প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল আরো দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। নিম্নচাপটি এখন সিলেট এবং এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছে। তবে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সোমবার (২৭ মে) বিকাল থেকে ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। এখনো ৬টি বিমান গ্রাউন্ডে আটকে আছে বলে জানিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, ঢাকা থেকে যথারীতি লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ। আর, আর, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ৩৬ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার সকালে ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
ঘূর্ণিঝড় রিমাল এখন নিম্নচাপ
বাংলাদেশ উপকূলে রবিবার (২৬ মে) আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল আরো দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। নিম্নচাপটি এখন সিলেট এবং এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর।
সর্বশেষ আবহাওয়া পরিস্থিতি দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নিম্নচাপটি উত্তরপূর্ব দিকে এগিয়ে আরো দুর্বল হতে পারে। এর প্রভাবে সমুদ্রবন্দর, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। সেইসঙ্গে উত্তর বঙ্গোপসাগরে থাকা সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
এদিকে, মঙ্গলবার (২৮ মে) আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায়; বরিশাল ও রংপুর বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।আর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এদিকে, ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এ সময় এই এলাকার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার পাশাপাশি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ২০-৩০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে যেতে পারে, যা ঝড়ো হাওয়া রূপে ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেও, রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
সিলেট বিমানবন্দরে শিডিউল বিপর্যয়
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সোমবার (২৭ মে) বিকাল থেকে ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। পাশাপাশি বিমানবন্দরে আটকা পড়ে অন্তত ৯টি ফ্লাইট।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে সোমবার বিকাল থেকে সিলেট বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমান, ইউএস বাংলা, নভোএয়ার ও এয়ার অ্যাস্ট্রা এয়ারলাইন্সের ৯টি ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে।
এর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত উড্ডয়ন ও অবতরণ ফ্লাইট। এছাড়া, রাজশাহী ও সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে না পেরে দুটি ফ্লাইট সিলেটে জরুরি অবতরণ করে। এ দুটি ফ্লাইটও আটকা পড়ে।
আর সোমবার সন্ধ্যার পর, ঢাকা থেকে আসা একটি ফ্লাইট সিলেটে অবতরণের কথা থাকলেও সেটি ঢাকায় ফিরে যায়। সোমবার রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, “রিমালের প্রভাবে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় আটকা পড়া বিমানগুলো রাজশাহী ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে অবতরণ ও উড্ডয়নের কথা ছিলো। এখন পর্যন্ত ৬টি বিভিন্ন মডেলের বিমান আমাদের গ্রাউন্ডে আছে। এর আগে মোট ৯টি বিমান আটকা ছিলো।”
তিনি আরো বলেন, এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের ৩টি বোয়িং বিমান সিলেট বিমানবন্দর ছেড়ে গেছে। বাকিগুলো আবহাওয়ার প্রতিকূলতা শেষ হলে বিমানবন্দর ছেড়ে যাবে।
ঢাকা থেকে লঞ্চ চলাচল শুরু
ঘূর্ণিঝড় রিমাল দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মঙ্গলবার (২৮ মে) দুপুর ১২টা থেকে ঢাকার নদীবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ পথে লঞ্চ চলাচল পুনরায় শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জনসংযোগ কর্মকর্তা এহতেশামুল পারভেজ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
এর আগে, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের কারণে রবিবার (২৬ মে) রাত ১০টা থেকে সব রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।
দৌলতদিয়ায় ফেরি চলাচল শুরু
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে বন্ধ থাকা ফেরি ৩৬ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার সকালে চালু হয়েছে। র্তৃপক্ষের নির্দেশে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ফেরি চলাচল শুরু হয়।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয় জানায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রোববার (২৬ মে) রাত সাড়ে ৯টা থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দে হয়। তখন থেকে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে আটকা পড়ে।
ফেরি চলাচল বন্ধ হওয়ায়, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে ক্যানাল ঘাট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে ঢাকামুখী পণ্যবাহী যানবাহনের লম্বা লাইন তৈরি হয়। এদের বেশিরভাগ গাড়ি রবিবার রাত থেকে নদী পার হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে, দৌলতদিয়া প্রান্তে চালু থাকা ৩, ৪ ও ৭ নম্বর ঘাটের মধ্যে ৭ নম্বর ঘাটটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আপাতত বন্ধ রয়েছে। ঝড়ে পাটুরিয়া প্রান্তে একাধিক ঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, তা মেরামত করা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘সকাল সোয়া ৯টার দিকে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দৌলতদিয়া থেকে ফেরি ছেড়ে যায়। বর্তমানে দৌলতদিয়ার ৩ ও ৪ নম্বর ঘাট দিয়ে যানবাহন পারাপার হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত ৭ নম্বর ঘাট মেরামত করা না পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানান তিনি।
আরো মৃত্যু
খাগড়াছড়িতে ঝড়ে রাস্তায় ভেঙে পড়া গাছ কাটার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (২৭ মে) রাত আনুমানিক ১১টার দিকে জেলার আলুটিলা এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
নিহত রাসেল হোসেন (২০) ঢাকার ধামরাইয়ের আব্দুল রাজ্জাকের ছেলে। খাগড়াছড়ি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার রাজেশ বড়ুয়া বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে আলুটিলার বিভিন্ন স্থানে সড়কে গাছ ভেঙে পড়ে। সেগুলো কাটার সময় ৩৩ হাজার ভোল্টের তারের সঙ্গে স্পৃষ্ট হয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
কুষ্টিয়া জেলার মিরপুরে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে টিনের চালার নিচে চাপা পড়ে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন।নিহত বাদশা মল্লিক (৬০) ওই এলাকার মৃত খবির মল্লিকের ছেলে।
সোমবার (২৭ মে) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের দাসপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। চিথলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক বাবলু ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী
এর আগে, সোমবার (২৭ মে) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান জানিয়েছিলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ৬ জেলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে আংশিক এবং সম্পূর্ণ মিলে এক লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় রিমাল পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রামে মোট ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
তিনি আরো বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো; খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, চাদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর এবং যশোর। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭টি এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪টি জানান তিনি।
ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি।
ঘূর্ণিঝড় সতর্কবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে, উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ৯ হাজার ৪২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আট লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ আশ্রিত পশুর সংখ্যা ৫২ হাজার ১৪৬টি; জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, দুর্গত লোকজনকে চিকিৎসা সেবা দিতে মোট এক হাজার ৪৭১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে চালু আছে এক হাজার ৪০০ টি টিম।