বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে চরমপন্থী দল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শিমুল ভূঁইয়ার সহযোগী সেকেন্ড ইন কমান্ড সাইফুল আলম মেম্বারকে গ্রেপ্তার করেছে যশোর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
মঙ্গলবার (২৮ মে) রাত সাড়ে ৯টার দিকে যশোর শহরের রায়পাড়া বাবলাতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আদর্শ মৎস্য হ্যাচারি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ তাঁর কাছ থেকে একটি ভারতীয় নম্বরসহ মোবাইল ফোন ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে।
যশোর ডিবি পুলিশের দাবি, সাইফুল মেম্বার বাবলাতলার ওই হ্যাচারিতে কয়েক দিন ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়ার সেকেন্ড ইন কমান্ড নামে পরিচিত।
গ্রেপ্তার সাইফুল আলম (৪৮) যশোরের অভয়নগর উপজেলার ৪ নম্বর পায়রা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দত্তগাতি গ্রামের আবুল কাশেম মোল্লার ছেলে।
যশোর ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মফিজুল ইসলাম বলেন, সাইফুল আলম মেম্বার চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়ার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত। যশোরের উদয় শঙ্কর হত্যা, রাকিব হত্যা, সুব্রত হত্যা মামলায় দুটিতে চার্জশিটভুক্ত অভিযুক্ত ও একটিতে পলাতক তিনি।
তিনি আরও বলেন, এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যার ঘটনায় অভিযান শুরু করলে সাইফুল আত্মগোপনে চলে যায়। এরপর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে যশোর শহরের রায়পাড়া বাবলাতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আদর্শ মৎস্য হ্যাচারি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মফিজুল ইসলাম বলেন, “কিছুদিন আগে সাইফুল আলম মেম্বার সাতক্ষীরা ও ভারত সীমান্ত এলাকায় ছিলেন। এ সময় ভারতীয় মোবাইল নম্বর দিয়ে শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যার ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততা আছে কি না সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তদন্তের স্বার্থে এর চেয়ে বেশি কিছু জানাতে চাননি ডিবির এই কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, চিকিৎসার জন্য ১১ মে ভারতে গিয়েছিলেন আনোয়ারুল আজীম। ১২ মে তার বন্ধু গোপালের বাড়িতে যান। ১৪ মে থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। আট দিন নিখোঁজ থাকার পর ২২ মে তাঁর খুন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
এ ঘটনায় ২২ মে একটি মামলা দাঁতের করা হয়।
এমপি আনোয়ারুল হত্যার উদ্দেশ্য এখনো জানা যায়নি: ডিএমপি কমিশনার
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বিদেশে অবস্থান করায় হত্যার মূল উদ্দেশ্য এখনো জানা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান।
বুধবার (২৯ মে) ডিএমপি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “এমপি আনার হত্যার পেছনে উদ্দেশ্য কী- এটি বাংলাদেশ পুলিশ বা ভারতীয় পুলিশ এখনো পর্যন্ত বের করতে করতে পারেনি।”
তবে পুলিশ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে বলেও জানান তিনি।
হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা গ্রেপ্তার হলেই উদ্দেশ্য জানা যাবে বলে জানান ডিএমপি কমিশনার।
হাবিবুর রহমান বলেন, এমপি আনোয়ারুল হত্যা মামলার প্রধান
অভিযুক্ত শাহীন এখন যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো বহিঃসমর্পণ চুক্তি নেই। তবে পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
ডিবি প্রধানের বক্তব্য
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার ষড়যন্ত্র দুই থেকে তিন মাস আগেই করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) ডিবি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তিনি।
তিনি বলেন, “ঢাকায় এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশের কঠোর নজরদারির কারণে অপরাধীরা তাঁকে কলকাতায় হত্যার পরিকল্পনা করে। মূল হোতা আখতারুজ্জামানের গুলশান ও বসুন্ধরার বাসায় এই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।”
হারুন-অর-রশিদ বলেন, “এমপিকে হত্যার পর লাশ খণ্ড খণ্ড করে হাড় থেকে মাংস আলাদা করে হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে দেয়। পরে, তারা একটি ব্যাগে করে কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে বের করে নেয়।” তবে দেহের অংশগুলো কোথায় ফেলা হয়েছে তা স্পষ্ট নয় বলে জানান তিনি।
হারুন-অর-রশিদ বলেন, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হত্যাকারীরা ২৫ এপ্রিল কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। ৩০ এপ্রিল হত্যার পরিকল্পনার মূল হোতা এবং আরও দুজন সেখানে যায়। এমপি আনোয়ারুল কলকাতায় যাবেন এ বিষয়ে তারা দুই মাস আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মূল হোতা, আরও দুই ব্যক্তি- জিহাদ বা জাহিদ ও সিয়ামকে ভাড়া এবং একটি গাড়ি ভাড়া করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি।
হাছান মাহমুদ জানান, ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে।
হাছান মাহমুদ আরও বলেন, “আমাদের মিশন পুরো বিষয়টি নিয়ে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। যেহেতু তদন্তাধীন বিষয়, তাই এ নিয়ে বেশি কিছু বলা সমীচীন নয়।”
এর আগে বুধবার (২২ মে) কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাছান মাহমুদ জানিয়েছিলেন, কলকাতার যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কলকাতা পুলিশ সেই ফ্ল্যাটে ঢুকে মরদেহ পায়নি।
তখন তিনি আরও বলেছিলেন, “আমরা আমাদের মিশনের মাধ্যমে খোঁজখবর রাখছি এবং মিশন থেকেও কলকাতা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তাধীন। তাই এর বেশি কিছু বলা সমীচীন নয়। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আরও যোগাযোগ রাখছে।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহ এখনো উদ্ধার করা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকেলে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি
তিনি বলেন, “আমরা এখনো লাশ উদ্ধার করতে পারিনি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সবকিছু উদ্ধার করতে না পারছি, ততক্ষণ আমরা আপনাদের কোনো তথ্য দিতে পারব না। আবারও বলছি, উভয় দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে কাজ করছে।”
তবে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদেরসহ প্রায় সবকিছু শনাক্ত করেছে বলে জানান তিনি।
আসাদুজ্জামান খান বলেন, “যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের শনাক্ত করার খুব কাছাকাছি আছি আমরা। শুধু ঘোষণা বাকি। দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা একমত হলেই ঘোষণা দেওয়া হবে।”
আসাদুজ্জামান খান বলেন, “আমাদের পুলিশ, গোয়েন্দা, ভারতীয় পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করছে। আমরা নিশ্চিত যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। যারা হত্যা করেছে তাদের থেকে শুনেছি, তবে আমরা এখনো লাশ উদ্ধার করতে পারিনি।”
এ হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় কেউ জড়িত কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ভারতীয় জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিইনি। তদন্ত চলছে। কারা জড়িত তা কিন্তু আমরা এখনো বলিনি। আমরা বলেছি যে, আমাদের একটি সাধারণ ধারণা আছে। সেই ধারণার ভিত্তিতেই আমরা কাজ করছি। এখন পর্যন্ত আমরা যে তথ্য পেয়েছি তা নিয়ে কাজ করছি।”
ওবায়দুল কাদের
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার বলেছেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের নিহত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতে কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না তা তদন্ত করে জানা যাবে।
তিনি আরও বলেন, “তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমি কিছু বলতে পারব না। আওয়ামী লীগে অপরাধীদের কোনো স্থান নেই।”
ওবায়দুল কাদের বলেন, জনপ্রিয়তার কারণে ঝিনাইদহ-৪ আসনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন আনোয়ারুল আজিম আনার। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে ভারতীয় গণমাধ্যম। তাঁর মৃত্যুর পর এখন সেসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “অন্যায়কারী দলের লোক হলেও শেখ হাসিনা তাকে রেহাই দেন না। অপরাধের ব্যাপারে তিনি জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলেন।”
এসব অভিযোগের সময় ও সুযোগ নিয়েও প্রশ্ন তুলে ওবায়দুল কাদের বলেন, “(তাঁর) মৃত্যুর আগে আমাদের দেশের সাংবাদিকদের কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ বিষয় কেন আসেনি?”