২০১৯ সালে বিতর্কিত কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসন রদ করে নয়াদিল্লি সরাসরি এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো উপত্যকার প্রধান শহরে সরকারি সফর করলেন।
শ্রীনগরের এক ফুটবল স্টেডিয়ামে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে মোদি নানা উন্নয়ন প্রকল্পের ঘোষণা করেন এবং বলেন এই অঞ্চলের অধুনা-বাতিল বিশেষ মর্যাদা নিয়ে আগের সরকারগুলি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।
তিনি জনতাকে বলেন, “জম্মু ও কাশ্মীরের সাফল্যের গল্প বিশ্বের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।” ২০১৯ সালের পদক্ষেপের পর এই অঞ্চল সমৃদ্ধশালী হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমি সব সময় বলেছি, আপনাদের হৃদয় জয় করার জন্য আমি কঠোর পরিশ্রম করছি। আপনাদের হৃদয় জিততে আমি আরও কাজ করে যাবো।”
কাশ্মীরের ভারতপন্থী দলগুলির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, কাশ্মীরিদের বিভ্রান্ত করা ও এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রচারের অভিযোগ তুলেছেন মোদি ও তাঁর দল। কাশ্মীরের রাজনীতিকরা বলেন, তাদের বিশেষ মর্যাদা ছিল একটি সাংবিধানিক নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি। তারা মোদিকে বিভাজনকারী ও সংখ্যালঘু-বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন।
কয়েক হাজার সশস্ত্র আধা সামরিক সদস্য ও বিশেষ জ্যাকেট পরিহিত পুলিশ গোটা কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে বাড়তি নজরদারি বজায় রাখে। মুসলিম সংখ্যাগুরু এই অঞ্চলে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। এখানকার অনেক বাসিন্দা জোরালোভাবে স্বাধীনতা বা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পক্ষে। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা পরিবর্তনের পর মোদি দু’বার হিন্দু-অধ্যুষিত জম্মু শহরে সফর করেছিলেন।
এই অঞ্চলে নির্বাচন আয়োজন বা রাজ্য হিসেবে পুনরায় একে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে মোদি তার পরিকল্পনা ব্যক্ত করেননি, অথচ কাশ্মীরের ভারতপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এই দুটি দাবি নিয়ে সরব। ২০১৪ সালে শেষবার এই অঞ্চলে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু ২০১৮ সালে নির্বাচিত সরকারকে বাতিল করা হয়।
২০১৯ সালে মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী-নেতৃত্বাধীন সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের আধা-স্বশাসনের মর্যাদা রদ করে, তাদের পৃথক সংবিধানকে বাতিল করে, এই অঞ্চলকে দুটি ফেডারেল ভূখণ্ডে (লাদাখ ও জম্মু-কাশ্মীর) ভাগ করে এবং এখানকার জমি ও চাকরির উপর স্থানীয়দের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অধিকার ও সুরক্ষাকবচ কেড়ে নেয়। মুসলিম-অধ্যুষিত এই অঞ্চলকে বর্তমানে অনির্বাচিত সরকারি কর্মকর্তা ও আমলারা পরিচালনা করেন।
ভারতের ক্ষমতাধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নির্বাচনের পর এই অঞ্চল তার রাজ্য-পরিচয় ফিরে পাবে। ডিসেম্বরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালের সিদ্ধান্তকে বহাল রাখে এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দেয় সরকারকে।
২০১৯ সাল থেকে এই অঞ্চল কোণঠাসা হয়ে রয়েছে কেননা কর্তৃপক্ষ এমন কিছু নতুন আইন আরোপ করেছে যা কাশ্মীরের জনবিন্যাসকেই বদলে দিতে পারে বলে বহু স্থানীয় বাসিন্দা আশঙ্কা করে। যদিও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হরণের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিল ভারতের সিংহভাগ। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য সমর্থকরা মোদি সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
নয়াদিল্লি এক “নতুন কাশ্মীর” গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে এবং এই উদ্যোগে ভারত বিরুদ্ধ স্বর ও ভিন্ন মত নিয়ে কোনও সহিষ্ণুতা দেখায়নি। পাশাপাশি নাগরিকদের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে এবং গণমাধ্যমকে হেনস্থা করা হয়েছে।
মোদির শ্রীনগর সফরের আগে সরকারি বাহিনী গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর রাস্তায় নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিয়েছে ও চেকপয়েন্ট খাড়া করেছে। তারা যথেচ্ছভাবে বাসিন্দা ও গাড়ি তল্লাশি করছে। এই শহরের ভিতর দিয়ে সর্পিল গতিতে বয়ে যাওয়া ঝিলম নদীতে মোটরচালিত নৌকায় টহল দিচ্ছে নৌসেনারা।
১৯৮৯ সাল থেকে এই ধরনের নিরাপত্তাগত পদক্ষেপ কাশ্মীরে ভীষণ পরিচিত। ওই বছর ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা লড়াই শুরু করেছিল।
কাশ্মীর অঞ্চলটি ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত। উভয় দেশই হিমালয়ের এই অঞ্চলের সবটুকুকে নিজেদের বলে দাবি করে। ভারত জোর দিয়ে বলে, কাশ্মীরি জঙ্গিবাদ কার্যত পাকিস্তানের সাহায্যপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং অধিকাংশ কাশ্মীরিই একে স্বাধীনতার বৈধ সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করে। এখানকার সংঘাতে কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিক, বিদ্রোহী ও সরকারি কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।