বিএনপির ১৫ নেতাকর্মীর কারা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ, সরকারের কাছে তথ্য নেই!

প্রতীকী ছবি

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে করে গ্রেফতার হওয়ার নেতাকর্মীদের মধ্যে ১৫ জন কারা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ তুলেছে বিএনপি। রিমান্ডের নামে ‘নির্যাতন’ এবং কারাগারে চিকিৎসার ‘অবহেলায়’ এসব নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ করে আন্তর্জাতিকভাবে তার তদন্ত এবং ক্ষতিপূরণের দাবিতে আদালতে রিট দায়ের করেছে দলটি। অন্যদিকে সরকার বলছে- কারাগারে বিএনপির এতো নেতাকর্মীর মৃত্যুর তথ্য তাদের জানা নেই। ‘মিথ্যাচারের’ রাজনীতির কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপি এসব অভিযোগ আনছে।

বিএনপির নেতাকর্মী বলে নয়, কারাগারে কোনও মৃত্যুই কাম্য নয় বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন- কর্তৃপক্ষের অবহেলায় কারও মৃত্যু হলে থাকলে সেটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাই বিএনপির অভিযোগের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্তে এসব মৃত্যুর পেছনে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়ার উচিত। আর মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও এসব মৃত্যুর বিষয়ে পর্যালোচনা ও তদন্ত করা দরকার।

কারাগারে মারা যাওয়া বিএনপির নেতাদের তালিকা

গত ১১ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে কারাগারে বিএনপির ১৫ নেতাকর্মীর মৃত্যুর অভিযোগ তুলে ধরেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি অভিযোগ করেন, "প্রত্যেকটি মৃত্যু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারা সেলগুলোকে একেকটি শ্বাসরুদ্ধকর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করা হয়েছে। প্রতিটি কারাগারে কারাবিধির সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিয়ে বন্দি নেতা-কর্মীদের ওপর বীভৎস নিপীড়ন চালানো হচ্ছে।"

বিএনপির কাছ থেকে কারাগারে মারা যাওয়া নেতাকর্মীদের একটি তালিকা সংগ্রহ করে ভয়েস অফ আমেরিকা। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট মাস থেকে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, অর্থাৎ গত ৬ মাসে দেশের বিভিন্ন কারাগারে দলটির ১৫ জন নেতাকর্মী মারা গেছেন।

  • বিএনপির তালিকায় দেখা যায়, সর্বশেষ চলতি মাসের ৮ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলা কারাগারে মারা যান লক্ষীটারি ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মনোয়ারুল ইসলাম। তাকে গত ১৩ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়।
  • বিগত ৩ জানুয়ারি বাগেরহাট জেলা কারাগারে মারা যান খুলনা বটিয়াঘাট উপজেলা যুবদলের সদস্য মো. কামাল হোসেন মিজান। তাকে গত ১১ নভেম্বর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গ্রেফতার করে।
  • বিগত ২৯ জুলাই গ্রেফতার করা হয় ঢাকা মহানগর বিএনপির ৫৩ নং ওয়ার্ডের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলীকে। ১০ আগস্ট কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রৗয় কারাগারে মারা যান এই নেতা।
  • ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির মালিবাগ রেলগেট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশারকে গ্রেফতার করা হয়। নাশকতার অভিযোগসহ একাধিক মামলার আসামি বিএনপির এই নেতা ৮ আগস্ট কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রৗয় কারাগারে মারা যান।
  • একই বছরের ১৪ জুলাই পাবনার ইশ্বরীর পাকশী ইউনিয়নের বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কামাল আজাদকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি রাজশাহী কারাগারে মারা যান।
  • ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ৩৯ নং ওয়ার্ড সহ-সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলকে গ্রেফতার করা হয়। ৩৭ দিনের মাথায় ২৯ নভেম্বর কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রৗয় কারাগারে মারা যান বিএনপির এই নেতা।
  • ওই বছরের ২৭ অক্টোবর চট্রগ্রাম মহানগর ৫ নং ওয়ার্ডের সহ-সভাপতি গোলাপুর রহমান গোলাপকে গ্রেফতার করা হয়। ২৯ দিনের মাথায় ২৫ নভেম্বর কেরানীগঞ্জ কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন একাধিক মামলার আসামি বিএনপির এই নেতা।
  • বিগত ২৮ অক্টোবর গাজীপুরের শ্রীপুর কাওরাইদ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান হীরাকে গ্রেফতার করা হয়। আর ১ ডিসেম্বর কাশিমপুর কারাগারে মারা যান তিনি।
  • ২০২৩-এর ১৮ নভেম্বর নাশকতার মামলায় গ্রেফতার করা হয় নাটোর সিংড়ার হাতিয়ান্দহ যুবদলের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ। আর ২০ দিন পর কারা হেফাজতে থাকাধীন ৭ ডিসেম্বর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান এই যুব নেতা।
  • আর একই বছরের ১৭ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় রাজশাহীর কাকনহাট পেরসভার ৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। আর ২৪ দিনের মাথায় ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কারাগারে মারা যান এই নেতা।
  • বিদায়ী বছরের ২৭ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় নাজিরপুর পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মতিবুল মণ্ডল। ২৪ দিনের মাথায় ২০ ডিসেম্বর নওগাঁ কারাগারে মারা যান মতিবুল মণ্ডল।
  • বিগত ২৬ অক্টোবর নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় গাজীপুর কাপাসিয়ার ইউনিয়নের দূর্গাপুর ২নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. শফিউদ্দিন মাস্টার। আর ২৫ ডিসেম্বর কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় এই নেতার।
  • বিগত ২৬ অক্টোবর নাশকতার মামলায় গ্রেফতার করা হয় রাজধানীর মুগধা থানা ৭ নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ফজলুল রহমান কাজলকে। আর ২৮ ডিসেম্বর কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান এই নেতা।
  • ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর একাধিক মামলার আসামি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মহসিনুল মূলককে গ্রেফতার করা হয়। বিগত ২০ মে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান তিনি।
  • ২০২১ সালে গ্রেফতার করা হয় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি সাতক্ষীরা কলারোয়া উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নেতা আব্দুস সাত্তারকে। আর বিগত ২৮ জানুয়ারি তিনি সাতক্ষীরা কারাগারে মারা যায়।

(প্রতীকী ছবি)

মারা যাওয়া নেতাদের স্বজনরা যা বলছেন

বিএনপির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা কারাগারে মারা যাওয়া ১৫ নেতার পরিবারের মধ্যে থেকে ৫ টি পরিবারের সঙ্গে কথা হয় ভয়েস অফ আমেরিকার। তাদের মধ্যে ৪ টি পরিবার বলছে, গ্রেফতার হওয়ার আগে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। একটি পরিবার বলছে- সেই নেতার শ্বাস কষ্টের সমস্যা ছিলো।

৩ জানুয়ারি মারা যাওয়া মো. কামাল হোসেনের বড় মেয়ে মিতু ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "মৃত্যুর আগের দিন ২ জানুয়ারি মোবাইল ফোনে তার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছিলো। তিনি জানিয়েছিলেন- সুস্থ আছেন। কিন্তু ৩ জানুয়ারি সকালে তাদেরকে কারাগার থেকে ফোন করে বলা হয় বাবা অসুস্থ, জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। তার ১০ মিনিট পরে আবার ফোন করে জানানো হয় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন তিনি। অথচ তার বাবা সুস্থ মানুষ ছিলেন।"

মিতুর অভিযোগ, ২ জানুয়ারি রাতে তার বাবা মারা গেছেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ৩ জানুয়ারি জানিয়েছে। বিএনপির রাজনীতি করার কারণে তার বাবার নামে একাধিক মামলা হয়েছিলো।

২৫ নভেম্বর কেনারীগঞ্জ কারাগারে মারা যাওয়া গোলাপুর রহমান গোলাপের ছেলে মিজানুর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, তার বাবাকে নাশকতার মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিলো। আর ২৫ নভেম্বর কারাগার থেকে ফোন করে জানানো হয় বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। যদিও গ্রেফতারের আগে বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন।

