আগামী মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন: ঝুঁকির মুখে রয়েছে কোন বিষয়গুলি?

পূর্ব ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গে ইউরোপীয় সংসদের বাইরে ইউরোপীয় পতাকা উড়ছে, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ৪০ কোটি নাগরিক আগামী মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য বা এমইপি নির্বাচন করার জন্য ভোট দেবে। এটি অন্যতম বৃহত্তম বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক কর্মসূচি।

জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং কৃষকদের অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে অতি-ডানপন্থী দলগুলি আরও ক্ষমতা অর্জন করতে চাইছে। অপরদিকে, গাজা এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ ভোটারদের চিন্তা জুড়ে রয়েছে।

সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি হল ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন ইইউর সর্বাধিক দৃশ্যমান মুখ হিসেবে দায়িত্বে থাকবেন কিনা।

আসন্ন নির্বাচন এবং ঝুঁকিতে থাকা সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলি এখানে এক নজরে তুলে ধরা হল:

ভোট কবে?

২৭ সদস্যের এই জোট অর্থাত্ ইইউ’র নির্বাচন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। এই বছরটি ১৯৭৯ সালে প্রথম নির্বাচনের পর দশম সংসদ নির্বাচন এবং ব্রেক্সিটের পর প্রথমবারের মতো এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

ভোট ৬-৯ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রে ভোট কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে, প্রথম ফলাফলটি শুধুমাত্র ৯ জুন সন্ধ্যায় প্রকাশ করা হবে।

ভোটটি কিভাবে কাজ করে?

নেদারল্যান্ডসে কোন এক বৃহস্পতিবার নির্বাচন শুরু হয় এবং রবিবারে শেষ হয়। বেশিরভাগ দেশে রবিবারে তাদের নির্বাচন শুরু হয়। ভোট একটি একক ব্যালটে সরাসরি সর্বজনীন ভোটাধিকার দ্বারা সম্পন্ন করা হয়।

প্রতিটি দেশে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা দেশটির জনসংখ্যার আকারের উপর নির্ভর করে। এটি মাল্টা, লুক্সেমবার্গ এবং সাইপ্রাসের জন্য ছয় থেকে শুরু করে জার্মানির জন্য ৯৬ পর্যন্ত হতে পারে। ২০১৯ সালে ইউরোপীয়রা ৭৫১ জন আইন প্রণেতাকে নির্বাচিত করে। ২০২০ সালে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিদায়ের পর, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ৭০৫ এ নেমে আসে। ব্রিটিশ এমইপিদের দখলে থাকা ৭৩টি আসনের মধ্যে কিছু আসন অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলিতে পুনর্বন্টন করা হয়।

নির্বাচনের পর, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ১৫ জন অতিরিক্ত সদস্য থাকবেন। ফলে, মোট সদস্য সংখ্যা হবে ৭২০ ।বারোটি দেশ অতিরিক্ত এমইপি পাবে।

নির্বাচনগুলিতে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। কিন্তু একবার তারা নির্বাচিত হয়ে গেলে, বেশিরভাগ আইন প্রণেতারা তখন আন্ত-রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক দলগুলিতে যোগদান করে।

কারা ভোট দিচ্ছেন?

কিছু দেশে ১৮ বছরের কম বয়সীদের ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। বেলজিয়ামে, ২০২২ সালে গৃহীত একটি আইন ন্যূনতম ভোট দেওয়ার বয়স ১৬-তে নামিয়ে আনে৷ জার্মানি, মাল্টা এবং অস্ট্রিয়াও ১৬ বছর বয়সীদের ভোট দেওয়ার অনুমতি দিচ্ছে৷ গ্রিসে সর্বকনিষ্ঠ ভোটদানের বয়স হল ১৭ বছর৷ অন্য সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রে তা ১৮ বছর৷

নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্যও একটি ন্যূনতম বয়স প্রয়োজন - বেশিরভাগ দেশে ১৮ বছর থেকে শুরু, ইতালি এবং গ্রীসে তা ২৫ বছর।

ভোটারদের উপস্থিতি কিরকম?

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনগুলি সাধারণত বিপুল সংখ্যক ভোটার নিয়ে আসে না তবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে এ ব্যাপারে জনগণের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তবে, ১৯৭৯ সাল থেকে ক্রমাগত পতনের পরে ভোটারদের উপস্থিতি ৫০.৭ শতাংশে আসে যা ২০১৪ সালের নির্বাচনের তুলনায় ভোট দানের পরিমাণ আট পয়েন্ট বেশি ছিল। ১৯৭৯ সাল উপস্থিতি হার ৬২ শতাংশে আসে।

এপ্রিলে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ইউরোব্যারোমিটারের সর্বশেষ সংস্করণে আসন্ন নির্বাচনে আগ্রহের ঢেউ দেখা যায়। প্রায় ৭১ শতাংশ ইউরোপীয় বলেন তারা খুব সম্ভবত ভোট দিবেন।

প্রধান সমস্যাগুলো কি কি?

ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন নাগরিকদের মনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তাকে প্রধান প্রচারণার বিষয় হিসাবে দেখা হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে, ইইউ-এর প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তার ‍বিষয়টি নয়টি দেশে প্রথম উল্লেখ করা হয়।

অর্থনীতি, চাকরি, দারিদ্র্য এবং সামাজিক বর্জন, জনস্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ইউরোপের ভবিষ্যতও সমস্যা হিসাবে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে দেখা হচ্ছে।

ইইউ আইন প্রণেতারা কি করেন?

ইউরোপীয় সংসদই একমাত্র ইইউ প্রতিষ্ঠান যা ইউরোপীয় নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত হয়। এটি শক্তিশালী ইইউ-এর নির্বাহী শাখা, ইউরোপীয় কমিশনের আসল প্রতিপক্ষ।

সংসদটির আইন প্রণয়নের প্রস্তাব উত্থাপনের অধিকার নেই। কিন্তু এর ক্ষমতা আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এটি এখন বিস্তৃত বিষয়গুলির উপর দক্ষ। তারা জলবায়ু, ব্যাংকিং নিয়ম, কৃষি, মৎস্য, নিরাপত্তা বা ন্যায়বিচার সম্পর্কিত আইনের উপর ভোট প্রদানে সক্ষম। আইনসভাটি ইইউ-এর বাজেটেও ভোট দেয়, যা ইউরোপীয় নীতি বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনের কাছে সরবরাহকৃত ত্রাণ।

আইন প্রণেতারাও পরীক্ষণ ও ভারসাম্য রক্ষা ব্যবস্থার একটি মূল অংশ কারণ তাদের সমস্ত ইইউ কমিশনারদের মনোনয়ন অনুমোদন করতে হয়, যারা মন্ত্রীদের সমতুল্য। তারা পুরো কমিশনকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটের মাধ্যমে পদত্যাগ করতেও বাধ্য করতে পারে।

সংসদটির বর্তমান রূপ কী?

মধ্য-ডান ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি এপ্রিলে গত পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের সমাপ্তির সময়ে ৭০৫টির মধ্যে ১৭৬টি আসন নিয়ে, ইউরোপীয় সংসদটির বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।

ভন ডার লিয়েন ইপিপির অন্তর্গত এবং নির্বাচনের পরে ইইউ এর নির্বাহী শাখার নেতৃত্বে থাকার আশা করছেন।

দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রুপ হল এস এন্ড ডি, ইউরোপিয়ান সোশ্যালিস্টের মধ্য-বাম রাজনৈতিক দল। তারা বর্তমানে ১৩৯টি আসন ধারণ করে রেখেছে। উদারপন্থী এবং ইউরোপীয়-পন্থী রিনিউ রাজনৈতিক দলটির আসন সংখ্যা ১০২। তারা ৭২টি আসন ধারণ করা গ্রীণ এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির সমন্বয়ে গঠিত জোটটির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।

চরম ডানপন্থিরা আরও আসন লাভের প্রত্যাশা করছে

উগ্র ডানপন্থি দুটি দল, ইউরোপিয়ান কনজারভেটিভস অ্যান্ড রিফর্মিস্ট (ইসিআর) এবং আইডেন্টিটি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আইডি), ইউরোপীয় পার্লামেন্টে তৃতীয় এবং চতুর্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। দুটি দলের মধ্যে অনেক ভিন্নতা রয়েছে এবং তারা কতটা জোটবদ্ধ হতে পারে এবং ইইউ-এর এজেন্ডাকে প্রভাবিত করতে পারে, বিশেষ করে যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য ইইউ-এর প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করতে পারে তা স্পষ্ট নয়।

ইপিপি এবং এস এন্ড ডি স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। উদারপন্থী এবং গ্রীন উভয়ই আগের নির্বাচনে বড় বিজয় লাভ করা সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

নির্বাচনের পর কী হবে?

একবার প্রতিটি রাজনৈতিক দলের শক্তি যাচাই করা হয়ে গেলে, এমইপিরা ১৬-১৯ জুলাই পর্যন্ত প্রথম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে তাদের সভাপতি নির্বাচন করবে। তারপরে, সম্ভবত সেপ্টেম্বরে কয়েক সপ্তাহের আলোচনার পর, তারা সদস্য দেশগুলির প্রস্তাব অনুসরণ করে ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি মনোনীত করবে।

২০১৯ সালে, ভন ডার লিয়েন একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে (পক্ষে ৩৮৩ ভোট, ৩২৭টি বিপক্ষে, ২২টি অনুপস্থিতি) প্রথম নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাচিত হন। একক ভোটে তাদের অনুমোদনের আগে সংসদ সদস্যরাও ইউরোপীয় কমিশনারদের বক্তব্য শুনবেন।

ভন ডার লিয়েনের অন্য দলে নিয়োগ পাওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে। তবে, তাকে যথেষ্ট সংখ্যক নেতাদের সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে। তিনি নির্বাচনের ফলাফলের উপর নির্ভর করে কঠোর ডানপন্থিদের নিয়েও কাজ করতে পারেন বলে আভাস দিয়ে অনেক আইন প্রণেতার বিরাগভাজন হয়েছেন।