সংসদ নির্বাচন ২০২৪: আওয়ামী লীগ, বিএনপি দু’দলই নিজেদের কৌশল সফল মনে করছে

ঢাকা, জানুয়ারী ৭।

বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারীর ভোটকে ঘিরে যে মাত্রার সহিংসতা আশঙ্কা করা হয়েছিল, অবশেষে সেরকম কোন সহিংসতা ছাড়াই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হল। নব-নির্বাচিত সদস্যরা শপথ নিয়েছেন, আর পরাজিত প্রার্থীরা তাদের ব্যর্থতার জন্য অন্যকে দোষারোপে ব্যস্ত।

কিন্তু কয়েকটি প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। বৃহৎ বিরোধীদল বিএনপি ও তার মিত্ররা প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ায় নির্বাচনে ‘প্রাণ’ ছিল না বলে অনেকে মনে করেন। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ২২২ আসনে জয় কাওকে অবাক করার কথা নয়।

ভোটের হার কম হওয়ায় বিএনপি মনে করছে বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কিন্তু অন্যদিকে, নির্বাচন ‘অবাধ এবং সুষ্ঠু’ হওয়ায় আওয়ামী লীগ মনে করছে তারা সঠিক পথে এগিয়েছে।

বলা যায় নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই এই প্রশ্নে বৃহৎ দুটি দল – আওয়ামী লীগ ও বিএনপি – বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয়।

টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, তাদের অধীনে একটি অবাধ, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব বলে দেশে-বিদেশে সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে।

বিএনপি সেই আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে একটি নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। দাবী আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় এবং জনগণকে ভোট না দেয়ার আহবান জানায়।

দুদলই বিজয় দেখেছে

সাত জানুয়ারী নির্বাচনের পর বিপরীত মেরুতে অবস্থানরত দুই দল একই ফলাফলকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করলো। দু’পক্ষই ৭ জানুয়ারীর ঘটনা প্রবাহকে নিজেদের বিজয় বলে ঘোষণা দেয়।

‘’সাত জানুয়ারির নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে জনগণ বিএনপির আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে,’’ বলেন বিএনপির সিনিয়র নেতা আব্দুল মঈন খান।

‘’গত এক বছর ধরে আমরা বলে আসছি, বাংলাদেশের মানুষ এই সরকারকে বর্জন করেছে। সেই কথাটি আজকে ভোট বর্জণের মধ্যে জনগণ দেশে-বিদেশে সবার সামনে প্রমাণ করেছে,’’ তিনি বলেন।

তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল ভোট কেন্দ্রে তুলনামূলক কম ভোটার উপস্থিতি। ভোট শেষ হবার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের জানান ২৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। তাৎক্ষনিক ভাবে কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কমিশন প্রধানকে ‘শুধরে’ দিয়ে বললেন, ভোট হয়েছে ’৪০ শতাংশের মত।‘

কমিশনের ড্যাশ বোর্ড নিয়ে হইচই

এই বিভ্রান্তি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বেশ হইচই পড়ে যায়। রাত ৯টায় তোলা নির্বাচন কমিশনের ইলেকট্রনিক ড্যাশ বোর্ডের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যম এক্স (প্রাক্তন টুইটার)-এ শেয়ার হতে থাকে, যেখানে দেশের আট বিভাগে ভোটের হার তুলে ধরা হয়েছিল।

সেই হিসেবে, সারা দেশে ভোটের হার হওয়ার কথা ২৮ শতাংশ। কিন্তু পরের দিন, অর্থাৎ ৮ জানুয়ারী প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁর কর্মকর্তার দেয়া পরিসংখ্যান আরও পাকাপোক্ত করে বললেন, ভোট পড়েছে ৪১.৮ শতাংশ।

বিএনপির নেতারা বলেছেন, তাঁরা সারা দেশে ভোট কেন্দ্রগুলোতে নিজেদের লোক দিয়ে চোখ রেখেছেন। কিন্তু কোন ভোটার তাঁরা দেখতে পান নি। তাঁরা নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান প্রত্যাখ্যান শুধু করেন নি, ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বেশ রসিকতাও করেছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান

‘’সকালের ভোট শুরু পর থেকে আমরা বিভিন্ন ভোটে কেন্দ্রের ছবি সংগ্রহ করেছি। সেগুলো যে শুধু ভোটার শূণ্য তাই নয়, আজকে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি, এই শীতের সকালে শত-শত ভোট কেন্দ্রের সামনে কুকুর রোদ পোয়াচ্ছে,’’ মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন।

বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবী করেছে। জনমত গোড়ে তোলার জন্য গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু তার মিত্র দলগুলো ছাড়া আর কোন পক্ষ থেকে নতুন নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে না।

আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচন সফল

ভোটার উপস্থিতি যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচন ছাড়া যেকোনো সময়ের চেয়ে কম হয়েছে, তা পত্র-পত্রিকা আর টেলিভিশনে ছবি এবং ভিডিও দেখা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে তাদের বড় সাফল্য হিসেবে দেখছে।

নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতারা মূলত দুটি কথা বলেছিলেন। প্রথমত, তারা প্রমাণ করবেন তাদের অধীনে নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হবে, যেখানে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে। দ্বিতীয়ত, তাদের কথায়, ভোটারদের অংশগ্রহণেই নির্বাচন ‘’অংশগ্রহণমূলক’’ হবে।

‘’আমাদের দেখতে হবে যে সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণ কী পরিমাণ আছে,’’ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন।

‘’যদি দেখা যায় যে, সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে যে পরিমাণ ভোটার উপস্থিত হন বা ভোটগ্রহণে তারা অংশ নেন, যদি সে ধরনের কাছাকাছি পর্যায়ে আসে, সেটাই তো অংশগ্রহণমূলক হবে। ভোটারদের অংশগ্রহণটাই আসল,’’ তিনি বলেন।

সব দলের অংশগ্রহণে সর্বশেষ নির্বাচন ছিল ২০১৮ সালে। নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এখন, মাহবুবুল আলম হানিফের বক্তব্যের আলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সেভাবে ‘’অংশগ্রহণমূলক’’ বলা যাচ্ছে না। কারণ, নির্বাচন কমিশনের দেয়া প্রাথমিক হিসাব (২৮ শতাংশ), এমনকি তাদের চূড়ান্ত পরিসংখ্যানকেও (৪১.৮ শতাংশ) আগের‍ নির্বাচনের ‘’কাছাকছি পর্যায়ের’’ বলা যাবে না।

আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে ৪০ শতাংশ ভোট নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়। তবে, স্থানীয় পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ধাপ এগিয়ে ৭ জানুয়ারীর নির্বাচনকে ১৯৭৫ সালের পর ‘’সম্পূর্ণ অবাধ, সুশৃঙ্খল, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক’’ বলে বর্ণনা করেছেন।

অর্থাৎ, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের উপড়ে স্থান দিয়েছেন, যেটা হয়ত অনেককে অবাক করেছে। কারণ, ১৯৭০ এর মোড়-ঘুরানো, ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের জন্য সব চেয়ে স্মরণীয় বিজয় বললে ভুল বলা হবে না।

শান্তিপূর্ণ অবাধ ভোট

ক্ষমতাসীনদের ধারনা ছিল বিএনপি শুধু বর্জন না, নির্বাচনকে বানচাল করতে চায়। সেই পটভূমিতে নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, তার দিকেই আওয়ামী লীগ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ভাবে হয়েছে, যে ভোট দিতে চেয়েছে তারা অবাধে ভোট দিতে পেরেছে – এই বিষয়টির উপর জোর দেয়া হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

‘’বিএনপি জামাত নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েছে, তারা অগ্নিসন্ত্রাস করেছে,’’ নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন। ‘’তবে ব্যালটের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।‘’

আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনকে সফল ঘোষণা করার পেছনে আরেকটি কারণ আছে। নির্বাচন যে আদৌ হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হয়েছে, সেটাই একটা বড় সাফল্য। সরকার বা নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে বিদেশ থেকে আসা পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে সফল বলে তুলে ধরেছেন।

