খরচ হচ্ছে কিন্তু সেভাবে কাজ হচ্ছে না: মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

বাংলাদেশের আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ‘কেমন বাজেট চাই’; এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও অংশীজনের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। আসন্ন অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া উচিত– এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয় ভয়েস অফ আমেরিকার। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মলয় বিকাশ দেবনাথ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত? কেন?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: ভয়েস অফ আমেরিকার পাঠকদের শুভেচ্ছা। বাজেট সমাগত। নানা কারণে এবারের বাজেটে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেট করতে হবে। প্রথমেই আমি বলব, প্রায় প্রতি বছরই বাজেটে যে ঘাটতি হয়, তা না হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। বাজেটে ঘাটতি কমানোর জন্য দুটো বিষয় প্রয়োজন। একটি রাজস্ব বাড়ানো। বর্তমান অর্থবছরের ৯ মাসের রেকর্ড খুব খারাপ না। টার্গেটের শতকরা ৯৩ ভাগ অর্জিত হয়েছে। এটা যেন শতভাগ কিংবা শতভাগেরও বেশি অর্জিত হয় এবং এখানেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে বলে আমি মনে করি। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কী কী করা দরকার?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: মানুষকে মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। এজন্য ভোকেশনাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। এতে করে মানবসম্পদ মানব মূলধনে পরিণত হবে। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দেশের ডিজগাইজড এমপ্লয়মেন্ট অর্থাৎ এমএ পাস করে পিয়নের চাকরি করছে। এ জায়গা থেকে বের হতে হবে। কারিগরি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা এ থেকে মুক্তি দিতে পারে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আয় বাড়ানোর জন্য কী করা দরকার?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে বৈষম্য বাড়ছে। এটাকে সমন্বয় করতে হবে। দেশে প্রায় ৩৯ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা আছে। আমি মনে করি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে সেখানে প্রণোদনা এবং এসএমই কিংবা বিসিকের মতো কোনো প্ল্যাটফর্মের আওতায় এনে এদেরকে সযতনে লালন করে শক্তিশালী করতে হবে। এতে করে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, যাতে আমাদের আয় বাড়বে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কোন কোন খাতে খরচ কমানো উচিত?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি, যা ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে সেখানে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে কিছু কমানো এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যয় করতে হবে। অপচয় কমাতে হবে। যেমন যে কাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ তা আগে করতে হবে আর কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরের জন্য রেখে দিতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আইএমএফ বাজেটের আকার ছোট রাখতে বলেছে, আপনি কি একমত? কেন?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: এ প্রশ্নটি উঠেছে। এটা সর্বজনস্বীকৃত, একটি দেশের বাজেট যদি তার সামষ্টিক আয় জিডিপির শতকরা ২০ ভাগ না হয় তবে তা অপ্রতুল। আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত বাজেটকে জিডিপির শতকরা ১৭ ভাগের বেশি নেওয়া যায়নি। তাই বাজেটকে ছোট করা আমি মোটেও সমর্থন করতে পারছি না। বাজেটকে বরঞ্চ প্রয়োজন অনুযায়ী আরও বড় করতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কোন তিনটি খাতে সংস্কার সবচেয়ে জরুরি? কী করা উচিত?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: ব্যাংক-বীমা খাতে খুব বেশি সংস্কার প্রয়োজন। এ ছাড়া শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার প্রয়োজন। সম্ভবত ২০১৬-১৭ সালের বাজেটে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি ব্যাংকিং সংস্কার কমিটি তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে যদি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোরভাবে কাজ করে তবে কোনো কমিটিরই প্রয়োজন হয় না। একক বিনিময় হার; যা কার্ব মার্কেটের সঙ্গে তিন-চার টাকার ব্যবধান থাকবে– এটি বাস্তবায়ন করা দরকার। এতে অবৈধ পথে টাকা আসা বন্ধ হবে। সরকার হয়তো আমদানি বা এলসির জন্য ভয় পায়। কিন্তু আমদানিতে নজরদারি বাড়াতে হবে। অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া আমদানির ওপর বেশি কর আরোপ করতে হবে। অন্যদিকে কিষান-কিষানির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাজেট তৈরির সময় কোন কোন চ্যালেঞ্জের কথা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাথায় রাখা দরকার?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: মন্ত্রণালয় বা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাহিদার অন্ত থাকে না। এ বছর যত টাকা খরচ করেছে, পরের বছর তার থেকে শতকরা ২০ ভাগ বেশি চাহিদা দেয়। এটা দিতেই পারে। তবে এটাকে যৌক্তিকভাবে দেখার ক্ষমতা থাকতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: গত পাঁচ বছরের বাজেট পর্যালোচনা করলে কোন দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা বা ভুলগুলো চোখে পড়েছে? এগুলো অ্যাড্রেস করা হয়েছে কি? কী করা উচিত?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: দুর্বলতা হলো রাজস্ব আদায়টা ঠিকমতো হয়নি। এ দেশে বাস্তবায়ন বলতে বোঝায়– বরাদ্দ কত ছিল আর কত খরচ হয়েছে। কিন্তু আসল বাস্তবায়ন হওয়া উচিত তিন মাসে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়া উচিত ছিল আর তার বিপরীতে প্রকল্পের ফিজিক্যাল প্রগ্রেস কতটুকু হয়েছে। এখানে একটা বড় দুর্বলতা ছিল। খরচ হচ্ছে কিন্তু সেভাবে কাজ হচ্ছে না। কৃষিক্ষেত্রে যেমন অগ্রগতি হয়েছে, পক্ষান্তরে শিল্পায়নে ততটা উন্নয়ন দেখা যায়নি। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। আমাদের রপ্তানি বাজার যেমন– পশ্চিমা বিশ্ব এবং মধ্যপ্রাচ্য, এখানে আরও গুরুত্ব দিয়ে বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। কেনাকাটা করা সহজ কিন্তু বিক্রি করা কঠিন। এগুলো মাথায় রেখে সরকারকে পররাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনৈতিক কূটনীতি ঠিক করতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে লিঙ্গসমতা অর্জনের জন্য বাজেটে কী সংযোজন বা বর্জন করা যেতে পারে?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলেছে লিঙ্গসমতার দিক থেকে এশিয়ায় আমরা দ্বিতীয়। ফিলিপাইনের পরেই আমাদের অবস্থান। আমি মনে করি, প্রতিটি জায়গায় মেয়েদের ৩০-৪০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করার দিকে জোর দিতে হবে। প্রয়োজনে বাজেটে এর জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে।