কলকাতায় প্রথম বরফ আসে বস্টন থেকে, এক পাউন্ডের দাম ছিল এক টাকা

বস্টন থেকে প্রথম কলকাতায় পৌঁছায় স্বচ্ছ, পরিষ্কার বরফ। (ছবিঃ অ্যাডোবি স্টক।)

আঠেরোশো শতকে বস্টন এবং নিউ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন হ্রদ থেকে বরফ তুলে তা বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হত। ১৮৩৩ সালে বস্টন থেকে প্রথম কলকাতায় পৌঁছায় স্বচ্ছ, পরিষ্কার বরফ, যা সরাসরি পানীয়ে দিয়ে খাওয়া যাবে। তার আগে হুগলির চুঁচুড়া থেকে অপরিষ্কার এক রকম বরফ কলকাতায় আসত কিন্তু তা খাওয়া যেত না।

সেই সময়ে আইসক্রিমের নাম জানতেন না কলকাতার মানুষ। পানীয়ে দেওয়ার বরফ আসত সেই হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে।

১৮৪৩ সালে দক্ষিণ মুম্বইয়ের অ্যাপোলো রোড, এখন যা শহীদ ভগত সিং রোড নামে পরিচিত সেখানে একটি ১৬ ফুট লম্বা সাদা গোলাকৃতি ভবন ছিল। ছাদটা গম্বুজের মতো। সেই সময় এই ভবনটিকে বলা হত ‘বম্বে আইস হাউজ’। স্থানীয়রা একে বলতেন বরফের বাড়ি।

প্রায় ১৫০ টন বরফ মজুত করে রাখা যেত এই ভবনে। বিদেশ থেকে আসা বরফ তা এই ভবনেই জমা করে রাখা হত।

১৮৩০ সাল থেকে ১৮৭০ অবধি ব্রিটিশ ভারতে বরফ ছিল বিলাসের জিনিস। পানীয়ে এক টুকরো বরফ মিশিয়ে খাওয়া ছিল এক ধরনের বিলাসিতা, ধনীরাই একমাত্র তা উপভোগ করতে পারতেন।

উত্তর-পূর্ব আমেরিকা থেকে আমদানি করা হত বরফ। উনিশ শতকে এই বরফের ব্যবসা এতটাই জনপ্রিয় হয় যে তা নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন জনপ্রিয় ইংরেজ লেখক ডেভিড ডিকেনসন। বইটির নাম ছিল ‘দ্য নাইটিন্থ সেঞ্চুরি ইন্দো-আমেরিকান আইস ট্রেড।’

কলকাতায় বরফ পৌঁছালেও মূল সমস্যা ছিল তার সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে। ইতিহাস অনুযায়ী ‘টাস্কানি’ নামে একটি জাহাজে চাপিয়ে ১৮০ টনের মতো বরফ কাঠের গুঁড়ো, খড় ভর্তি বাক্সে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। কিন্তু চার মাসের সমুদ্রযাত্রায় অনেক বরফই গলে গিয়েছিল।

বরফ আসার পর, তা জনপ্রিয়ও হয় বাঙালি 'বাবু'দের মহলে। ব্রিটিশরাও কিনে নিয়েছিলেন সেই বরফ। শহরের উচ্চবিত্ত বাঙালিরাও বরফ কিনেছিলেন। কলকাতা শহরে তৈরি হল ‘আইস হাউজ’। কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজে ভালো লাভের মুখ দেখে বরফের ব্যবসা।

কথিত আছে মুঘল বাদশারা ব্যবহার করতেন হিমালয়ের বরফ। তবে তা সংরক্ষণের জন্য প্রচুর খরচ হত। অনেক শ্রমিকও লাগত।

হুগলিতেও তৈরি হত বরফ। অগভীর গর্তে জল জমিয়ে বরফ তৈরি করা হত। তবে তা ছিল অপরিষ্কার, খাওয়ার অযোগ্য। স্থানীয় নাম ছিল ‘হুগলি আইস’। তবে সেই দিশি বরফ স্বাদ ও গুণমানে যুক্তরাষ্ট্রের বরফের সমতুল ছিল না। তাই সেখানকার স্বচ্ছ, সুস্বাদু বরফ কলকাতায় এসে পৌঁছালে, তার চাহিদা হয় আকাশছোঁয়া।

ফ্রেডরিক টিউডর প্রথম ব্রিটিশ ভারতে নিয়ে আসেন ‘আমেরিকান আইস’। টিউডরকে সেই সময় বলা হত 'আইস কিং'। তবে আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর পেরিয়ে ভারতে সেই বরফ নিয়ে আসতে মাস চারেক সময় লেগে যেত। তাই সেই সময়ে টিউডর বরফ সংরক্ষণ করে নিয়ে আসার জন্য নানারকম পদ্ধতির প্রয়োগ করেছিলেন।

প্রথমেই চড়া দামে বরফ বিক্রি করেননি টিউডর। সেই সময়ে এক পাউন্ড বরফের দাম ছিল ১ টাকা। প্রথমে গঙ্গার ধারে, স্ট্র্যান্ডে আর তার পর বর্তমান ব্যাঙ্কশাল কোর্টের ঠিক পশ্চিমে, চার্চ লেনের দিকে মুখ করে তৈরি হয় ‘বরফ ঘর’।

আমদানি আর বরফ ঘরে সংরক্ষণেই মন দেন টিউডর। ওজন করে মেপে, প্যাকেট করে সেই বরফ পাঠানো হত শহরের 'বাবু'দের। তারপর তা যেত শৌখিন সাহেবদের মহলে। শহরের নানা জায়গায় খুচরো বন্টন কেন্দ্রও তৈরি হয় সেই সময়।

এই বরফ আমদানি নিয়ে প্রচলিত আছে নানা মজার গল্প। কথিত আছে, ১৮৩৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শহরে প্রথম আমেরিকান আইস এসে পৌঁছয়। ১৮০ টন থেকে কমে ১০০ টনের মতো বরফ জাহাজ থেকে নামানো হয়।

শহরবাসী এতদিন হুগলির সেই অপরিষ্কার বরফই দেখেছিলেন। এমন দুধসাদা, পরিষ্কার, স্বচ্ছ বরফ খণ্ডগুলো দেখে তারা প্রবল আনন্দিত হয়েছিলেন। শোনা যায়, একজন নাকি জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমেরিকায় বরফ কি গাছে হয়?’

৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজে বরফ নিয়ে আসতেন টিউডর। রাতে জাহাজ এসে পৌঁছত বন্দরে। বরফ নামিয়ে তা সরাসরি নিয়ে যাওয়া হত কলকাতার বিভিন্ন গুদামে। তবে ধনী অ্যাংলো সমাজই সেই বরফ কিনত।

১৮৭৮ সাল নাগাদ এই ব্যবসার শেষ ঘনিয়ে আসে। বরফকল তৈরি হতে থাকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। জাহাজে করে বরফ আসা বন্ধ হয়ে যায় পরের তিন-চার বছরের মধ্যেই। ১৮৮২ সালে কলকাতার 'আইস হাউজ' ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ১৯২০ সালে নষ্ট করে ফেলা হয় বম্বের :বরফের বাড়ি'। চেন্নাইয়ের 'বরফ ঘর' নষ্ট করা হলেও তা এখন বসত বাড়ি হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। বিদেশি বরফের অস্তিত্বই মুছে যায় দেশের প্রেসিডেন্সি শহরগুলো থেকে।