বিশ্বের বৃহত্তম নির্বাচনে ভারতের প্রায় ১০০ কোটি লোক শুক্রবার থেকে ভোট দেয়া শুরু করতে যাচ্ছেন। এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তৃতীয়বার তাঁর পদে থাকতে চাইছেন।
মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি, কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্বে গঠিত বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছে। এই বিরোধী জোটটি গঠিত হয় মোদির প্রতি একতাবদ্ধ চ্যালেঞ্জস্বরূপ, কারণ ব্যাপক ভাবে মনে করা হয় এই নির্বাচনে মোদী একজন সম্মুখসারির প্রতিদ্বন্দ্বি।
মোদী তাঁর সর্বোত্তম সাফল্য হিসেবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দরিদ্রদের জন্য কল্যাণমূলক কার্যক্রমকে তুলে ধরেন। নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে তিনি বিশাল সংখ্যক জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেন তাঁকে ভোট দিতে যাতে এটা নিশ্চিত করা যায় যে তিনি এই গতি অব্যাহত রাখতে পারেন এবং ২০৪৭ সাল নাগাদ ভারত একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
গত সপ্তাহে তাঁর দলের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করে বলেন,“গত ১০ বছরে ২৫ কোটি লোককে দারিদ্র থেকে উদ্ধার করে আমরা প্রমাণ করেছি যে আমরা সুফল পাওয়ার জন্য কাজ করি।”
দুই ডজনেরও বেশি বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়ান্স বা আইএনডিএ (ইন্ডিয়া) বেকারত্বের বিষয়টিকে তুলে ধরেছে এবং তারা বলছে এটি হচ্ছে দেশের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচিতির বিরুদ্ধে হুমকি। তারা বলছে এগুলোই হচ্ছে এবারকার প্রতিযোগিতার মূল বিষয়।
তারা হিন্দুপন্থি নেতাদের বিরুদ্ধে দেশকে ধর্মীয় ভাবে মেরুকরণের এবং ফেডারেল তদন্ত দপ্তরগুলোর মাধ্যমে দূর্নীতির তদন্ত করিয়ে বিরোধীদের দূর্বল করার অভিযোগ করে।
অরবিন্দ কেজরিভাল গ্রেপ্তার
এই নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগেই একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, দিল্লির মূখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিভালকে দূর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। সরকার অস্বীকার করছে যে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণীত তদন্ত।
প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির ম্যানিফেস্টো এ মাসে প্রকাশের সময়ে দলটির নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, ”মূলত এই নির্বাচন অন্যান্য নির্বাচন থেকে ভিন্ন। আমার মনে হয় না আজকের মতো গণতন্ত্র এমন ঝুঁকির মুখে পড়েনি, সংবিধানও এমন ঝুঁকির মুখে পড়েনি”।
রাহুল গান্ধীকে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেবে দেখানো হচ্ছে না, তাকে প্রধানত মোদীর প্রধান চ্যালেঞ্জার হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভোটদাতারা আগামি ছয় সপ্তাহে মোদী ও বিরোধীদের দেয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিবরণীর মধ্যে একটিকে বেছে নেবে। ভারতের লোক সভার ৫৪৫টি আসনের মধ্যে ৫৪৩টি আসনের জন্য ১ জুন পর্যন্ত সাতটি পর্যায়ে ভোট গ্রহণ করা হবে। ভোট গণনা করা হবে ৪ জুন ।
বিরতি দিয়ে ভোট গ্রহণ কর্মসূচীর কারণে নিরাপত্তা বাহিনী সারা দেশে ঘুরে ঘুরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।
সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে যে মোদী সহজেই পর পর তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হবেন। এই ব্যতিক্রমী বিষয়টি ঘটেছিল একমাত্র ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাওয়াহারলাল নেহরুর ক্ষেত্রে।
স্বাধীনতার পর সব চেয়ে প্রভাবশালী দল কংগ্রেস পার্টিকে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে গিয়ে ১০ বছর ধরে মোদী ক্ষমতায় রয়েছেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এখনও ব্যাপক জনপ্রিয়।
তাঁকে এমন একজন শক্তিশালী, জাতীয়তাবাদী হিন্দুপন্থি নেতা হিসেবে দেখা হয় যিনি উন্নয়নকে দ্রুত এগিয়ে নিয়েছেন, বিশ্বে ভারতের মর্যাদাকে বাড়িয়ে তুলেছেন এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন, যেমন ভাঙা মসজিদের উপর হিন্দু দেবতা রামের নামে মন্দির নির্মাণ করেছেন যা কীনা ঐ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ভক্তদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।
নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সন্দীপ শাস্ত্রী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিকে সম্বল করেই বিজেপি এই নির্বাচনে যাচ্ছে। তারা স্পষ্টত মোদীর বিষয়টিকে সামনে রাখছে। তাতে ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলের বিরুদ্ধে যে মনোভাব দেখা দেয় তাকে অনেকাংশেই প্রশমিত করবে।”
ক্ষমতায় থাকা দলের বিরুদ্ধে যে মনোভাব তার মূলে আছে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ যা কীনা সাম্প্রতিক এক জরিপে জনগণের জন্য মূল দু’টি বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও ভারতের অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন ঘটছে, তরুণ শিক্ষিত লোকেরা চাকরি পেতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন।
ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লির একটি ব্যস্ত বাজার এলাকায় অর্থনীতির হালচাল সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। সফটওয়ার প্রকৌশলী রুশিল মাত্তার মতো কেউ কেউ এ ব্যাপারে বেশ উত্সাহী ।
আগে যেমন উন্নততর সুযোগের জন্য সফটওয়ারের পেশাজীবিরা পাশ্চাত্য দেশে চলে যেত সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মাত্তা বলেন,“আমি অত্যন্ত আশাবাদী। এই দেশকে নিয়ে আমার আশা আছে এবং আমি এখানেই থাকছি।“
তবে অনুরূপ অনুভূতি অন্যদের নেই। যেমন একজন ফেরিওয়ালা সুরিন্দর ওঝা যিনি বাজারে থলে বিক্রি করেন । তিনি বলেন,“ জীবন নির্বাহ করাটাই একটা সমস্যা। কিন্তু গরীবদের জন্য এ সমস্যার সমাধান করে না কোন সরকার।”
ভোটদাতাদের সমর্থন পাবার জন্য, প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস পার্টি সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধির এবং নারীদের জন্য কল্যাণমূলক ভাতা প্রদান এবং ৩০ লক্ষ লোককে সরকারি চাকরি দেয়া ও কলেজ শিক্ষার্থীদের অ্যাপ্রেন্টিসশীপ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা তাদের কথায় মোদীর আমলে গণতন্ত্রকে পিছিয়ে নেয়ার বিপরীতে গণতন্ত্রকে আবার এগিয়ে নেয়ারও সংকল্প ব্যক্ত করে।
রাহুল গান্ধীর মিছিল
কগ্রেস পার্টির প্রতি সংকল্প আদায়ের জন্য গত ১৮ মাসে রাহুল গান্ধী দু’বার দেশব্যাপী মিছিল করেছেন তবে এটা পরিস্কার নয় যে এর ফলে কংগ্রেস পার্টির পক্ষে ভোটে সমর্থন বাড়বে কীনা।
গত দুটি নির্বাচনে পিছিয়ে পড়ার কারণে সংসদে দলটির এখন মাত্র ৫২টি আসন রয়েছে এবং অনেকেই মনে করেন যে মোদির বিরুদ্ধে তিনি অকার্যকর নেতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীরজা চৌধুরী বলছেন, “মোদীর কথা যত দূর বলা যায়, বিরোধী দলে তাঁর সমতূল্য কেউ নেই। অনেক লোক যারা বিজেপি শাসনে অসন্তুষ্ট এবং অর্থনৈতিক অভাব ও মূল্যবৃদ্ধির সম্মুখীন তারা এ নিয়ে কথা বলে, কিন্তু আবার পেছনে ফিরে বলে, অন্য দিকে আর কেই বা আছে?”
আইএনডিএ (ইন্ডিয়া) গোষ্ঠটির আশা প্রধানত নির্ভর করছে বিজেপির বিরুদ্ধে যাতে বিরোধী ভোট ভাগ না হয়ে যায় সে জন্য অভিন্ন প্রার্থীদের দাঁড় করানো। এই অবধি তাঁরা কোন কোন রাজ্যে সেটা করতে সমর্থ হয়েছে।
এই জোটের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলি শক্তিশালী আঞ্চলিক দল তবে ভারতীয় নেতার বিপক্ষে অভিন্ন কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্লেষক শাস্ত্রী বলছেন, “তাদের সামনে ইস্যুগুলি রয়েছে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তারা কি এগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে ভোটদাতাদের সামনে আনতে পারবে। আমরা যা দেখছি তা হলো জোটের প্রতিটি সদস্য তাদের নিজেদের মতো করে কথা বলছেন, যেমন তারা নিজেদের ম্যানিফেস্টো নিয়ে কথা বলছন।
"আপনি যদি সরকারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণ করতে চান, আপনার থাকতে হবে স্পষ্ট কৌশল, কিন্তু সেটাতো মনে হচ্ছে নেই আর সেটাই তাদেরকে কোন কোন ক্ষেত্রে নামিয়ে আনছে।”
জরিপে অনুমান করা হচ্ছে মোদির বিজেপি ২০১৯ সালের বিজয়কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখন তারা পেয়েছিল ৩০৩টি আসন কিন্তু কংগ্রেস পার্টি বলছে ৪ জুন যখন ভোট গণনা করা হবে তখন দেখা যাবে অনুমানের তূলনায় ভোটের ফলাফল হবে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক।