মুক্ত গণমাধ্যম সূচকঃ নিপীড়নমূলক আইন আর রাজনীতির কারণে শেষ কুড়িতে বাংলাদেশ

সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ বন্ধ করো! ঢাকায় বিক্ষোভের বার্তা। ফাইল ফটো।

বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করছে, এমন সংগঠন রিপোর্টার সঁ ফ্রঁতিইয়ে (আরএসএফ) হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যাদের নিশ্চিত করার কথা, সেই রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষই প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরএসএফ-এর বার্ষিক প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স বা মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে দেখা গেছে, যে পাঁচটি বিষয়ের উপর সূচক তৈরি করা হয়, তার মধ্যে রাজনৈতিক সূচকের সবচেয়ে বেশি পতন হয়েছে – সারা বিশ্বে গড়ে ৭.৬ পয়েন্ট।

“রাষ্ট্র এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ক্রমশ সীমিত ভূমিকা পালন করছে,” আরএসএফ-এর সম্পাদকীয় পরিচালক অ্যান বোকান্দে বলেন। “অথচ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগের জন্য সাংবাদিকতা, প্রকৃত অর্থে যেটা সাংবাদিকতা, সেটা একটি প্রয়োজনীয় শর্ত।”

বাংলাদেশ নিম্নমুখি

আরএসএফের হুঁশিয়ারির প্রতিফলন দেখা গেছে বাংলাদেশের অবস্থানে, যা আরও এক ধাপ নিচে গেছে। গত বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৩ কিন্তু ২০২৪ সালে সেটা ১৬৫-তে দাঁড়িয়েছে।

আরএসএফ-এর বার্ষিক সূচক অনুযায়ী, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিশ্বের যে ২০টি দেশে সব চেয়ে খারাপ, তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ। তার উপরেই আছে আযেরবাইজান, নিকারাগুয়া আর রাশিয়া। বাংলাদেশের ঠিক নিচে অবস্থান করছে সৌদি আরব, বেলারুশ আর কিউবা।

প্যারিস-ভিত্তিক সংস্থাটি প্রতিটি দেশের পাঁচটি বিষয়ের উপর নির্দেশক তৈরি করে – রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন প্রণয়ন, সামাজিক এবং নিরাপত্তা। এই পাঁচটি বিষয়ে অগ্রগতি বা নিম্নগতির ভিত্তিতে দেশের সার্বিক সূচক তৈরি করা হয়।

সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধের দাবীতে ঢাকায় বিক্ষোভ। ফাইল ফটো।

আওয়ামী লীগ ও মিডিয়া

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে রাজনৈতিক সূচক প্রায় ২০ পয়েন্ট কমে ১৯.৩৬ এ দাঁড়িয়েছে। তালিকার শীর্ষে নরওয়ে-এর রাজনৈতিক সূচক ৯৪.৮৭।

“বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের সরকার মিডিয়াকে যোগাযোগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কোন ব্যতিক্রম নয়,” আরএসএফ-এর রিপোর্টে বলা হয়।

“তাঁর দল আওয়ামী লীগের সদস্যরা প্রায়ই তাদের অপ্রিয় সাংবাদিকদের সহিংসতার লক্ষ্যবস্তু করেন। কোন কোন সাংবাদিকের মুখ বন্ধ করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনগত হয়রানি চালনো হয় অথবা তাদের সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়।

“এ’ধরনের বিরূপ পরিবেশে সম্পাদকরা সতর্কতা অবলম্বন করেন এবং সরকারের বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করা থেকে বিরত থাকেন,” রিপোর্টে বলা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

বাংলাদেশে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আরও অবনতি দেখা গেছে – ২০২৩ সালের ৩৫.২২ পয়েন্ট থেকে নেমে ২০২৪ সালে ৩১.৩২।

“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা ডিএসএ সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বে সবচেয়ে কঠোর আইনের মধ্যে অন্যতম। এই আইন কোন পরওয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার বা তল্লাশি এবং যে কোন কারণে সাংবাদিকের সূত্রের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা অনুমোদন করে,” রিপোর্টে বলা হয়েছে।

