প্রেসিডেন্ট বাইডেনঃ গাজায় সমুদ্রপথে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য অস্থায়ী জেটি নির্মাণের নির্দেশ

ভাষণের মাঝে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন । পেছনে (বাঁয়ে) ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস এবং স্পিকার মাইক জন্সন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেশের সংসদ, কংগ্রেসের যৌথ সভায় 'স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন' নামে পরিচিত বার্ষিক ভাষণে, গাজায় মানবিক সহায়তার জন্য তাঁর নতুন একটি উদ্যোগ ঘোষণা করেন।

“আজ আমি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছি, ভূমধ্যসাগরে গাজা উপকূলে অস্থায়ী জেটি স্থাপন করার জন্য, যেখানে খাবার, পানি, ওষুধ এবং অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র বহনকারী বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে।"

“এই অস্থায়ী জেটির ফলে, বিশাল পরিমাণ মানবিক সাহায্য প্রতিদিন গাজায় ঢুকতে পারবে,” তিনি বলেন। তবে তিনি বলেন “কোন আমেরিকান সৈন্য ভূখণ্ডে নামবে না।"

প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর ভাষণে গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গে বলেন, হামাস এই যুদ্ধ শেষ করতে পারে, “জিম্মিদের মুক্তি দিয়ে, অস্ত্র সমর্পণ করে এবং ৭ অক্টোবর হামলার সাথে জড়িতদের ধরিয়ে দিয়ে।”

“এই সঙ্কট শুরু হয় ৭ অক্টোবর, হামাস সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে,” তিনি বলেন।

তিনি বলেন ১,২০০ নিরীহ নারী, পুরুষ, ছেলে, মেয়েকে হত্যা করা হয়, অনেকে যৌন আক্রমণের শিকার হন।

“হামাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার ইসরাইলের আছে,” তিনি বলেন।

বাইডেন আরও বলেন, হামাস “বেসামরিক লোকজনের মাঝে লুকিয়ে থাকে এবং কাজ চালায়,” তাই ইসরাইলের উপর বাড়তি দায়িত্ব আছে।

“তবে ইসরাইলের মৌলিক দায়িত্বও রয়েছে, গাজার নিরীহ জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ রাখার,” তিনি বলেন।

“ত্রিশ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন, যাদের বেশির ভাগ হামাস নয়। এদের হাজার হাজার, নিরীহ নারী ও শিশু। প্রায় দুই কোটি ফিলিস্তিনি গৃহচ্যুত হয়েছেন এবং বোমাবর্ষণের শিকার হচ্ছেন,” বাইডেন বলেন।

তিনি বলেন যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য, যেটা অন্তত ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হবে।

ভাষণ শেষে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সামরিক প্রধানদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন।

ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন

ভাষণের শুরুতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ইউক্রেনে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়ার আগ্রাসনের দিকে। বাইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন জানিয়ে যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেন দেশে-বিদেশে গণতন্ত্র আক্রমণের মুখে, এবং রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করে ইউরোপ জুড়ে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

“এই ঘরে যদি কেউ মনে করেন যে পুতিন ইউক্রেনেই থামবে, আমি তাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি, তিনি থামবেন না,” বাইডেন বলেন।

“কিন্তু আমরা যদি ইউক্রেনের পাশে থাকি এবং নিজেদের রক্ষা করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করি, তাহলে ইউক্রেন পুতিনকে থামাতে পারবে। ইউক্রেন শুধু সেটাই চাচ্ছে। তারা আমেরিকান সৈন্য চাইছে না,” তিনি বলেন।

তিনি বলেন রাশিয়ার আগ্রাসন রোধে যুক্তরাষ্ট্র কোন সৈন্য পাঠাবে না।

“ইউক্রেনে কোন আমেরিকান সৈন্য যুদ্ধে লিপ্ত নেই। এবং আমি সেভাবে রাখতে বদ্ধপরিকর,’’ বাইডেন বলেন।

বাইডেন অভিযোগ করেন যে ইউক্রেনের জন্য সাহায্য আটকে দিচ্ছে “যারা বিশ্বে আমেরিকান নেতৃত্ব চায় না।”

“পুতিনকে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। ইতিহাস তাকিয়ে দেখছে,” তিনি বলেন।

তিনি বলেন যুক্তরাষ্ট্র যদি মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তাহলে ইউক্রেন হুমকির মুখে পড়বে। “ইউরোপ হুমকির মুখে পড়বে। মুক্ত বিশ্ব হুমকির মুখে পড়বে। যারা তাদের ক্ষতি করতে চায়, তাদের সাহস বাড়বে।"

