ইসরায়েলি ও হামাস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আইসিসির পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন মহলের তীব্র প্রতিক্রিয়া

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান প্রসিকিউটর সোমবার বলেছেন, তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট, এবং ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত গাজায় হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ তিন হামাস কর্মকর্তার গ্রেফতারি পরোয়ানা চান।

এই ঘোষণার পর বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসা শুরু হয়েছে। নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য ইসরায়েলি নেতারা ঘোষণাকে লজ্জাকর এবং ইহুদি-বিদ্বেষী বলে বর্ণনা করেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও প্রসিকিউটরের নিন্দা করেন এবং ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার সমর্থন করেন।

আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান এক বিবৃতিতে বলেন, তার দফতর বিশ্বাস করে, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট “ফৌজদারি দায় বহন করেন।” সেই সঙ্গে যুদ্ধের পদ্ধতি হিসেবে বেসামরিক নাগরিকদের অনাহারে রাখা ও বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা পরিচালনা করার দায়ও রয়েছে তাদের।

খান বলেন, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সিনওয়ারের পাশাপাশি হামাসের সামরিক শাখার কমান্ডার মহম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরি ও হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়েও সমানভাবে দায়ী।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ফটোঃ ২০ মে, ২০২৪।

তিনজন বিচারকের একটি প্যানেল সিদ্ধান্ত নেবে যে,গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করা হবে কিনা, যার ফলে মামলা এগিয়ে যেতে পারবে। সাধারণত, বিচারকরা এরকম সিদ্ধান্ত নিতে মাস দুয়েক সময় নেন।

নেতানিয়াহু আর বাইডেনের প্রত্যাখ্যান

নেতানিয়াহু তাঁর বিরুদ্ধে প্রসিকিউটরের অভিযোগকে একটি ‘অপমান’ এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও সমগ্র ইসরায়েলের উপর আক্রমণ বলে বর্ণনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, হামাসের সন্ত্রাসী আক্রমণ এবং দক্ষিণ ইসরায়েলে বেসামরিক লোক অপহরণ আর গাজায় ইসরায়েলি সামরিক কার্যক্রমকে এক কাতারে ফেলে আইসিসি প্রসিকিউটরের সিদ্ধান্তর নিন্দা জানান।

সোমবার এক বিবৃতিতে বাইডেন বলেন, ইসরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা চেয়ে আইসিসি প্রসিকিউটরের আবেদন “চরম আপত্তিকর।”

“আমি পরিষ্কার বলতে চাইঃ এই প্রসিকিউটর যাই ইঙ্গিত করুক না কেন, ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে কোন সমানতা নেই, একদম নেই,” প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন।

হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়েহ। ফটোঃ ২৬ মার্চ, ২০২৪।

হামাসের প্রতিক্রিয়া

এই ‘সমানতার’ প্রতিবাদ করে হামাসও বিবৃতি দিয়েছে। হামাসের তিনজন নেতার গ্রেফতারি পরোয়ানা চেয়ে আইসিসি প্রসিকিউটরের ঘোষণাকে গাজার এই সশস্ত্র গোষ্ঠী নিন্দা করেছে।

হামাস করিম খানের বিরুদ্ধে “জল্লাদের সাথে তার শিকারের তুলনা” করার অভিযোগ আনে। সোমবার এক বিবৃতিতে হামাস বলে, ইসরায়েলি দখলদারিত্ব প্রতিরোধ করার অধিকার তাদের আছে, যার মধ্যে “সশস্ত্র প্রতিরোধের” অধিকারও আছে।

ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইসাক হেরযগ আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটর করিম খানের ঘোষণাকে “চূড়ান্তভাবে আপত্তিকর” বলে বর্ণনা করে বলেন, “আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থা কতটা ধংসের মুখে, এই ঘোষণা সেটাই দেখাচ্ছে।”

সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ হেরযগ লেখেন যে, “ইসরায়েলের একটি গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার, যারা আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম মেনে তার নাগরিকদের রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করছে, তার সাথে নৃশংস সন্ত্রাসীদের সমান্তরাল ভাবে দেখা একদম আপত্তিকর এবং এটা কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না।”

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। ফাইল ফটোঃ ১৬ অক্টোবর, ২০২৩।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাধুবাদ

যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের সেনেটর লিন্ডসে গ্রেহাম আইসিসির সিদ্ধান্তর নিন্দা করেন। সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ তিনি লেখেন, “গ্রেফতারি পরোয়ানা চেয়ে প্রসিকিউটরের আবেদনটাই ঐতিহাসিক পর্যায়ের একটি অপরাধ যা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মনে রাখবে।” গ্রেহাম আরও বলেন, ৭ অক্টোবর হামাসের “ঘৃণাযোগ্য হত্যাযজ্ঞের পর ইসরায়েল বিশ্বের আধুনিক ইতিহাসের ন্যায্য যুদ্ধগুলির একটিতে লড়াই করছে।”