১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কারাগারে মারা যাওয়া মনিরুল ইসলামের বড় ছেলে আশিক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "বাবার নামে কোনও মামলা ছিলো না। বাবার ছোট একটা দোকান ছিলো। গত ১৭ নভেম্বর রাতে সাদা পোশাকের ২ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দোকান থেকে বাবাকে নিয়ে যায়। পরে নাশকতার মামলার অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়।"

তিনি আরও বলেন, "১১ ডিসেম্বর কারা কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ফোন করে জানান বাবা মারা গেছেন। পরে তাদেরকে জানানো হয়, স্ট্রোকে বাবা মারা গেছেন। কিন্তু আমার বাবা সুস্থ মানুষ ছিলো। কিভাবে তার স্ট্রোক করলো আমরা কিছু জানি না। তারা তো সবকিছু গোপন করবেই নিজেদেরকে বাচাঁনোর জন্য। কিন্তু তাদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া তো উপায় নেই আমাদের।"

কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় গত ২৫ ডিসেম্বর একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্কুল শিক্ষক মো. শফিউদ্দিন। তার বড় ছেলে সোহেল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, বাবা একটি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তার নামে কোনও মামলা ছিলো না। তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। গ্রেফতারের পর তাকে একটি মামলার অজ্ঞাত আসামি করা হয়।

গ্রেফতারের পর বাবা খুব কষ্ট পেয়েছেন বলে উল্লেখ করে সোহেল বলেন, "যেদিন তাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়, তিনি খুব হতাশ হয়ে পড়েন, চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। যার ফলে, কারাগারে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। পরে কারা কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে ভর্তি করান, সেখানে তিনি মারা যান।"

কারা হেফাজতে থাকাকালীন রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফজলুল রহমান। তার বড় মেয়ে খাদিজা আক্তার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "গ্রেফতারের সময় বাবা সুস্থ ছিলেন। কিন্তু কারাগারে কি হয়েছে আমরা তো দেখি নাই। পরে বাবা নাকি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলো। মারা যাওয়ার ২ দিন আগে তাকে একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদেরকে সেখানে দায়িত্ব থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশিক্ষন থাকতে দেয়নি। পরে ২৮ ডিসেম্বর আমাদেরকে জানানো হয় বাবা মারা গেছেন।"

মৃত্যুর দায় সরকারকে নিতে হবেঃ বিএনপি

কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় প্রতিটি মৃত্যর দায় সরকারকে নিতে হবে বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, "কেউ গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারে মারা যাক কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাক, তার দায় জেল কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে নিতে হবে। জেলখানায় মারা গেলো কি, বাইরে মারা গেলো সেটা বিষয় না। বিষয় হচ্ছে, কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় কেউ যদি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়, তারও দায় সরকারের।"

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, "কারা হেফাজতে যে মারা গেছে এটা তো সত্য। সেটা তো মিথ্যা না। কিভাবে মারা গেছে, না গেছে সেটা ভিন্ন কথা। আর সরকার তো স্বীকার করে নিয়েছে হাসপাতালে মারা গেছে।"

এক নেতাদের মৃত্যুর পর ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়নি বলে উল্লেখ করে গয়েশ্বর বলেন, "একজন অসুস্থ হওয়ার পর তাকে ডান্ডাবেড়ি পড়ানোর প্রয়োজন হলো কেন? জেলখানায় কিছু কিছু অপরাধ করার পর জেল কর্তৃপক্ষ কাউকে-কাউকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর প্রয়োজন বোধ করে। কিন্তু, তাকে চলাফেরা করানোর সময় কিংবা কোর্টে আনার সময় ডান্ডাবেড়ি এটা তো হয় না।"

গাজীপুরে বিএনপির নেতা আলী আজম মা মারা যাওয়ার পর ডান্ডাবেড়ি পরে জানাযায় অংশ নেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে গয়েশ্বর বলেন, "তাহলে তিনি ডান্ডাবেড়ি পরে কিভাবে কবরে একমুঠো মাটি দেবে? কিভাবে কবরে নামবে। একটা তো ধর্মীয় বিধান আছে নাকি।"

