রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলার কারণে বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে

ফাইল ছবিঃ পদ্মা সেতুতে প্রথম বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল - খুলনা থেকে প্রথমবার যাত্রী নিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় এসেছে সুন্দরবন এক্সপ্রেস। ১ নভেম্বর, ২০২৩।

রেল পরিষেবা উন্নত করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি নতুন উন্নয়ন প্রকল্প চালু করা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ রেলওয়ে তাদের পুরনো রেল লাইনএবং সেতুগুলো রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে লড়াই করছে। এমন পরিস্থিতিতে বগি লাইনচ্যুত হচ্ছে, বাড়ছে নানা ধরনের দুর্ঘটনা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন সূত্র জানায়, প্রায় ৬৩ শতাংশ রেল দুর্ঘটনা ঘটে খারাপ রেললাইন এবং দুর্বল সেতুর কারণে।

বাংলাদেশে রেললাইন রয়েছে ৩,৪০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে, শুধুমাত্র ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-জয়দেবপুর এবং যশোর-আবদুল্লাহপুর লাইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে ডাবল-ট্র্যাক রেললাইন হয়েছে। আর, বেশিরভাগ রেলপথ সিঙ্গেল-ট্র্যাক এবং সেখানে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে।

বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৩,৪০০ কিলোমিটারের বেশি রেললাইন রয়েছে; এর মধ্যে মাত্র এক হাজার কিলোমিটার রেলপথের অবস্থা ভালো।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের রেল পথের বেশকিছু পদ্ধতিগত সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে; ঘন ঘন স্টেশন বন্ধ করা, পুরানো রোলিং স্টক, খারাপ হয়ে যাওয়া অবকাঠামো, অতিরিক্ত ভিড়, বিলম্ব, টিকেটিং সমস্যা এবং সাধারণ অব্যবস্থাপনা। এর সবই রেলপথের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

তারা বলছেন, সিগন্যালিং পদ্ধতির ত্রুটি, মেয়াদোত্তীর্ণ কোচ সংযোগ, রেল লাইনের অপর্যাপ্ত তদারকি, ঝুঁকিপূর্ণ রেল ক্রসিং এবং যাত্রী সুবিধার স্বল্পতার কারণে রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বাংলাদেশে রেলওয়ের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে, এটা অনুমান করার দরকার নেই।”

শামসুল হক বলেন, “আমরা বিনিয়োগে অনেক বেশি নজর দিয়ে অবকাঠামো উন্নতি করেছি। এমনকি আইকনিক স্টেশনের মাত্রা চলে গেছি। কিন্তু অপারেশন তো অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্যে পড়ে না। রেলে উন্নয়নে জোয়ার বইছে, কিন্তু সেখানে রক্ষণাবেক্ষণ যে নজর দেওয়া দরকার ছিলো সেটি দেওয়া হচ্ছে না।”

“পুরাতন জিসিন রক্ষণাবেক্ষণ করলে কর্মকর্তা লাভবান হন না” বলে উল্লেখ করে শামসুল হক বলেন,“ পুরাতন জিনিস মেরামত করে লাভবান হওয়া যায় না। বরং দায়িত্ব নিতে হয়। কিন্তু নতুন জিনিস ক্রয় করলে যারাই জড়িত থাকে, এমনকি প্রজেক্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সবাই কোনও না কোনভাবে বেনিফিট পেয়ে যায়। যার ফলে, প্রজেক্ট নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু রেলের কর্মকর্তাদের আগ্রহ থাকে তা নয়, এই ব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত তারা অনেক আগ্রহী হয়।”

“এখানে সুশাসন না থাকাই একটা বড় দায়ী“- বলে উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, “পুরাতন জিনিসগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে এখন কাউকে দায়বদ্ধ করা হয়নি। যার কারণে সবাই পুরাতন জিনিস রক্ষণাবেক্ষণ না করে নতুন জিনিস ক্রয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে।”

বুয়েটের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশ্লেষক ড. হাদিউজ্জামান, সম্পদ বাড়ানোর প্রবণতা এবং অপরিহার্য রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি চলমান অবহেলার সমালোচনা করেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “নতুন ইঞ্জিন এবং কোচ সংগ্রহের প্রতি মনোযোগ বেশি। কারণ, এতে প্রাথমিকভাবে রেলের অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের তুলনায় কম খরচ হয়। আর, এই প্রবণতার মধ্য দিয়ে, বিদ্যমান রেল লাইন এবং সেতুগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ উপেক্ষিত হয়।"

এই অবহেলার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, যখন প্রায় ২,৫০০ কিলোমিটার রেল ট্র্যাককে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধরা হয়। আর, এই ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ দিয়েই ট্রেনগুলো চলাচল করছে। এর ফলে, ট্রেনের গতি এবং দক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে।

ফাইল ছবি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব-এ ট্রেন দুর্ঘটনা। ২৩ অক্টোবর, ২০২৩।

সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা ও প্রচলিত সিগন্যালিং পদ্ধতি

সাম্প্রতিক কিছু দুর্ঘটনায় এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে সামনে আসে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে; চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার লাইনে সিগন্যাল ত্রুটি এবং একাধিক সিগন্যালিং ভুলের কারণে গাজীপুরের জয়দেবপুরে দুটি ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ।

