প্রবৃদ্ধির হার কমায় কি বাংলাদেশের উন্নয়নের ‘দুর্দান্ত কাহিনী’ এখন হুমকির মুখে? 

ঢাকার কাছে বুরিগঙ্গার তীরে শ্রমিকরা সিমেন্টের বস্তা মালবাহী নৌকা থেকে নামাচ্ছেন। ফটোঃ ২০ এপ্রিল, ২০২৪।

বাংলাদেশ হঠাৎ করেই মনে হয় কিছুটা অনিশ্চয়তার মুখে পরেছে। যে অর্থনীতির কারণে বাংলাদেশ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে, সেই অর্থনীতি ২০২৪ সালের প্রথম ভাগে এসে আগের মত টেকসই মনে হচ্ছে না।

এর ফলে দারিদ্র বিমোচনে দেশের সাফল্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলেও বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) দ্বিতীয় কোয়ার্টারে (অক্টোবর- ডিসেম্বর) মোট দেশজ সম্পদ বা জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৭৮ শতাংশ, যেটা গত বছরের একই কোয়ার্টারে ছিল ৭.০৮ শতাংশ।

একই সময় মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশের আশে-পাশে ঘোরা-ফেরা করছে। সব মিলে পরিসংখ্যানগুলো দেশের বর্তমান পরিস্থিতির বিবর্ণ একটা চিত্র তুলে ধরছে।

বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.২৪ শতাংশ, যেটা গত বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারের ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অর্ধেকেরও কম।

একই ভাবে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত, পরিষেবা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.০৬ শতাংশ হারে, যেটা আগের বছর একই সময় ছিল ৬.৬২ শতাংশ। মোট দেশজ সম্পদের ৮০ শতাংশের বেশি আসে এই দুই খাত থেকে।

আইএমএফ-এর নতুন পূর্বাভাস

সম্ভবত অর্থনীতির এই মন্থর গতির স্বীকৃতি হিসেবেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.৭ শতাংশ করেছে। বছরের শুরুতে তাদের পূর্বাভাস ছিল ৬.৫ শতাংশ, যেটা তারা গত অক্টোবরে কমিয়ে ৬-এ নিয়ে আসে।

প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়াকে হাল্কা করে দেখছেন না বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা। তাদের মধ্যে অন্যতম ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, যিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এ ডিস্টিংগুইশড ফেলো।

দারিদ্র বিমোচনে সাফল্যের হাসি কি ধরে রাখতে পারবে বাংলাদেশ?

তিনি বলছেন, প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার অর্থ হল, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়া এবং আয়ের পরিমাণ কমে যাওয়া।

“বাংলাদেশে দারিদ্র সীমার নিচে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে,” ডঃ ভট্টাচার্য বলেন। “একই সাথে, আয় এবং ব্যয় বা ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও প্রকট হতে পারে।”

বিগত দশকে বাংলাদেশ দারিদ্র বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখেছে। জনগোষ্ঠীর ৪১.৫ শতাংশ ২০১৬ সালে দারিদ্র সীমার নিচে ছিল। সেই মাত্রা ২০২২ সালে নেমে এসে দাঁড়ায় ১৮.৭ শতাংশে।

মাহমুদ আলীর আশ্বাস

তবে, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হাসান মাহমুদ আলী আইএমএফ-এর পরিবর্তিত পূর্বাভাস নিয়ে আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, সরকার বেশ কিছু সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছে যেগুলো “সুফল বয়ে আনতে শুরু করেছে।”

অর্থমন্ত্রীর আশাবাদ সত্ত্বেও, সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান দেশের অর্থনীতি নিয়ে পরিষ্কার সতর্ক বার্তা দিচ্ছে। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সরকারি নীতির সাফল্যের দিকে ইঙ্গিত করেছে, কিন্তু এখন সেই একই সূত্রের তথ্য ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে।

অর্থনীতির মন্থর গতি ডঃ ভট্টাচার্যর কাছে অপ্রত্যাশিত বা অবাক করার মত কোন তথ্য হিসেবে আসে নি। তিনি বলছেন, এ’ধরনের পরিসংখ্যান প্রত্যাশিত এবং অনুমানযোগ্য ছিল।

“এর মুল কারণ হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগকারীদের মালপত্র আমদানি করতে হবে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটের কারণে আমরা সেটা করতে পারছি না,” তিনি বলেন।

মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূদের হার বাড়িয়ে টাকার সার্কুলেশন সংকোচন করছে।

কোভিড মহামারির পর শিল্প-কারখানা সহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হবার পর থেকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিসার্ভ চাপের মুখে পরেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের হিসেব অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার যে রিসার্ভ ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে ছিল ৪৮ বিলিয়ন (৪,৮০০ কোটি) ডলার, সেটা ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ২০ বিলিয়ন (২ হাজার কোটি) ডলারের নিচে চলে আসে।

মূল্যস্ফীতির আঘাত

ডঃ ভট্টাচার্য বলছেন, মূল্যস্ফীতির উঁচু হার সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারকে আঘাত করেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে চাহিদা এবং ব্যয় বা ভোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বর্তমানে নয় শতাংশের একটু উপরে। তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার তার চেয়ে অনেক বেশি।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং অভিজ্ঞ ব্যাংকার মামুন রশিদ বলছেন, বাংলাদেশে ব্যয় বা ভোগের মাত্রা নির্ধারণ করে মূলত তিনটি বিষয় – রফতানি আয়,রেমিটেন্স বা প্রবাসীদের পাঠানো টাকা আর অভ্যন্তরীণ অর্থের প্রচলন।

রফতানি এবং রেমিটেন্স থেকে আয় স্থিতিশীল থাকলেও, মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার বৃদ্ধি করায় অভ্যন্তরীণ অর্থের প্রচলন চাপের মুখে পরেছে, বলছেন মামুন রশিদ।

রশিদ বলছেন দুর্নীতি এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে দেশে যে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তা ব্যবসা-বাণিজ্যর উপর মারাত্মক, নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

“দেশে যখন দুর্নীতি এবং অঘোষিত আয় থেকে অনেক টাকা ভেসে বেড়ায়, তখন সেটা অর্থ পাচার বৃদ্ধি করে এবং দেশে ডলার আসা কমিয়ে দেয়,” রশিদ বলেন।

তৈরি পোশাক রফতানি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উপায়। ফাইল ফটোঃ ১৯ এপ্রিল, ২০১৯।

অর্থ পাচারের মহামারি

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক দুর্নীতি-বিরোধী সংস্থা গ্লোবাল ফাইনানশিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত, বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ৫.৫ বিলিয়ন (৫৫০ কোটি) ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।

রফতানি আয়ের সব অর্থও বাংলাদেশে পৌঁছায় না – প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার “ভুল ইনভয়েসিং”-এর মাধ্যমে বের করে নেয়া হয়।

“আমরা আমাদের বৈদেশিক আয় বাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছি,” রশিদ বলেন। “এর ফলে, বিদেশী বিমান সংস্থা, জাহাজ কোম্পানি বা বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা পাঠাতে পাড়ছে না। এই পরিস্থিতি একটি নেতিবাচক ধারনা সৃষ্টি করেছে যেটা এই সঙ্কটকে বাড়িয়ে তুলছে,” তিনি বলেন।

কোভিড মহামারি ২০২০ সালে শুরু হবার আগ পর্যন্ত, বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬ শতাংশর বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি ছিল তৈরি পোশাক রফতানি, কৃষি খাত এবং ব্রিজ এবং মহাসড়কের মত অবকাঠামোতে ব্যাপক সরকারি বিনিয়োগ।

পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ

বিশ্ব ব্যাংক ২০২১ সালে বাংলাদেশকে “একটি দুর্দান্ত উন্নয়ন কাহিনী” বলে বর্ণনা করে। জন্মলগ্নে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ। এক সময় যার পরিচিতি ছিল দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু মাত্র পাঁচ দশকের মধ্যে সেই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একটিতে পরিণত হয়।

তবে ডঃ ভট্টাচার্য বলেছেন, সেই প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে তাদের বেশ কিছু সন্দেহ ছিল। তিনি বলেন, জিডিপির পরিসংখ্যান অন্যান্য নির্দেশকের সাথে মেলেনি।

যেমন, উঁচু হারে প্রবৃদ্ধির জন্য যে হারে বিনিয়োগ, শিল্প-কারখানার জন্য মেশিনারি ও কাঁচামাল আমদানি, গ্যাস এবং অন্যান্য জ্বালানী সরবরাহে উন্নতি প্রয়োজন, সেগুলো তারা দেখতে পান নি।

তাঁর মতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটা অর্থনীতিতে বেশ কিছু কাঠামোগত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও হয়েছে – এবং ত্রুটিগুলো এখন প্রকট ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাঃ টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর অর্থনীতি চালেঞ্জের মুখে। ফটোঃ ৭ জানুয়ারি, ২০২৪।

দেশের সরকার ২০০৯ সালের পর থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়, কিন্তু তারপরও,গত ১৩-১৪ বছর ধরে জিডিপিতে প্রাইভেট বিনিয়োগের পরিমাণ ২৩ শতাংশ রয়ে গেছে। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ জিডিপির দুই শতাংশের কম।

অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি বাংলাদেশের “দুর্দান্ত কাহিনী” কিছুটা ম্লান করলেও, মামুন রশিদ মনে করেন বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং ইউএনডিপি’র মত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ঢাকার পাশেই আছে।

“তারা এখনো বাংলাদেশের উপর আস্থা রাখছে। সেজন্য বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের বহুপাক্ষিক সহায়তা আশা করতে পারে,” রশিদ বলেন।

একদিকে মামুন রশিদ আশাবাদী যে রফতানি আয় এবং ৬০ লক্ষ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আরও বাড়বে এবং প্রবৃদ্ধির হার পুনরায় ঊর্ধ্বমুখী হবে। অন্যদিকে ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, ব্যাংকিং, আর্থিক আর জ্বালানী খাতে আমূল সংস্কার না হলে দেশের বর্তমান “প্রবৃদ্ধির গল্প” আর ধরে রাখা যাবে না।

“বাস্তবতার মুখোমুখি হবার সময় এখন এসেছে,” তিনি বলেন।