জাতিসংঘ মানবাধিকার দফতর: ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে নৃশংসতা চলছে’

পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুথিডং-এ একটি চেকপয়েন্টে নিরাপত্তা দেয়ার সময় সড়কে দাড়িঁয়ে আছেন এক পুলিশ অফিসার, ২৮ মে, ২০১৭।

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে, প্রধানত মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনী পরিচালিত নতুন সহিংস ও ধ্বংসাত্মক অভিযান চলছে। এই অভিযানে ব্যাপক হারে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে খরব পাওয়া যাচ্ছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র লিজ থ্রোসেল শুক্রবার জেনেভায় এক ব্রিফং-এ সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা মিয়ানমারের উত্তরআঞ্চলের রাখাইন রাজ্য থেকে বেসামরিক জীবন ও সম্পদের ওপর সংঘাতের প্রভাব সম্পর্কিত ভীতিকর এবং অস্বস্তিকর সংবাদ পাচ্ছি।”

তিনি বলেন, “সবচেয়ে গুরুতর কিছু অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা,এবং তাদের সম্পত্তি পোড়ানোর ঘটনা।” আর সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বুথিডং ও মংডু শহর থেকে যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে; আরো জানান তিনি।

“গত সপ্তাহে ভুক্তভোগীদের জবানি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, স্যাটেলাইট ইমেজ এবং অনলাইন ভিডিও ফুটেজ ও ছবি থেকে সংগ্রহ করা তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে “বুথিডং শহর কার্যত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে;” জানান লিজ থ্রোসেল।

তিনি আরো বলেন, এমন তথ্য পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত করে যে শহর থেকে সামরিক বাহিনী পিছু হটার এবং আরাকান আর্মি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দাবি করার দুই দিন পর, ১৭ মে আগুন লাগানোর ঘটনা শুরু হয়।

মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দফতরের মিয়ানমার টিমের প্রধান, জেমস রোডহেভার ব্যাংককে বলেন, তার দল ঘটনাস্থলে অনেক সূত্রের সাথে কথা বলেছে এবং অসংখ্য উপকরণ পর্যালোচনা করেছে। “যার মধ্যে অনেকগুলো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বলে মনে হয়েছে;” আরো বলেন জেমস রোডহেভার।

জেমস রোডহেভার জানান, একজন ভুক্তভোগী শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় কয়েক ডজন মৃতদেহ দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। অন্য একজন ভুক্তভোগী বলেন, তিনি হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। এরা সকলেই নিরাপদে শহরের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, আরাকান আর্মি তাদের বাধা দেয়। এই ভুক্তভোগী ব্যক্তি আরো বলেন, আরাকান আর্মির সদস্যরা জীবিত ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতন করে এবং শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে।

আরাকান আর্মি হলো একটি সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠী, যারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি জোটের অংশ হিসেবে লড়াই করছে।

রোডহেভার বলেন, “বুথিডং পুড়িয়ে দেয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জাতিসংঘ মানবাধিকার দফতরের মিয়ানমার বিষয়ক দল আরাকান আর্মি এবং উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর দ্বারা রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো বিমান হামলা, ড্রোন আক্রমণ এবং নতুন আরো হামলার তথ্য নথিভুক্ত করেছে।”

তিনি বলেন, তার দফতর পলায়নরত নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর গুলি চালানো, একাধিক গুমের ঘটনা এবং বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার তথ্য পেয়েছে এবং চারটি শিরশ্ছেদের ঘটনা নিশ্চিত করেছে।

“মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কয়েক বছর ধরে সক্রিয়ভাবে রোহিঙ্গাদের লক্ষ্যবস্তু করে আসছে। আর, কঠোর এবং বৈষম্যমূলক বিধিনিষেধ প্রয়োগ করেছে; যা রোহিঙ্গাদের জীবনের সমস্ত দিক প্রভাবিত করে;” জানান রোডহেভার।

মিয়ানমারের সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে, ২০১৭ সালের আগস্টে, দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় পালিয়ে আসে। বর্তমানে, রাখাইন রাজ্যে আনুমানিক ৬ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।

যদিও তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করছে; তার পরও দেশটির সরকার তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে।

মিয়ানমারের সামরিক সরকার কয়েক দশক ধরে নিজ দেশের জনগণের বিপক্ষে যুদ্ধ করছে। সাম্প্রতিক কালে তারা বেশ কিছু পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে। এদিকে, বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রোহিঙ্গা যুবকদের তারা যুদ্ধের জন্য নিয়োগ করছে। এর মধ্যে রয়েছে; পরিবারের জন্য আরো খাদ্যের জোগান এবং নাগরিকত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি।

এটাকে মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের একটি প্রতারণামূলক চাল বলে অভিহিত করেন রোডহেভার।

তিনি বলেন, “তারা জানে যে এই যুবকদের বেশির ভাগই কখনো কোনো ধরনের যুদ্ধের বা আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ পায়নি। সুতরাং, তাদের বেশিরভাগকেই যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হচ্ছে মানব ঢাল হিসেবে বা কামানের গোলার খাদ্য হিসাবে। মিয়ারমার সামরিক বাহিনী এটি খুব ভাল করেই জানে।”

মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুস বৃহস্পতিবার সতর্ক করে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি অন্ধ হয়ে বসে থাকে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গার জীবন বাঁচাতে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়; তবে হয়তো “রাখাইন রাজ্যে আরেকটি রোহিঙ্গা রক্তপাতের অশুভ ঘটনা দেখতে পাওয়া যাবে।”

এই মূল্যায়নের সাথে একমত প্রকাশ করেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক। তিনি অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহবান জানান। আর, পরিচয়ের পার্থক্য না করে, সকল বেসামরিক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহবান জানান তিনি৷