ঝুঁকির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রচলিত সিগন্যালিং পদ্ধতিকে। এই পদ্ধতিতে, পয়েন্টসম্যান ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় পয়েন্টগুলো যুক্ত করেন বা বিযুক্ত করেন। এছাড়া, স্টেশন মাস্টারের ভুলের কারণে একই লাইন দিয়ে দুটি বিপরীতমুখী ট্রেন চলে আসতে পারে। আর, এটাও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে যথাযথভাবে পয়েন্ট যুক্ত বা বিযুক্ত করতে না পারার কারণে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, এতে লাইনচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা বাাড়ে।

সিগন্যালিং সিস্টেম আধুনিকীকরণ করার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয় আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও ঠিকাদারদের অর্থ প্রদানে বিলম্বের কারণে। বিশেষ করে, ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অতিরিক্ত লাইন নির্মাণের মতো বড় প্রকল্পে এমন সমস্যা দেখা গেছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমি যদি এভিডেন্স ও আউটকাম দেখি প্রায় দেখা যায় দুর্ঘটনা ঘটছে। সিগন্যাল সম্পর্কিত যে দুর্ঘটনা ঘটছে সেখানে থেকে বোঝা যায় অপারেশনে আমরা সক্ষমতা অর্জন করতে পারি নাই। রেল যে নিরাপদ বাহন, এটা যে আস্থার প্রতীক তা ধরে রাখার জন্য বিট্রিশরা চমৎকার একটা মানদণ্ড দিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটা সময় রেল যখন বিনিয়োগ বঞ্চিত ছিলো। কোনও মন্ত্রণালয় অধীনে ছিলো না। যার ফলে রেল দক্ষ জনবল হারায়।”

“এখন রেল আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ করছে, যাদের দক্ষতায় ঘাটতি কারণে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে”- বলে যোগ করে তিনি।

বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কী বলছে

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী, চলমান প্রকল্পের সমস্যাগুলো স্বীকার করেছেন। এছাড়া, একটি কম্পিউটার-ভিত্তিক ইন্টারলকিং সিস্টেমে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জগুলোকেও স্বীকার করেন তিনি। আরো জানান, কর্মচারী স্বল্পতা এবং দক্ষ কর্মীর অভাব ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন যে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য দক্ষ সিগনাল স্টাফ নিয়োগ ও তদারকি বাড়ানোর উদ্যোগ অব্যাহত আছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "পুরাতন জিনিস রক্ষণাবেক্ষণ না করে নতুন জিনিস ক্রয়ের দিকে নজর রেলের- এটা আসলে নির্দিষ্ট করে না বলতে পারলে, এই নিয়ে কথা বলা তো কঠিন।"

তিনি আরও বলেন, "ম্যানুয়ালি অপারেশন পরিচালনা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্ঘটনা বেড়েছে। এইগুলো মানুষের ভুলের কারণে হয়েছে। আগামীতে যেন এই রকম না হয় তার জন্য বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। এমন নয় যে দুর্ঘটনার দিকে আগে নজর দেয়নি। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমরা সব সময় নজর দিয়েছি।"

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, অত্যধিক গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ায়, চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে ঢাকামুখী আপলাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ২৯ এপ্রিল, ২০২৩।

এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। নতুন নিয়োগ করা কর্মী পুরানো ম্যানুয়াল সিগন্যালিং পদ্ধতিতে দক্ষ নয়। আর, চুক্তিভিত্তিক পয়েন্টসম্যানদের রেলওয়ে বিষয়ক প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।আর, নিয়মিত কর্মচারীদের প্রতিস্থাপন হার ও প্রশিক্ষণ রেল বিভাগের অভিযোজন প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করে তুলেছে।

রেল মন্ত্রণালয়ের ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, সারা দেশে ৩১৫টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে, ১৪৩টি ট্রেন গত ১৫ বছরের মধ্যে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। এই সময়ের মধ্যে, ৮৪৩ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে এবং ১,৩৯১ কিলোমিটার রেললাইন মেরামত করা হয়েছে।

এর বাইরে, ১৪৬টি নতুন রেলস্টেশনের জন্য ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আর, ২৭৩টি স্টেশন ভবন পুনর্নির্মাণ, ১,০৩৭ টি নতুন সেতু নির্মাণ, ৭৯৪ টি রেলসেতু পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

ইঞ্জিন সংগ্রহ করা হয়েছে ১০৯টি, যাত্রীবাহী বগি সংগ্রহ করা হয়েছে ৬৫৮ টি। এ ছাড়া, ৫৩০ টি যাত্রীবাহী বগি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, মালবাহী বগি সংগ্রহ করা হয়েছে ৫১৬ টি, মালবাহী বগি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ২৭৭ টি। এছাড়া, আরো কিছু কাজ করা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ১,৭৮৮ টি কোচ রয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ শতাংশ বগির পরিষেবা কাল অতিক্রান্ত হয়েছে। আর কার্যক্ষম ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৯৫টি। রেলওয়ে’র প্রয়োজনীয় জনবল ৪৭,৬০০ জন। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছে ২৪,০০০ কর্মী।

গত পাঁচ বছরে, ২,০০০ টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারাগেছেন অন্তত ১৫০ জন যাত্রী; আর, আহত হয়েছেন ব্মপক্ষে ৫০০ জন। শুধু গত চার মাসেই সারাদেশে ১৬০ টি রেল দুর্ঘটনা ও নাশকতার ঘটনা ঘটেছে।

এসব ঘটনায়,১৮ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছে ২০০ জন।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আদিত্য রিমন।