বিএনপির মিড়িয়া সেলের অন্যতম সদস্য শায়রুল কবির খান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "সভ্য রাষ্ট্রে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কারা হেফাজতে এভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী'র মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।"

মৃত্যুর আন্তর্জাতিক তদন্ত ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিএনপির রিট, আংশিক শুনানি

কারাগারে মারা যাওয়া ১৩ জন নেতা- কর্মীর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি গঠন এবং পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনা চেয়ে রিটের দায়ের করে বিএনপি।

১৯ ফেব্রুয়ারি সেই রিটের আংশিক শুনানি হয়েছে।

আদালতে রিটটি করে বিএনপির বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল।

১৫ জন নেতাকর্মী কারাগারে মারা গেলেও ১৩ জনের তদন্ত ও ক্ষতিপূরণের রিট কেন করা হয়েছে জানতে চাইলে কায়সার কামাল বলেন, "আমরা প্রথমে ১৩ জনের নাম পেয়েছিলাম, সেই অনুযায়ী রিট করেছি। এটা কোনও অসুবিধা নেই। পরবর্তীতে প্রয়োজন হলেও আরও নাম যুক্ত হবে।"

কায়সার কামাল বলেন, "একজন আইনজীবী হিসেবে যখন আমি রিটটি ফাইল করেছি, তখন সমস্ত আইন-কানুন দেখে করেছি। এখানে আইনের কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। আমরা যে কোর্টে গিয়েছি সেটি একটি ‘সাংবিধানিক আদালত’। আমাদের সংবিধান অনুসারে যে কোনও সাংবিধানিক কোর্টে ‘ইনহেরেন্ট পাওয়ার’ একটি টার্ম আছে। সেটা অনুযায়ী কোর্ট যদি মনে করলে আমাদের আবেদনের যুক্তিকতা আছে, তাহলে তিনি ক্ষতিপূরণ দিতে পারেন। সেটা ইতোপূর্বে রাষ্ট্রের গাফিলতির কারণে মৃত্যুর ঘটনায় অনেককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।"

মৃত্যু দুই রকমের হয়ে থাকে- একটি স্বাভাবিক মৃত্যু, আরেকটি অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে উল্লেখ করে কায়সার কামাল বলেন, "গত ৪-৫ মাসে ১৩-১৪ জন ‘রাজনৈতিক বন্দীরা’ মারা গেছে। তাদেরকে হঠকারীভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে। কথিত আছে গ্রেফতারের পর তাদেরকে রিমান্ডের নামে 'টর্চার' করা হয়েছে। 'টর্চারের' পরে তাদেরকে কারাগারে উপযুক্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সেই জন্য এসব মৃত্যুতে রাষ্ট্রের কোনও গাফিলতি আছে কিনা, সেটি নির্ধারণ করার জন্য আমরা আবেদন জানিয়েছি। তবে, এই তদন্তে কারা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে রাখা যাবে না। এখন সবকিছু নির্ভর করছে কোর্টের ওপর।"

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ এতো অল্প সময়ে এতো অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক বন্দি কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন নাই বলেও দাবি করেন কায়সার কামাল। তিনি বলেন, "রিট পিটিশন দায়ের এটাই অন্যমত কারণ। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, যারা মারা গেছেন তারা প্রত্যেক গ্রেফতার হওয়ার আগে সুষ্ঠু-স্বাভাবিক জীবন-যাপন করেছে। তারপর রিমান্ড-কারাগার, এই অবস্থায় দেখা গেছে ১৫ দিনের মধ্যে মারা গেছে। এই সুষ্ঠু মানুষগুলো কিভাবে কারা হেফাজতে মারা গেলো, সেটাই মূল প্রশ্ন। এসব মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা আমাদের প্রয়োজন।"

বিএনপির রিটের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "তারা রিট পিটিশনের জন্য আবেদন করেছে। যেহেতু এটি আদালতের বিষয় তাই...কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

মৃত্যুর তথ্য নেই, এগুলো বিএনপির ‘মিথ্যাচার,’ রাজনৈতিক কৌশলঃ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী


