আরও পাঁচটি ট্রেনিং এ পাঠালে সক্ষমতা বাড়বে বিষয়টি তেমন নয়: হোসেন জিল্লুর রহমান

হোসেন জিল্লুর রহমান

নতুন অর্থবছরের জন্য আসবে নতুন বাজেট। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিবেচনায় এবং বর্তমান সরকারের নতুন মেয়াদের প্রথম বাজেটে সরকারকে সম্ভাব্য যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা উচিৎ তা নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় ভয়েস অফ আমেরিকার । ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মলয় বিকাশ দেবনাথ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেটে কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত? কেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সরকার নিছক আমলাতান্ত্রিক গতানুগতিক বাজেট করছেন, নাকি
অর্থনৈতিক বাস্তবতা সংক্রান্ত একটা বৃহৎ উপলব্ধির ভিত্তিতে বাজেট প্রনয়ণ করছেন কিনা
জানা জরুরি। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার কৌশলগুলো নিয়ে কী ভাবছে। অগ্রাধিকার এখনে দিতে হবে।কোথায় কত গভীরভাবে, কত বিশ্লেষণী দক্ষতার সাথে বাজেট পরিকল্পনা করবেন। সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সঠিক কৌশলগত পরিকল্পনাই আমার প্রথম চাওয়া।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাস্তবয়ন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কী কী করা দরকার?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতার বিষয়টি সমগুরুত্বপূর্ণ। কেননা আমরা
প্রতিবারই দেখি আমাদের উন্নয়ন বাজেট হয় কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়না। কিন্তু আমাদের সক্ষমতা তো অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। আমলাতন্ত্রকে প্রচুর পয়সা এবং সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। শুধু বেতন নয়, আরও বহুকিছু সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু সক্ষমতা বেড়েছে কী? বাজেট বাস্তবায়নের হার কিংবা বার্ষিক উন্নয়ন বাস্তবায়নের হার অথবা যেকোন প্রকল্পের সময়মীমার মধ্যে প্রকল্পbবাস্তবায়নের হার বাংলাদেশে খুবই কম। সক্ষমতা বৃদ্ধি মানে শুধুমাত্র কোন টেকনিক্যাল বিষয় নয়।

যেমন আরও পাঁচটি ট্রেনিং এ পাঠালে সক্ষমতা বাড়বে বিষয়টি তেমন নয়। সক্ষমতার একটি দিক হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সক্ষমতা বৃদ্ধি মানে কর্মকর্তার ব্যক্তিকেন্দ্রিক সক্ষমতা যেমন বাড়াতে হবে পাশাপাশি সিস্টেমের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। যেমন বলা যায়, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনেরএকজন দক্ষ কর্মকর্তা তার মতো করে সুন্দর একটি রাস্তা করলেন। পরদিন ওয়াসা এসে সে রাস্তাটি কাটলো। এই যে সিস্টেমের অদক্ষতা কিংবা সমন্বয়হীনতা এটিকে দূর করাটাই সিস্টেমের সক্ষমতা বৃদ্ধি।

আমরা হয়তো বেশি জোড় দিয়েছি ব্যক্তি সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে তার কোন রিপোর্ট বা প্রতিফলন দেখি না। প্রশিক্ষণে কী কী লাভ হলো কিংবা প্রশিক্ষণটির আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল কীনা? তবে প্রশিক্ষণের নামে প্রমোদ ভ্রমন, অপ্রয়োজনীয় ভ্রমন ইত্যাদি গল্প শোনা যায়। মূলকথা হলো ব্যক্তির পাশাপাশি সিস্টেমের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আয় বাড়ানোর জন্য কী করা দরকার?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: বাজেটে আয় বাড়ানোর পথ অসংখ্য নেই। মূলত আয়ের উৎস বলতে কর, পুঁজিবাজার আর অর্থনীতিকে গতিশীল করা। সবথেকে জরুরি কর সংক্রান্ত একটা সার্বিক সংস্কার।

