ভোটাররা তৃণমূলের উপরে অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন বলে মনে করা হচ্ছিল। এর প্রতিফলন ঘটেছিল বুথ ফেরত জরিপেও, যেখানে সব সমীক্ষা সংস্থাই বিজেপিকে তৃণমূলের থেকে বেশ কিছু আসন বেশি দিয়েছিল।

কিন্তু সেই সব জল্পনা এবং সমীক্ষা ভেস্তে দিয়ে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে ভালো ভাবে পিছনে ফেলে দিয়েছে বিজেপিকে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে অমর্ত্য সেনের প্রতীচি ইনস্টিটিউটের মুখ্য জাতীয় গবেষক সাবির আহমেদ বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে যে অর্থ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন সেটা এই ফলের একটি কারণ।

“আমরা আমাদের গবেষণার সূত্রে দেখেছি এই অর্থ অনেকটাই মানুষের হাতে পৌঁছেছে। কিন্তু এই ধরনের প্রকল্পের নানান সমালোচনা আছে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে এই স্কিমগুলি সাধারণ মানুষকে প্রবল সুবিধা দেয়। চূড়ান্ত দারিদ্র্যকে সামান্য হলেও কমায়,” বলেন সাবির।

সাবিরের কথার অনুরণন শোনা যায় নদীয়া জেলার এক নার্সের কথায়। মঞ্জু বিশ্বাস নামে ৬০ বছরের ওই মহিলা জানান, তিনি দু’দিন আগে বাড়ি তৈরির জন্য রাজ্য সরকারের কাছ থেকে প্রায় এক লাখ টাকা পেয়েছেন।

“এছাড়াও, আমরা অন্যান্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা, পেয়েছি যার অন্যতম হলো বিধবা ভাতা। যা আমি বেশ কিছু বছর ধরে পাচ্ছি। তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার এটা আমার একটা কারণ,” বলেন মঞ্জু বিশ্বাস। মহিলাদের কাছে সরাসরি অর্থ পাঠানোর জন্য ‘লক্ষীর ভান্ডার’ নামে যে প্রকল্পটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার চালাচ্ছে তা তৃণমূলকে সাহায্য করেছে বলেও মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

এর পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসের আরো একটা ভয়ের জায়গা এবারে তৈরি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের সামান্য উত্থানের জেরে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোটের একাংশ সেদিকে চলে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান ভোট রয়েছে যার উপরে জেতা-হারা অনেকটাই নির্ভর করে।

এই প্রসঙ্গে গবেষক এবং সমাজ বিশ্লেষক সাবির আহমেদ বলছিলেন, “আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হচ্ছে যে মুসলমান সম্প্রদায়ের বড় অংশ এবারেও তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছেন। মুসলমান ভোট ভাগ হয়ে তার একাংশ বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোটের দিকে চলে যাবে বলে যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেটা বাস্তবে ঘটেনি বলেই মনে হচ্ছে। যদি ঘটতো তাহলে তৃণমূল এতো আসন পেত না। তবে সব বুথভিত্তিক পরিসংখ্যান হাতে আসার পরেই বিষয়টি আরো নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে।” সাবির আরো বলেন যে বুথ ফেরত জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এই নির্বাচনে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

বিজেপির র‍্যালী। (ফাইল ছবি)

“সব সমীক্ষা-সংস্থাই বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে এগিয়ে রেখেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে তারা সবাই ভুল প্রমাণিত হলো, যা তারা অতীতেও হয়েছে। সম্ভবত এর কারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এখন টাকা-পয়সা দিয়ে এই সমীক্ষা করাচ্ছে যার কোন ভিত্তি নেই। আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাড়াহুড়ো করে এই সমীক্ষা হচ্ছে যার ফলে তা মিলছে না,” বলেন সাবির।

তবে সমীক্ষা যাই বলুক মাঠ পর্যায় বিজেপির অবস্থা যে খুব একটা ভালো নয় সেটা গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে অনেকটাই বোঝা যাচ্ছিল বলেও মন্তব্য করেন সাবির।

“গবেষণার সূত্রে সারাক্ষণই আমাদের ঘোরাঘুরি করতে হয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে আমাদের সবারই মনে হচ্ছিল যে একটা প্রচার সর্বস্ব অভিযান চলছে, যার সঙ্গে বাস্তবের মিল বড় কম। সমস্ত পরিসংখ্যান বলছে যে ভারতে কর্মহীনতা বাড়ছে। ৪৩ শতাংশ কর্মহীন। বড় সংখ্যক মানুষের কোনো কাজ নেই, কাজ পাওয়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণের মধ্যেও তারা নেই। অথচ প্রচার বলছে যে মানুষ সন্তুষ্ট, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বড় সংখ্যক আসন পাবে। জাতীয় স্তরে একক ভাবে তারা সরকার গঠন করবে। নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচন চলাকালীন এই দাবিগুলিকে আমাদের ভিত্তিহীন বলে মনে হয়েছিল,” বলেন সাবির আহমেদ।

বিজেপির খারাপ পারফরমেন্সের আর একটা কারণ সম্ভবত দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। ফল ঘোষণার পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বলেন যে তাদের মতো বিরোধী দলের পিছনে সারাক্ষণ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। এতে মানুষ খুশি হননি, বলেন মমতা।

বুধবার সকালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রাজ্যস্তরে এক প্রভাবশালী নেতাও এই একই কথা বললেন এই প্রতিবেদককে।

“আমাদের নানান সাংগঠনিক সমস্যা রয়েছে, সব দলেরই থাকে। কিন্তু সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে খালি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের কোনঠাসা করার চেষ্টায় সাধারণ মানুষ যে খুশি হননি সেটা অতীতেও বোঝা গিয়েছিল, এবারেও গেল। আমি বলছি না তৃণমূলে দুর্নীতি নেই এবং তার তদন্ত করাও প্রয়োজন। কিন্তু সেটাই একমাত্র রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি হতে পারে না,” মন্তব্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজেপির ওই রাজ্য নেতার।