টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপঃ যেসব কারণে বাংলাদেশ সীমিত ফরম্যাটে সফল হতে পাড়ছে না

নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টি-২০ ম্যাচে বাংলাদেশের রিশাদ হোসেনের উইকেট পতন। ফাইল ফটোঃ ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের দেয়া টি২০ ক্রিকেটের র‍্যাঙ্কিং-এ বাংলাদেশের অবস্থান নয় নম্বরে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ আরও একটি টি২০ বিশ্বকাপ খেলতে মাঠে নামছে।

এখনও পর্যন্ত টি২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপের মঞ্চে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স যথেষ্ট হতাশাজনক।

সমর্থকদের কেউ কেউ মনে করেন ২০১৪, ২০২১ এর চেয়ে ২০০৭ সালেই বরং বাংলাদেশ দলের টি২০ ক্রিকেট খেলাটা দেখতে ভালো লাগতো।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তাদের টি২০ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল। সেই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেয়া ১৬৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করেছিল ২ ওভার হাতে রেখেই। মোহাম্মদ আশরাফুল করেছিলেন ২৭ বলে ৬১ রান।

সেই শুরু, সেই শেষ।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এরপর- ২০০৯, ২০১০, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬ ও ২০২১ সালে টানা ছয়টি টি২০ বিশ্বকাপের মূলপর্বে কোনও ম্যাচ জিততে পারেনি।

এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ টি২০ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ড, হংকং, স্কটল্যান্ডের মতো দলের সাথে হেরেছে, দ্বিপাক্ষিক টি২০ সিরিজে ম্যাচ হেরেছে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে।

এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ নানা ধরনের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে কিন্তু দলের পারফরম্যান্সে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে এখনও পর্যন্ত মোট ১১বার খেলে বাংলাদেশ ৬টিতে হেরেছে, ৫টিতে জয় পেয়েছে। ফটোঃ ৮ জুলাই, ২০২৩।

বাংলাদেশ ২০১৬ থেকে ২০২২, এই সময়ের মধ্যে ৩টি আসরে তিন পৃথক অধিনায়কের অধীনে খেলেছে, তাতে প্রেক্ষাপট খুব একটা বদলায়নি।

সাকিব আল হাসানের অধীনে ২০২২ সালে মূল পর্বে দুটি ম্যাচে জয় পেয়েছে বটে, তবে তা তুলনামূলক দুর্বল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এবং আরেক ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একদম শেষ বলে জিতেছিল।

নিজেদের তুলনায় কিছুটা শক্তিশালী দলের বিপক্ষে মাঠে নামলেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভিন্ন রূপ বেড়িয়ে আসে।
যেমন আফগানিস্তান, বড় দলের বিপক্ষে তাদের খুব একটা খেলা হয়না তাই র‍্যাঙ্কিং -এ দশ নম্বরে আছে দলটি। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেশ বেগ পেতে হয় আফগানিস্তানের বিপক্ষে।

বাংলাদেশ আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২০১৮ সালে একটি দ্বিপাক্ষিক টি২০ সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হেরেছিল।

মুস্তাফিজুর রহমান: এবারের আইপিএল-এ একমাত্র বাংলাদেশি। ফটোঃ ১৯ এপ্রিল, ২০২৪।

টি২০ ফরম্যাটের ক্রিকেটে আফগানিস্তানের বিপক্ষে এখনও পর্যন্ত মোট ১১বার খেলে বাংলাদেশ ৬টিতে হেরেছে, ৫টিতে জয় পেয়েছে।

বিভিন্ন দেশের লিগগুলোতে আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের উপস্থিতি দেখলে বোঝা যায় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কতোটা পিছিয়ে আছে এখনও।

এবারের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগেই বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে গিয়েছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান।

ওদিকে আফগানিস্তানের রশিদ খান বেশ কিছু ম্যাচে গুজরাট টাইটান্সের অধিনায়কত্বও করেছেন। তিনি ছাড়া মোহাম্মদ নবী, নূর আহমেদ, নাভিন উল হক, রহমানুল্লাহ গুরবাজ আইপিএলে নিয়মিত সুযোগ পান।

এদিক থেকে বাংলাদেশের সাকিব আর মুস্তাফিজ ছাড়া কেউই একবারের বেশি ডাক পাননি।

বাংলাদেশ আসলে টি২০ ক্রিকেটে ঠিক ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি। বেশ কিছু জায়গায় বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য দলের পার্থক্যটা খুব চোখে পড়ে।

তামিম ইকবাল: বাংলাদেশের সেরা ব্যাটার, কিন্তু টি-২০ ফরম্যাটে স্ট্রাইক রেট মাত্র ১১৭। (ফাইল ছবি)

আন্তর্জাতিক ব্যাটারদের সাথে পার্থক্য

বিশ্বের সেরা আন্তর্জাতিক টি২০ ব্যাটারদের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ব্যাটিং এর ফারাকটা অনেক বেশি।