বিএনপির অভিযোগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমার জানামতে এই রকম কোনও মৃত্যু হয়নি। একটা হয়েছে (মৃত্যু), সেটা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হার্ট অ্যাটাক করে হয়েছে। তার বাইরে এরকম কিছুই হয়নি।"

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল

বিএনপির অভিযোগের তো শেষ নেই বলে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, "তারা এতো (মৃত্যু) কোথায় থেকে পেয়েছে, তারাই জানে, আমার জানা নেই। তারা সব কিছুতে ফেল করে এখন সব সময় মিথ্যা কথা বলে। এইগুলো তাদের রাজনৈতিক কৌশল।"

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, "বিএনপি একবার বললো- বিএনপির ৩০ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে আটকে রেখেছি আমরা। কিন্তু দেখা যায়, ২ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে গেলে দেড় হাজার জামিনে বের হয়ে যায়। এই রকম জামিন পাওয়া, আসা যাওয়ার মধ্যে হয়তো ২ হাজারের কম নেতাকর্মী কারাগারে আছে।"

১৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, "বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দল ক্রমাগত মিথ্যাচার এবং গুজবের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি বলে, ১৩ জনকে জেলখানায় মেরে ফেলা হয়েছে। জেলখানায় যারা আছেন তারাও মানুষ। তাদেরও মৃত্যু হতে পারে। জেলে বন্দি অবস্থায় মৃত্যু হবে না, সে কথা তারা বলে কী করে। জেলে যারা মারা গেছে তাদের নিজেদের নেতাকর্মী দাবি করে বিএনপি। কারা কারা মারা গেছে সেই তালিকা প্রকাশ করুক তারা।"

কারাগারে মৃত্যুর তদন্ত চায় সুশীল সমাজ

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুদমদার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "কারা হেফাজতে যদি বিএনপির এতো নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়ে থাকে, সেটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। এইগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। কারও অবহেলা বা দোষের কারণে যদি এটা হয়ে থাকে, তাহলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। কারণ কর্তৃপক্ষের গাফিলতির জন্য কারও মৃত্যু হয়, তাহলে আমরা কেউ নিরাপদ নয়। দল-মত নির্বিশেষে কোনও নাগরিক নিরাপদ নয়। তাই এটার সঠিক তদন্ত করে তার প্রকৃত কারণ বের হওয়া দরকার। এতে যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত হয় তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।"

মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "কারাগারে কারও মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়। এটা যে কেউ হোক না কেন। কোনও ব্যক্তি কারাগারে থাকা মানেই হচ্ছে রাষ্ট্রের হেফাজতে আছেন।"

তিনি আরও বলেন, "যাদের মানবাধিকার সংগঠন আছে তারা নিশ্চয় এসব মৃত্যুর তদন্ত করে দেখবে। এটা বের হওয়া উচিত কারাগারে কতজন মারা যাচ্ছে। শুধু বিএনপির নেতাকর্মী নয়, তার বাইরেও কতজন মারা যাচ্ছে, তাদের এইগুলো পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এসব মৃত্যুর পেছনে কারও অবহেলা আছে কিনা সেটা তদন্ত করে বের করা দরকার।"

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমরা ধরে নিলাম কারাগারে বিএনপির কারও ওপর নির্যাতন হয়নি। ধরেন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। কিন্তু অপ্রয়োজনে যখন কাউকে জেলে নিয়ে যান, সেটাই একটা টর্চার। তখন মানুষ তীব্র মানসিক চাপে পড়ে। জেলে যাওয়া তো কোনও আরামের ব্যাপার না। ওটাই আপনার ওপর মানসিক চাপ তৈরি করবে। ফলে, যারা মারা যাচ্ছে তাদের মৃত্যুর জন্য এই জেলে নেওয়াটাই দায়ী।"

তিনি আরও বলেন, "যে মানুষ জেলে যাওয়ার কথা ছিলো না, তখন যাওয়ার পরে এই ঘটনাগুলো ঘটে নিশ্চতভাবে এসব মৃত্যুর জন্য শতভাগ দায়ী সরকার। এইগুলোকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বলার যথেষ্ট যুক্তি আছে।"