“এ’ধরনের আইনগত পরিবেশে, সম্পাদকরা নিয়মিত নিজেদের সেন্সর করেন।”

বাংলাদেশের ঢাকার একটি আদালতের বাইরে কার্যক্রম কভার করছেন সাংবাদিকরা। ৩ মে, ২০১৬। (ফাইল ফটো)

মিডিয়া মালিক ব্যবসায়ী

অর্থনৈতিক সুচকে বাংলাদেশ ৩৬.১১ থেকে ২৭.৮৩ পয়েন্টে নেমেছে। তালিকার শীর্ষে নরওয়ের অর্থনৈতিক সূচক ৮৯.৮৪।

কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন জন্ম দিয়েছে নতুন এক ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর, যারা গণমাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে দেখছে।

“বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাঝে যেসব বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান উঠে এসেছে, তারা দেশের বেশির ভাগ ব্যক্তিমালিকানাধীন মিডিয়ার মালিক,” আরএসএফ বলছে।

“তারা মিডিয়াকে নিজেদের প্রভাব এবং মুনাফা বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে দেখে, এবং সম্পাদকীয় স্বাধীনতার চেয়ে সরকারের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখাকে অগ্রাধিকার দেয়।”

নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও উন্নতির তেমন লক্ষণ নেই, যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় দুই পয়েন্ট কমে ২০২৪-এ দাঁড়িয়েছে ২৭.০৬। তবে সার্বিক ভাবে নিরাপত্তার অবস্থা বোঝা যায় তালিকার শীর্ষে থাকা নরওয়ের সাথে তুলনা করলে – যার পয়েন্ট সংখ্যা ৯৪.৯৭।

হুমকির মুখে নারী সাংবাদিক

কিন্তু এই দৃশ্যত উন্নয়নশীল নিরাপত্তা পরিবেশ সাংবাদিকদের রক্ষা করছে না। তারা পুলিশ, রাজনৈতিক কর্মী, জিহাদি সংগঠন এবং অপরাধ চক্রের সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতি নিয়ত।

কিন্তু, আরএসএফ বলছে, “বাংলাদেশের সাংবাদিকরা আরও বেশি দুর্বল এবং অসহায়, কারণ তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার কোন বিচার হয় না।”

নারী সাংবাদিকরা বিশেষভাবে হুমকির মুখে।

“যে পেশা এখনো পুরুষতান্ত্রিক, সেখানে নারী সাংবাদিকদের বহু পুরনো হয়রানির সংস্কৃতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তারা যখন নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে তখন তাদের অনলাইনে নোংরা প্রচারণার কবলে পড়তে হয়,” রিপোর্টে বলা হয়েছে।

লেবাননে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে নিহত রয়টার্স-এর সাংবাদিক ইসাম আব্দাল্লাহ'র বোন আবির (মাঝে) তাঁর ভাইয়ের জানাজায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। আরএসএফ বলে, সাংবাদিকদের লক্ষ্য করেই গোলাবর্ষণ করা হয়েছিল। ফটোঃ ১৪ অক্টোবর, ২০২৩।

গাজায় সাংবাদিক হত্যা

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিষ্কার অভাব ছিল বলে আরএসএফ মনে করছে।

“গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে, গাজার যুদ্ধে সাংবাদিক এবং মিডিয়ার বিরুদ্ধে রেকর্ড সংখ্যক সহিংসতা হয়েছে,” রিপোর্টে বলা হয়েছে।

“ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হাতে ১০০র বেশি ফিলিস্তিনি রিপোর্টার নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত ২২জন মারা গেছেন তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়।”

আরএসএফ-এর ২০২৩ সূচকের প্রথম ১০টি দেশ ইউরোপীয় মহাদেশের, যার মধ্যে নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস আর ফিনল্যান্ড রয়েছে শীর্ষ ৫ স্থানে।

সূচকের অপর প্রান্তে, ইরান, উত্তর কোরিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া আর এরিত্রিয়া রয়েছে শেষ পাঁচটি স্থানে।