“পুতিনের জন্য আমার বার্তা খুব সোজা-সাপটা। আমরা মুখ ঘুরিয়ে নেব না। আমরা মাথা নত করবো না। আমি মাথা নত করবো না,” প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন।

স্টেট অফ দ্য নেশন ভাষণের সময় কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন দেখাতে কেফিয়েহ পরে আসেন।

চীনের সাথে সম্পর্ক

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, তিনি অনেক বছর ধরে রিপাবলিকান পার্টির “বন্ধু” এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে শুনেছেন যে চীনের অগ্রগতি হচ্ছে, আর আমেরিকা পিছিয়ে পড়ছে।

“তারা বিষয়টি উল্টা করে দেখছেন। আমেরিকা আগাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি বিশ্বের সেরা অর্থনীতি। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর আমাদের দেশজ উৎপাদন বেড়ে গেছে।"

“চীনের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি এক দশকের বেশি সময়ে সবচেয়ে কম। আমরা চীনের অন্যায্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছি,” তিনি বলেন।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান প্রণালিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কাজ করছে, এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জোট নতুন করে সক্রিয় করছে।

“আমি নিশ্চিত করেছি যে, সব চেয়ে আধুনিক আমেরিকান প্রযুক্তি চীনা সামরিক সরঞ্জামে ব্যবহার করা যাবে না,” তিনি বলেন।

তবে তিনি বলেন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে প্রতিযোগিতা চায়, সংঘাত নয়।

“চীন বা অন্য কারো সাথে একুশ শতকের প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করার জন্য আমেরিকা খুব শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে,” তিনি বলেন।

ভাষণ শেষে প্রেসিডেন্ট বাইডেন হাউস স্পিকার মাইক জন্সনের সাথে করমর্দন করছেন।

নারী অধিকার

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ভাষণের সিংহভাগ জুড়ে ছিল অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, যার মধ্যে একটি ছিল নারী অধিকার।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর ভাষণে নারী অধিকার, বিশেষ করে গর্ভপাতের অধিকার ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করেন। এই বিতর্কের মুলে রয়েছে ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সুপ্রিম কোর্টের এক সিদ্ধান্ত, যেটা 'রো বনাম ওয়েড' নামে পরিচিত। এই রায় আমেরিকান নারীদের কিছু বিধি-নিষেধের মধ্যে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দেয়। কিন্তু ২০২২ সালের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্ট 'রো বনাম ওয়েড' মামলার রায় নাকচ করে দেয়।

বাইডেন বলেন, “রো বনাম ওয়েড রায় পাল্টে দেয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তে লেখে, ‘নারীরা রাজনৈতিক বা নির্বাচনী ক্ষমতাবিহীন নয়।‘ আপনি মশকরা করছেন না! বোঝা যাচ্ছে, যারা রো বনাম ওয়েড বাতিলের পক্ষে সোচ্চার, যে আমেরিকায় নারীদের ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই নেই। কিন্তু প্রজনন অধিকার যখন ব্যালটে ছিল, ২০২২, ২০২৩ সালে তারা জয়ী হয়, এবং ২০২৪ সালে তারা আবার বুঝতে পারবে।"

“আমেরিকানরা যদি এমন কংগ্রেস নির্বাচিত করে যারা সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সমর্থন করে, তাহলে আমি কথা দিচ্ছিঃ আমি রো বনাম ওয়েড আবার দেশের আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবো,” তিনি বলেন।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন নভেম্বরের নির্বাচনে ২০২০ সালের মত রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ ডনাল্ড ট্রাম্পের মুখোমুখি হবেন। তাঁর ভাষণে ৮১-বছর বয়স্ক বাইডেন নিজের মূল্যবোধ ব্যাখ্যা করার সময় প্রায় সমবয়সী ট্রাম্পের নাম না করেও তাঁর দিকে ইঙ্গিত করেন।

“আমার জীবন আমাকে শিখিয়েছে স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের উপর আস্থা রাখতে। যে মৌলিক মূল্যবোধ আমেরিকাকে সংজ্ঞায়িত করে, সেই সততা, আত্মসম্মান, সমতার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। সবাইকে সম্মান করা। সবাইকে ন্যায্য সুযোগ দেয়া। ঘৃণাকে কোন নিরাপদ স্থান না দেয়া।"

“এখন, আমার বয়সী কেউ ভিন্ন একটা দৃশ্য দেখেন: আমেরিকার গল্প যেখানে রয়েছে অসন্তোষ, প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসা। সেটা আমি নই,” বাইডেন বলেন।