‘’আমি এবং আমার সহ পর্যবেক্ষকরা যা দেখলাম, তা ছিল মোটা দাগে একটি মুক্ত, অবাধ ও নিরাপদ নির্বাচন,’’ অ্যালেক্স বি গ্রে, আমেরিকান ফরেন পলিসি কাউন্সিলের একজন সিনিয়র ফেলো, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পর সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ বলেন।

বিএনপির শিশুসুলভ আচরণ

গ্রের সহ পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস-এর প্রাক্তন সদস্য জিম বেইটস। নির্বাচনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ভোট প্রক্রিয়ার প্রশংসা এবং বিএনপির সমালোচনা করেন।

‘’আমি খুব শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে পেলাম। তবে নির্বাচন থেকে বিরোধী দলের নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়াটা আমার কাছে শিশুসুলভ আচরণ মনে হয়েছে,‘’ তিনি বলেন।

পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সমলাচনা হলে অ্যালেক্স গ্রে তাঁর এক্স পাতায় একটি ব্যাখ্যা দেন।

‘’পর্যবেক্ষকরা শুধুমাত্র নির্বাচনের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, এ’ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাজ এবং তারা নিজের চোখে যা দেখলো, তা নিয়ে কথা বলতে পারে। শোনা কোথায় তারা কান দিতে পারে না,’’ তিনি বলেন।

‘’স্টেট ডিপার্টমেনট যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষে কথা বলে, এবং তাদের বিবৃতিতে তাদের বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বেসরকারি পর্যবেক্ষক, শুধু নিজেদের কথা তুলে ধরতে পারি এবং নিজেরা যা পর্যবেক্ষণ করেছি, তা নিয়েই কথা বলতে পারি,’’ বলেন অ্যালেক্স বি গ্রে, যিনি এক সময় প্রেসিডেন্ট ডনালড ট্রাম্পের প্রশাসনে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের চিফ অফ স্টাফের দায়িত্ব পালন করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রিটেন উদ্বিগ্ন

যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই বেসরকারি পর্যবেক্ষকের সাথে একমত পোষণ করে নি। পররাষ্ট্র দফতর (স্টেট ডিপার্টমেনট) এক বিবৃতিতে অভিমত দেয় যে নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার

‘’রাজনৈতিক বিরোধীদলের হাজার হাজার সদস্যের গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনের দিন নানা অনিয়মের প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।

‘’অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে অভিন্ন মতামত পোষণ করে যে, এই নির্বাচন অবাধ, বা সুষ্ঠু ছিল না এবং আমরা দুঃখিত যে সব দল এতে অংশগ্রহণ করেনি,’’ বিবৃতেতে বলা হয়।

বাংলাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ব্রিটেনও একই মনোভাব পোষণ করে বিবৃতি দেয়।

ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দফতর তাদের বিবৃতিতে বলে, "গণতান্ত্রিক নির্বাচন নির্ভর করে বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ এবং সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার ওপর। মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং যথাযথ প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য উপাদান।

‘’নির্বাচনের সময় এই মানদণ্ডগুলো ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয়নি," ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর বলে।

বাংলাদেশ সরকার অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যর বক্তব্য নিয়ে কোন সংশয় প্রকাশ করেনি। বরংচ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন, তাদের প্রতিক্রিয়ায় ‘’উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই, কারণ তারা জনগণের রায়কে সম্মান করে।‘’

“আমরা এতে খুবই খুশি,” আব্দুল মোমেন মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধায় 'মিট অ্যান্ড গ্রিট' অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

তবে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন সহ যেসব দেশ এই নির্বাচন বাংলাদেশকে কোন পথে নিয়ে যেতে পারে বলে উদ্বিগ্ন, তারা ঢাকার সাথে তাদের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করবে, না কি শেখ হাসিনা সরকারের সাথে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে, তা এখনো পরিষ্কার না।