ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে জাঁকজমকপূর্ণ এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দু দেবতা রামের বিশাল মন্দির সে দেশের এমন এক স্থানে সোমবার উদ্বোধন করা হলো যে-স্থানকে রামের জন্মভূমি বলে বিশ্বাস করে লক্ষ লক্ষ মানুষ।
এই অনুষ্ঠান হল লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে, যখন নরেন্দ্র মোদী তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফেরার জন্য লড়াই করবেন।
বিগত ৩৫ বছর ধরে মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মূল প্রতিশ্রুতি ছিল তারা রাম মন্দির নির্মাণ করবে। এই বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যুটি বিজেপিকে বিশেষ মর্যাদা ও ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করেছিল।
হিন্দু গোষ্ঠীগুলি ভারতের উত্তরাঞ্চলের শহর অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে মুসলিম ও ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা কয়েক শতক অবদমিত থাকার পর হিন্দু-জাগরণের শিখর হিসেবে তুলে ধরছে।
চলতি বছরের মে মাসের মধ্যে হতে চলা লোকসভা নির্বাচনের জন্য গভীরভাবে ধার্মিক মোদির পুনর্নির্বাচনের প্রচারের এক ধরনের সূচনা হিসেবেও দেখা হচ্ছে এই ঘটনাকে।
মন্দিরের স্থান নিয়ে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে তিক্ত লড়াই চলেছে। উভয় পক্ষই দাবি করেছে যে, ওই বিতর্কিত জায়গা তাদের। এক দল হিন্দু জনতা ১৯৯২ সালে ষোড়শ শতকের একটি মসজিদকে ধ্বংস করে দেওয়ার পর ওই স্থান সহিংসতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল।
ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুরা বলছে, ওই স্থান ভগবান রামের জন্মভূমি। মুসলিম মুঘলরা ১৫২৮ সালে মন্দির ভেঙে সেই জায়গায় বাবরি মসজিদ নির্মাণের বহু আগে থেকেই ওই স্থান তাদের কাছে পবিত্র।
সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে ওই জায়গা হিন্দুদের হাতে তুলে দেয় এবং মুসলিমদের আলাদা জমি দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
সোমবার এই মন্দিরের উদ্বোধনের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন মোদি। বিজেপি ও তার সহযোগী দলগুলির হাজার হাজার সদস্য, ধর্মীয় নেতা, দেশের নানা প্রান্ত থেকে অগণিত ভক্তরা অযোধ্যায় ওই দিন সমবেত হয়।
ভারতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ শিল্পপতি, চিত্রতারকা ও ক্রীড়াব্যক্তিত্বকেও রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিন আমন্ত্রিত হয়েছিলো বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
ধর্মীয় উচ্ছ্বাস, রাজনৈতিক বিতর্ক
রামমন্দির উদ্বোধনের আগে ১১ দিন ধরে বিশেষ আচার পালন করেছেন মোদি। তিনি সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ বলেন, “প্রাণপ্রতিষ্ঠার সময় ভারতের সকল মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে ভগবান আমাকে একটা যন্ত্রী বানিয়েছেন।”
ভগবান রাম যখন মন্দিরে নিজের স্থান গ্রহণ করবেন, সেই সময়কে “ঐতিহাসিক মুহূর্ত” বলে অভিহিত করেছেন মোদি। তিনি ভারতবাসীদের সোমবার সন্ধ্যায় নিজেদের বাড়িতে ও এলাকার মন্দিরগুলিতে আলো জ্বালিয়ে দীপাবলি পালন করতে অনুরোধ করেছেন। দীপালবলি আলোর উৎসব যা সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বরে পালিত হয়।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের ক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার পৃথ্বী দত্ত চন্দ্র শোভি বলেন, “মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠাকে ধর্মীয় আচারের চেয়ে বেশি লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণার সূচনা বলে মনে হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রী একজন সম্রাটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে, যিনি একটি প্রধান ধর্মীয় আচারে যেন বলিদান দিচ্ছেন।”
মন্দিরটি ৭০ একর (২৮.৩৩ হেক্টর) জমির মধ্যে ২.৬৭ একর (১.০৮ হেক্টর) জায়গা জুড়ে নির্মিত হয়েছে। এই মন্দিরের প্রথম অংশ সবে প্রস্তুত। দ্বিতীয় ও শেষ অংশ ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে সম্পূর্ণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পের আনুমানিক খরচ ১৫ বিলিয়ন রুপি (১৮১ মিলিয়ন ডলার) এবং এর গোটাটাই দেশের মানুষের অনুদানের অর্থ।
রাম মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগে হিন্দুদের মধ্যে আবেগ ও উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করেছে ভারত। বিভিন্ন মহল্লা ও বাজারে পবিত্র পতাকা ওড়ানো হচ্ছে, বিশেষ উপাসনার আয়োজন চলছে এবং বিশাল পর্দায় সোমবারের অনুষ্ঠানের লাইভ সম্প্রচার দেখানো হচ্ছে।
মন্দিরের উদ্বোধনকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে প্রধান বিরোধী কংগ্রেসসহ বড় বিরোধী দলগুলির সঙ্গে। রামমন্দিরের উদ্বোধনকে একটি রাজনৈতিক ও মোদি-ইভেন্টের রূপ দেওয়া হয়েছে বলে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে তারা।
মুসলিম গোষ্ঠীগুলি ২০১৯ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে খুশি নয়, যে-রায়ে ওই জমিকে হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তবে তারা জানিয়েছে, তারা একে “নম্রতার সঙ্গে” গ্রহণ করবে। প্রায় পাঁচ বছর পর তারা ইঙ্গিত দিয়েছে যে, এই বিষয় নিয়ে তারা আর ভাবিত নয়।
ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশনের প্রধান জুফার আহমাদ ফারুকি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনেই মন্দিরের নির্মাণকাজ চলছে, তাই আমরা একে স্বাগত জানাই। আমার মনে হয় না মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনও খারাপ-ইচ্ছা রয়েছে।”
এই ফাউন্ডেশন রাম মন্দির থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার (১৫ মাইল) দূরে অযোধ্যাতেই একটি নতুন মসজিদ নির্মাণ করছে।