ভারত নির্বাচনঃ নরেন্দ্র মোদীর 'মুসলিম অনুপ্রবেশকারী' বক্তব্য নিয়ে তুলকালাম

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখার অভিযোগ এনেছে। দেশটিতে ছয় সপ্তাহব্যাপী সাধারণ নির্বাচন শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর মুসলমানদের “অনুপ্রবেশকারী” উল্লেখ করে তিনি সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিয়ে সবচেয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন।

রবিবার নির্বাচনী সমাবেশে মোদী মুসলিম-বিরোধী ধ্যান-ধারনা উস্কে দিচ্ছেন বলে তীব্র সমালোচনা করা হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে কংগ্রেস পার্টি সোমবার মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে বলছে, ধর্মীয় উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিতে পারে এমন কার্যকলাপ থেকে প্রার্থীদের নিষিদ্ধ করা আইন তিনি ভঙ্গ করেছেন।

কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী এই প্রধানমন্ত্রীর সমালোচকরা বলছেন, এক দশক আগে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত যে ঐতিহ্যগত ভাবে ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ছিল তা আক্রমণের মুখে।

তাদের অভিযোগ, দলটি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং কখনও কখনও সহিংসতাকে উৎসাহিত করছে। বিজেপি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে যে তাদের নীতিগুলি ভারতের সবাইকে উপকৃত করে।

রাজস্থানে এক সমাবেশে মোদী বলেন, কংগ্রেস পার্টি যখন সরকারে ছিল তখন তারা বলেছিল যে দেশের সম্পদের ওপর মুসলমানদের অগ্রাধিকার রয়েছে। জনতার করতালির মাঝে মোদী বলেন, “যদি তারা ক্ষমতায় ফিরে আসে তাহলে দলটি আপনাদের সমস্ত সম্পত্তি হস্তগত করবে এবং তা বিতরণ করবে যাদের বেশী সন্তান রয়েছে তাদেরকে।”

“তারা অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে এটি বিতরণ করবে," তিনি বলেন এবং আরও যোগ দেন - “আপনি কি মনে করেন আপনার কষ্টার্জিত অর্থ অনুপ্রবেশকারীদের দেওয়া উচিত?”

নির্বাচনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। ফটোঃ ১৯ এপ্রিল, ২০২৪।

সাম্প্রদায়িক অনুভূতি ব্যবহার

কংগ্রেস দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে "বিদ্বেষমূলক বক্তব্য" হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং দলের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি এটিকে “চরম, চরম আপত্তিকর” বলে অভিহিত করেছেন।

কংগ্রেস পার্টি নির্বাচন কমিশনের কাছে পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানায়। নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি প্রার্থীদের ভোট নিশ্চিত করতে “জাত বা সাম্প্রদায়িক অনুভূতি” ব্যবহার করা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুক্রবার প্রথম ভোটদান শুরু হয়েছে এবং তা চলবে ছয় সপ্তাহ ধরে। এই নির্বাচনে মোদী ও তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি দল জয়ী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবে জুন মাসের ৪ তারিখে।

মুসলিম আইন প্রণেতা ও অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন পার্টির সভাপতি আসাদউদ্দিন ওয়াইদি রবিবার বলেন, “২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোদী একমাত্র বিষয় নিশ্চিত করেছেন, মুসলিমদের গালি দেওয়া এবং ভোট পাওয়া।"

ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করলেও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, মোদীর আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আরও নগ্ন ভাবে করা হয়েছে।

উন্মত্ত হিন্দু জনতা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গরুর মাংস খাওয়া বা গরু পাচার করার অভিযোগ এনে তাদের গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে। হিন্দুদের কাছে গরু হচ্ছে পবিত্র। মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বয়কট করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বুল ডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোতে আগুন দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে তাদের গণহত্যা করার ডাক দেয়া হয়েছে।

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মানমোহন সিং। ফাইল ফটোঃ ২১ মে, ২০১৫।

মানমোহন সিং-এর উক্তি

মোদীর এই মন্তব্য ২০০৬ সালে কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মানমোহন সিং-এর একটি বিবৃতির প্রতি ইঙ্গিত করে। সিং বলেছিলেন, ভারতের নিম্নবর্ণ, উপজাতি, নারী এবং “বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যালঘুদের' সমানভাবে দেশের উন্নয়নে অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে ।”

সিং বলেন, “সম্পদের উপর তাদের প্রথম দাবি থাকতে হবে।" অবশ্য এর একদিন পরেই তাঁর দফতর থেকে জানানো হয় যে মনমোহন সিং সব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করছিলেন।

কংগ্রেস পার্টি নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করে বলেছে যে মোদী এবং বিজেপি কোন প্রতিকার ছাড়াই নির্বাচনী প্রচারে বারবার ধর্ম এবং ধর্মীয় প্রতীক এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করেছে। "নির্বাচনী আইন বিধি লঙ্ঘনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপিকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশন নিষ্ক্রিয় থাকার জন্য ঐসব কাজ আরও জোরের সঙ্গে করা হয়েছে," আবেদনে বলা হয়।

কংগ্রেস সভাপতি খাড়গে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ লিখেছেন, "ভারতের ইতিহাসে কোনও প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদমর্যাদা এতটা ক্ষুণ্ণ করতে পারেননি যতটা মোদী করেছেন।"

আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে কমিশন সতর্কতা জারি ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রার্থীদের সাসপেন্ড করতে পারে।

সোমবার কমিশনের এক মুখপাত্র প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া সংবাদ সংস্থাকে বলেন, “ আমরা কোনও মন্তব্য করতে রাজী নই।”

ভারতে হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্মহার মুসলিমদের প্রায়ে কাছা-কাছি। ফটোঃ ১৭ এপ্রিল, ২০২৪।

হিন্দু মুসলিম জন্যসংখ্যা

মোদী তার ভাষণে আরেকটি ভ্রান্ত হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারনা ব্যবহার করেন, যেটা হচ্ছে, মুসলমানরা বেশী সন্তানের জন্ম দিয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি যার ৮০ শতাংশই হিন্দু এবং মুসলমান জনসংখ্যা ২০ কোটি যা মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ।

সরকারী তথ্য অনুসারে দেখা যায় যে মুসলমানদের মধ্যে সন্তানজন্ম হার সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর চেয়ে দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে সন্তানজন্ম হার ১৯৯২-৯৩ সালে ৪.৪ থেকে ২০১৯-২১ সালের মধ্যে ২.৩ এ দাঁড়িয়েছে, যা হিন্দুদের ১.৯৪ থেকে সামান্যই বেশি।

মোদীর বিজেপি পার্টি এর আগে মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে উল্লেখ করেছ এবং তাদেরকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বেশ কয়েকটি বিজেপি শাসিত রাজ্য অপ্রমাণিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব “লাভ জিহাদ” এর উদ্ধৃতি দিয়ে ঐ সব রাজ্যে আইন করে আন্তঃধর্মীয় বিয়ে সীমাবদ্ধ বা বন্ধ করা হয়েছে। সেখানে দাবী করা হয়েছে যে মুসললিম পুরুষরা হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করতে বিবাহকে ব্যবহার করে।

সমালোচকরা বলছেন এসব নানা কিছুর মাঝে মোদী নীরব থেকেছেন, যার ফলে তার দলের সবচেয়ে চরমপন্থী সমর্থকরা সাহস পেয়েছে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরও বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রাখতে সক্ষম হয়েছে।