পুঁজিবাজার, ব্যংকের বিষয় আনলে প্রথমেই বলতে হবে এখানকার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে সুশাসন।অথচ বাংলাদেশে এ দুটো জায়গাতেই সুশাসনের সাংঘাতিক ঘাটতি। ফলে চোখের সামনে সবল ব্যংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। একমাত্র কারণ প্রতিকার নেই, নেই জবাবদিহিতা।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কোন কোন খাতে খরচ কমানো উচিত?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: খরচ কমানো উচিৎ সরকারি যন্ত্রের ওপর। খাত অনুযায়ি খরচ কমানো যাবেনা। রাষ্ট্রের অদক্ষ যে অংশ রয়েছে সেখানে খরচ কমানো উচিৎ। অপ্রয়োজনীয় এবং দৃশ্যমান অপচয় সুনির্দিষ্ট করে খরচ কমাতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আই এম এফ বাজেটের আকার ছোট রাখতে বলেছে, আপনি কী একমত? কেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আই এম এফ বলেছে বলে বাজেট ছোট করতে হবে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। আইএমএফ পরামর্শ দিতে পারে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারকে এমনিতেই বাজেট ছোট করতে হবে। আবার ছোট মানে এই না যে, বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ থাকবেই কিন্তু মানুষের যাতায়াত খরচ বাড়িয়ে দিয়ে কিংবা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করে দিয়ে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কোন তিনটি খাতে সংষ্কার সবচেয়ে জরুরি? কী করা উচিত?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: প্রথমত রাজস্ব, ব্যংকিং এবং পুঁজিবাজার অর্থাৎ আর্থিক খাতে সংস্কার প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত বিদ্যুৎ খাতে। আরেকটি হলো অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণ ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার সংস্কার।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাজেট তৈরির সময় কোন কোন চ্যালেঞ্জ-এর কথা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাথায় রাখা দরকার?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে আমাদের ফিসকল স্পেস এবার খুব ছোট। এছাড়া আমরা মধ্যম আয়ের দেশ ও উন্নত দেশে পরিণত হবো। তাই আমাদের ব্যয়ের দক্ষতা অনেকগুণ বাড়াতে হবে। অপচয় বন্ধ করতে হবে, সঠিক প্রকল্প নির্ধারণ করতে হবে। অর্থায়নের কৌশলগুলো চিহ্নিত করতে হবে। অর্থনীতি পরিচালনায় রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধ করতে গেলে রাজনৈতিক ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুন্ন হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: গত পাঁচ বছরের বাজেট পর্যালোচনা করলে কোন দুর্বলতা সীমাবদ্ধতা বা ভুলগুলো চোখে পড়েছে? এগুলো এড্রেস করা হয়েছে কি? কী করা উচিত?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আর্থিক খাতের বিপর্যয় একটি বড় দুর্বলতা যা সরকারের চোখে ধরা
পড়েছে, এ নিয়ে কিছু কাজ করেছে। কিন্তু সর্বোতভাবে এর থেকে উত্তোরনের কোন পদক্ষেপ সরকার নেয়নি। যেমন রিজার্ভ যখন একেবারে কমে গেল তখনই সরকার আমদানি বন্ধ বা কমিয়ে দিয়ে সাময়িক একটা উপায় বের করেছে। এগুলো তাৎক্ষণিক আত্মরক্ষার কৌশল। কিন্তু মধ্যমেয়াদি কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হচ্ছে সংস্কার কাজগুলো করা।

ভয়েস অফ আমেরিকা: অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে লিঙ্গসমতা অর্জনের জন্য বাজেটে কী সংযোজন বা বর্জন করা যেতে পারে?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: লিঙ্গ সমতা হচ্ছে একটা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষমাত্রা। নারীদের অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক কর্মকান্ডে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। দুঃস্থ নারীদের সরাসরি আর্থিক সহায়তা এবং নারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ঋণ দেয়া কিংবা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া।