তবে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর আন্তর্জাতিক বিচার শাখার অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর বালকীস জারাহ খানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান।

“যারা সাম্প্রতিক মাসগুলোয় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, তাদের ন্যায় বিচারের দরজা প্রসিকিউটরের নীতি-ভিত্তিক এই প্রথম পদক্ষেপের ফলে খুলে যাবে,” জারাহ সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন।

নেতানিয়াহু এবং গ্যাল্যান্টের যদিও সহসা গ্রেফতার হবার সম্ভাবনা নেই, আইসিসির ঘোষণা হচ্ছে প্রতীকী আঘাত,যার ফলে গাজা যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েলের বিচ্ছিন্নতা আরও গভীর হবে।

ইসরায়েল এই আদালতের সদস্য না। অর্থাৎ, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী হলেও নেতানিয়াহু আর গ্যাল্যান্ট এই মুহূর্তে মামলার ঝুঁকিতে নেই। তবে গ্রেফতারের আশঙ্কা ইসরায়েলি নেতাদের পক্ষে বিদেশ সফর কঠিন করে দিতে পারে।

গাজায় হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ফাইল ফটোঃ ১৩ এপ্রিল, ২০২২।

হামাসকে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে। সিনওয়ার এবং আল-মাসরি দুজনেই গাজায় লুকিয়ে আছে বলে ধারনা করা হয়। কিন্তু ইসমাইল হানিয়েহ, হামাসের শীর্ষ নেতা, কাতারে থাকেন এবং প্রায়ই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে যান। ইসরায়েলের মত কাতারও আইসিসির সদস্য না।

অনাহার নিয়ে করিম খানের অভিযোগ

করিম খান তাঁর বিবৃতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অ নাহারকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ আনেন।

“আমার দফতর জানিয়েছে যে, যুদ্ধের পদ্ধতি হিসেবে অনাহারকে ব্যবহার করার একটা সাধারণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই কার্যকলাপ চালানো হয়েছে এবং হামাসকে নির্মূল করার পন্থা হিসেবে ও হামাস কর্তৃক অপহৃত জিম্মিদের প্রত্যাবর্তনকে নিশ্চিত করতে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের উপর নানা সহিংস পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে," তিনি বলেন।

"গাজার বেসামরিক জনগণকে সমষ্টিগতভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এদের তারা ইসরায়েলের জন্য হুমকি বলে মনে করেছে,” খান বলেন।

খান বলেছেন, হামাসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, যুদ্ধাপরাধ হিসেবে জিম্মি করা, ধর্ষণ, অন্যান্য যৌন নিগ্রহ ও অত্যাচারের অভিযোগ রয়েছে।

“আমার দফতরের মত হল, এই ব্যক্তিরা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের অপরাধের পরিকল্পনা করেছিল, প্ররোচনা দিয়েছিল। অপহরণের পর ব্যক্তিগতভাবে জিম্মিদের পরিদর্শনসহ নিজেদের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে তারা ওইসব অপরাধের জন্য নিজেদের দায় স্বীকার করেছে,” খান বলেন। “আমরা বলছি, এইসব অপরাধ তাদের কর্মকাণ্ড ছাড়া সংঘটিত হতে পারত না।”

সালিভানের সঙ্গে বৈঠক

ওয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সালিভানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গ্যালান্ট সোমবার বলেন, দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে স্থল অভিযান আরও প্রসারিত করতে ইসরায়েল অঙ্গীকারবদ্ধ।

গ্যালান্ট আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার নানা পন্থা নিয়ে তিনি ও সালিভান আলোচনা করেছেন।

গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি হ্রাস করতে হামাসের বিরুদ্ধে আরও সুনির্দিষ্ট সামরিক অভিযান নিয়ে আলোচনা করতে সালিভান রবিবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেন।

ইসলামি গোষ্ঠীকে পরাস্ত করে অবশিষ্ট জিম্মিদের ঘরে ফেরানো পর্যন্ত হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার অঙ্গীকার করেছেন নেতানিয়াহু।

আট জুনের মধ্যে যুদ্ধ-পরবর্তী “কর্ম পরিকল্পনা” নেতানিয়াহু অনুমোদন না করলে শনিবার শাসক-জোট ত্যাগ করার হুমকি দিয়েছেন তার যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য বেনি গ্যান্টজ