‘সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ ও সাবেক আইজিপি বেনজীরকে নিয়ে বিব্রত নয় সরকার’, বললেন ওবায়দুল কাদের

বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ ইস্যুতে সরকার বিব্রত নয়।

মঙ্গলবার (২৮ মে) দুপুরে, ঢাকার ধানমন্ডিতে, আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। “সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে। সরকার তাদের অপরাধ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাবার সুযোগ দেয়নি। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকার আপোষহীন;” যোগ করেন তিনি।

বেনজীরের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে বলে উল্লেখ করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, দুদক স্বাধীন। সরকার দুদককে স্বাধীনতা দিয়েছেন। দুদক জানিয়েছে, বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে তদন্ত এখনো চলছে এবং আরো তদন্ত করা হবে।

“যেহেতু তদন্ত চলছে, সেহেতু তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। শেখ হাসিনার শাসনামলে কোনো অপরাধী ছাড় পাবে না। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, তিনি যদি অপরাধী হন, তার বিরুদ্ধেও তদন্ত করতে পারবে দুদক। অপরাধী হলে অপরাধের জন্য শাস্তি পেতেই হবে। তিনি যেই হোন;” যোগ করেন ওবায়দুল কাদের।

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ সম্পর্কে হাছান মাহমুদ

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ভিসা নীতির আওতায় নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। গত ২১ মে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

“বাংলাদেশ সরকার দুর্নীতি দমনে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এবং এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখবে;” যোগ করেন হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করছে। “আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই এবং তা অব্যাহত রাখবো;” আরো বলেন হাছান মাহমুদ।

এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ভিসা নীতির আওতায় নেয়া হয়নি। এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট, ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান,যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং সন্ত্রাসবাদ, মানবপাচার ও অন্যান্য ইস্যুতে ২ দেশ একসঙ্গে কাজ করছে। সাবেক সেনাপ্রধানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত প্রথমে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানানো হয় বলেও জানান তিনি।

বিষয়টি একজন সাবেক সেনাপ্রধানের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

মির্জা ফখরুল যা বলেছেন

বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার খবরে খুশি না হতে দলীয় সহকর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত ২১ মে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক আলোচনা সভায় এ আহবান জানান তিনি।
“অন্যের ওপর নির্ভর না করে, নিজের শক্তি দিয়েই বর্তমান সরকারকে পরাজিত করতে হবে;” বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল।

তিনি আরো বলেন, “নিজের ঘর নিজে সামলাতে না পারলে, অন্য কেউ এটা করে দেবে না। আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞায় অনেকেই খুশি হতে পারেন। আমি মনে করি এটি বিভ্রান্তিকর এবং আমরা সবসময় বিভ্রান্ত হচ্ছি।”

যুক্তরাষ্ট্র এর আগে, র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো; কিন্তু বর্তমান সরকারের ভয়াবহ যাত্রা থামাতে পারেনি; বলেন মির্জা ফখরুল।

“আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, নিজের শক্তি দিয়ে দাঁড়াতে হবে এবং নিজেদের শক্তি দিয়ে তাদের পরাজিত করতে হবে;” যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের সাবেক সেনা প্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বা স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে ‘উল্লেখযোগ্য দুর্নীতির’ সাথে সম্পৃক্ততার কারণে ‘ডেসিগনেট’ করেছে, বা তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

“আজিজ আহমেদ সরকারি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে লিপ্ত হন, এবং তার ভাইকে বাংলাদেশে অপরাধমূলক কাজের জন্য জবাবদিহিতা এড়াতে সহায়তা করেন,” সোমবার (২০ মে) এক বিবৃতিতে স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আজিজ অন্যায় ভাবে সামরিক কন্ট্রাক্ট প্রদানে তার ভাইয়ের সাথে কাজ করেন এবং নিজ সুবিধার জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ করেন।

“তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা দুর্বল করার জন্য অবদান রেখেছে,” বিবৃতিতে বলা হয়।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলে, আজিজের ‘ডেসিগনেশন’ বাংলাদেশে আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার আবারো ব্যক্ত করছে।

“যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরকারি পরিষেবা আরো স্বচ্ছ, ব্যবসায়িক ও নিয়ন্ত্রক পরিবেশের উন্নয়ন এবং অর্থ পাচার সহ আর্থিক অপরাধ তদন্ত আর তার বিচারের মাধ্যমে দুর্নীতি-বিরোধী কার্যক্রম সমর্থন করে,” বিবৃতিতে বলা হয়।

এই ‘ডেসিগনেশন’ বা নিষেধাজ্ঞার ফলে, আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যরা সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশের অযোগ্য হবেন।

বেনজীর ও তার পরিবারের জন্য দুদকের কমিটি

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২২ এপ্রিল দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান কমিশন সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন।

তিনি বলেন, গত ৩১ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ১ ও ২ এপ্রিল আরো কয়েকটি ইলেকট্রনিক সংবাদ মাধ্যমে একই ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে দুদক সচিব বলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ এর বিধি নম্বর ৩ অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

দীর্ঘ ঈদের ছুটি শেষে গত ১৮ এপ্রিল প্রথম বৈঠকে সাবেক আইজিপির দুর্নীতির বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয় বলে জানান সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন।

সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তদন্ত শেষ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

এর আগে, পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। সোমবার (২২ এপ্রিল) হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহউদ্দিন রিগ্যান।রিটে দুদক চেয়ারম্যান ও সচিবসহ চার জনকে বিবাদী করা হয়েছে।

টিআইবি

সংবাদপত্রে সাবেক আইজিপির বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের যে খতিয়ান প্রকাশিত হয়েছে, সেটা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে খুবই অস্বাভাবিক বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

ইফতেখারুজ্জামান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ আহরণ বাংলাদেশে এখন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে । এই যে সাবেক আইজিপির বিশাল সম্পদের খতিয়ান প্রকাশিত হয়েছে, তা হতবাক করার বিষয়।"

"রিপোর্টে সম্পদের যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেটিকে নির্ভরযোগ্য বলতে হবে।" তাদের কাছে (পত্রিকার) লিখিত প্রমাণ আছে বলেও মনে করেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান এর আগে বলেছিলেন, "আমাদের জানামতে দুদক চাইলে স্বপ্রণোদিত হয়ে যেটুকু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে। অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু করতে পারে। এখন এটা কেন তারা করছে না, তা দুদকে (আপনারও) প্রশ্ন করা উচিত। তারা উত্তর দেবে, আমাদের কাছে অভিযোগ আসলে করবো। কিন্তু কেউ অভিযোগ করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নাই।"

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, র‌্যাব ও বেনজীর আহমদ

২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়।

এই কর্মকর্তাদের মধ্যে র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র‍্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত।

এতে বলা হয়েছে যে, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‍্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র‍্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।