টি২০ ক্রিকেটে পারফরম্যান্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক স্ট্রাইক রেট। বাংলাদেশের হয়ে যারা টি২০ ক্রিকেটে অন্তত ১০০০ রান করেছেন তাদের কারো স্ট্রাইক রেটই ১৩০ও স্পর্শ করেনি, লিটন দাশের সর্বোচ্চ ১২৮।

ওদিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শীর্ষ টি২০ ব্যাটার যারা অন্তত ৩০০০ রান তুলেছেন তাদের মধ্যে সর্বনিম্ন স্ট্রাইক রেট মোহাম্মদ রিজওয়ানের ১২৮।

এই পর্যায়ের অধিকাংশ ব্যাটারের স্ট্রাইক রেটই ১৩০ এর বেশি। জস বাটলারের ১৪৫, ডেভিড ওয়ার্নারের ১৪২, অ্যারন ফিঞ্চের ১৪২।

বাংলাদেশের সেরা ব্যাটার হিসেবে বিবেচিত তামিম ইকবালের স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৭, মুশফিকুর রহিম ব্যাট করেছেন ১১৫ স্ট্রাইক রেটে, ফিনিশার হিসেবে পরিচিত মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের স্ট্রাইক রেট ১১৯, বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের স্ট্রাইক রেট ১২২।

কারোরই স্ট্রাইক রেট আন্তর্জাতিক মানের নয়, যে কারণে বাংলাদেশ ঐ পর্যায়ে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেনি কখনো।

বাংলাদেশের তাসকিন আহমেদ: টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে শুধু সীমিত ওভারের খেলার কথা ভাবছেন? ফাইল ফটোঃ ৩১ মার্চ, ২০২২।

সব ক্রিকেটার সব ফরম্যাটে

ক্রিকেট বিশ্ব টি২০ ক্রিকেটের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করে ২০০৬ এর দিকে। তখন থেকেই ক্রিকেটের বিশ্বায়ন এবং ক্রিকেটে আরও বেশি বিজ্ঞাপনের অর্থ নিয়ে আসার লক্ষ্যে ছোট ফরম্যাটের দিকে বাড়তি নজর ছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসন ওয়ানডে এমনকি টেস্ট ক্রিকেটের দল থেকেও টি২০ ক্রিকেটের দলকে খুব বেশি আলাদা করে তুলতে পারেনি কখনো।

এখন কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায় তবে একটা লম্বা সময় ওয়ানডে, টেস্ট ও টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রায় একই দল খেলত।

এতে করে যেমন টি২০ ক্রিকেটে ভুল ক্রিকেটার খেলেছে, ঠিক তেমনি টেস্ট ক্রিকেটের দলে ঢুকে গেছেন টি২০ ক্রিকেটের ধাতে গড়া ক্রিকেটার, যেমন সৌম্য সরকার, মুস্তাফিজুর রহমান ও সাব্বির রহমান।

পরবর্তীতে মুস্তাফিজুর রহমান একরকম জোর করে টেস্ট ক্রিকেট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়েছেন, বোর্ডকে বুঝিয়েছেন তিনি ওয়ানডে ও টি২০ ক্রিকেটই বেশি খেলতে চান।
শোনা যাচ্ছে তাসকিন আহমেদও একই পথে হাঁটছেন।

নাজমুল হোসেন শান্ত ২০২৪ টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেন। ফাইল ফটোঃ ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩।

তামিম ইকবাল ২০২১ সালে টি২০ ক্রিকেট থেকে বিশ্রাম এবং ২০২২ সালে এই ফরম্যাটকে বিদায় বলেছিলেন। তার ব্যাটিং এর দক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন না থাকলেও তামিম ইকবালের ১১৭ স্ট্রাইক রেট নিয়ে বিস্তর সমালোচনা ছিল।

কিন্তু তামিম চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের টি২০ ওপেনার হয়েছিলেন নাইম শেখ, তার স্ট্রাইক রেট ১০৩, বর্তমান অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়া নাজমুল হোসেন শান্তর স্ট্রাইক রেট ১০৯।

অর্থাৎ বাংলাদেশ শুধুমাত্র পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্তই নিয়েছে।

বাংলাদেশের যেসব ক্রিকেটার টি২০ ক্রিকেটে বড় সম্পদ হয়ে উঠতে পারতেন তাদের কেউ কেউ হারিয়ে গেছেন কেউ হয়েছেন অবহেলিত।

যেমন আফতাব আহমেদ, ২০০৬-২০১০ সাল পর্যন্ত ১১টি টি২০ ম্যাচ খেলেই ১২৮ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে নজর কেড়েছিলেন, কিন্তু তিনি হুট করেই দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান।

ওই সময়ে জুনায়েদ সিদ্দিকি ৭ ম্যাচ ব্যাট করেছিলেন ১৪৭ স্ট্রাইক রেটে রান তুলেছিলেন ২০০ এর কাছাকাছি। তাকে আর বিবেচনাই করা হয়নি।

এরকম জিয়াউর রহমান, শুভাগত হোম, অনেক নাম এসেছিল, কেউ টি২০ ধাঁচের ক্রিকেটে টিকতে পারেননি, বরং বিসিবির খাতায় টিকমার্ক পেয়েছিল যারা কম স্ট্রাইক রেট হলেও ২০-৩০ রান করে মোটামুটি একটা পারফরম্যান্স দেখাতে পেরেছেন তারাই।

যেমন অধারাবাহিকতার কথা বলা হয় অনেক সময়, কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে অন্তত ১০০০ রান তোলা টি২০ ব্যাটারদের কারোরই গড় ২৫ও স্পর্শ করেনি কখনো।

সম্প্রতি আইপিএল ফাইনালে কলকাতা নাইট রাইডারস-এর রাহমানুল্লাহ গুরবাজ একটি শট খেলছেন। ফটোঃ ২৬ মে, ২০২৪।

মূলত টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশকে বোলারদের চেয়ে ব্যাটারদের ব্যর্থতাই বেশি ভুগিয়েছে।
যেমন ২০১৬ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ৩ বলে ২ রান নিতে পারেননি বাংলাদেশের দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার।

একই বিশ্বকাপে মুস্তাফিজের ৫ উইকেটে নিউজিল্যান্ডকে ১৫০ এর নিচে বেঁধে ফেলার পরে বাংলাদেশের ব্যাটাররা ৯০ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশ ২০১০ সালেও অস্ট্রেলিয়াকে ১৪১ রানের মধ্যে থামিয়ে দেয় পুরো ২০ ওভারে, কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটাররা ১১৪ রানের বেশি করতে পারেনি।

টি২০ ক্রিকেটার উঠে আসছে না কেন?
প্রথম বিভাগ লিগ খেলা ক্রিকেটার ও বর্তমানে ক্রিকেট উপস্থাপক সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি মনে করেন, বাংলাদেশে যথাযথ টি২০ ক্রিকেটার উঠে না আসার কারণ ঘরোয়া টি২০ টুর্নামেন্টের অভাব এবং একই সাথে কোচিং মেথড টি২০ সুলভ না।

“ভারতে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের বাইরে টি২০ টুর্নামেন্ট আছে, যেগুলো রাজ্য ভিত্তিক সেরা ক্রিকেটার তুলে আনে, যেমন তামিল নাড়ু প্রিমিয়ার লিগ,” তিনি বলেন।

“এছাড়া সৈয়দ মুশ্তাক আলি ট্রফিও এখন টি২০ ফরম্যাটে খেলা হয়, এতে করে অনেক এলাকা থেকে ক্রিকেটাররা নিজেদের প্রমাণের মঞ্চ পান,” সামি বলেন।

অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং সেনসেশন জেইক ফ্রেজার- ম্যাকগারক। ফটোঃ ২৭ এপ্রিল, ২০২৪।

তিনি বলছেন, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াতেও একই প্রক্রিয়ায় রাজ্যভিত্তিক ক্রিকেটার তুলে আনা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে প্রিমিয়ার টি২০ লিগ ছাড়া আর কোনও ঘরোয়া টি২০ আসর হয় না, এতে করে ক্রিকেটাররা উঠে আসার যে রাস্তা সেটা সংকীর্ণ একই সাথে শীর্ষ পর্যায়ের টি২০ ক্রিকেটের ম্যাচও পাননা ক্রিকেটাররা।

“এটা টি২০ ক্রিকেটে ভালো না করার পেছনে একটা বড় কারণ। আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে ক্রিকেট শেখার যে প্রক্রিয়া সেটায় অনেক বড় বদল এসেছে, যেমন অনেক ক্রিকেটারই হকি, গলফ বা টেনিস খেলতে পারেন, তারা সেসব ক্রীড়া থেকে প্রাপ্ত টেকনিক নিজেদের ব্যাটিং এ কাজে লাগান।”

এ’প্রসঙ্গে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং সেনসেশন জেইক ফ্রেজার- ম্যাকগারক-এর কথা উল্লেক্ষ করেন, যিনি সম্প্রতি বলেছেন তার পাওয়ার হিটিং এর পেছনে মূল কারণ তিনি কাজটা করতে আনন্দ পান, গলফ খেলেন এবং তিনি দুইটা খেলাকে মেলাতে পারেন।

বিদেশের অনেক কোচ বেজবলের সাথে ক্রিকেটের সম্পর্ক খুঁজে ক্রিকেটারদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন।

“কিন্তু বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে আসার আগ পর্যন্ত ক্রিকেটাররা খুবই পুরাতন একটা কোচিং প্রক্রিয়ায় উঠে আসছেন, এতে না ক্রিকেটারদের কোনও উন্নতি হচ্ছে, না বাংলাদেশের ক্রিকেটের,” বলেন সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি।