গুজরাটে ২০০২ সালে বিলকিস বানো গণধর্ষণের মামলায় আগাম মুক্তি পেয়েছিলেন ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত। সোমবার ৮ জানুয়ারি সেই রায় খারিজ করে দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্ট সাজা খারিজ করার অর্থ আবার কারাগারে ফিরতে হবে অপরাধীদের। শীর্ষ আদালতের এই রায়ে দেড় বছর পর ন্যায় পেলেন বিলকিস বানো, এমনটাই মনে করছেন তিনি নিজে।
সোমবারের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বিলকিস বানো বলেন, "আজ আমার জন্য সত্যিকারের নববর্ষ। ন্যায়বিচার একেই বলে৷ আমাকে, আমার সন্তানদের এবং সব নারীদের ন্যায়বিচারের বিশ্বাস এবং ভরসা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ জানাই৷"
অপরাধীদের আগাম জামিন দেওয়ার প্রেক্ষিতে গুজরাট সরকারকে সোমবার তীব্র ভর্ৎসনা করে সুপ্রিম কোর্ট। মেয়াদ ফুরনোর আগেই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কীভাবে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে সে নিয়ে প্রশ্ন তোলে শীর্ষ আদালত।
নিজের আইনজীবী শোভা গুপ্তার মাধ্যমে বিবৃতিতে এই রায় নিয়ে বিলকিস বানো বলেন, "এই রায় শুনে আমি স্বস্তিতে কেঁদে ফেলেছিলাম। গত দেড় বছরে এই প্রথমবার হাসলাম৷। আমি আমার সন্তানদের জড়িয়ে ধরেছি। মনে হচ্ছে, আমার বুকের থেকে এক বিশাল বড় পাহাড় নেমে গিয়েছে। আমি আবারও নিশ্বাস নিতে পারছি।'
বিলকিস জানিয়েছেন, ২০২২ সালের ১৫ অগাস্ট যখন গুজরাট সরকার অপরাধীদের মুক্তি দেয়, সেই খবরে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি৷ এই কঠিন সময়ে যারা তার পাশে ছিলেন, তাদের উদ্দেশ্যেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, "আপনারা আমার লড়াইয়ের ইচ্ছে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, শুধু আমার জন্য নয়, দেশের প্রত্যেক নারী যে ন্যায়বিচার পাবেন, সেই ভরসাও ফের প্রতিষ্ঠিত হল৷"
বিলকিস বানোকে গণধর্ষণে অভিযুক্ত ১১ জনকে ২০২৩ সালে মুক্তি দিয়েছিল গুজরাট সরকার। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করেই সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন বিলকিস বানো।
অভিযুক্তদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্র, সিপিএম-এর প্রবীণ নেত্রী সুভাষিণী আলি, সাংবাদিক রেবতী লাল এবং অধ্যাপক রূপরেখা বর্মা সু্প্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সেই শুনানি চলার পর সোমবার ৮ জানুয়ারি সেই মামলার রায় দিল শীর্ষ আদালত।
বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন এবং উজ্জ্বল ভুঁইয়া গত বছর ২০২৩-এর ১২ অক্টোবর রায় স্থগিত রেখেছিলেন। আদালত জানিয়েছিল, মেয়াদ শেষের আগেই অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া হবে কিনা তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিলকিস বানো এবং অন্য আবেদনকারীদের তরফে আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিংহ এবং বৃন্দা গ্রোভার শুনানিতে অংশ নেন।
গত বছর ২০২৩-এর ১৫ অগস্ট ৭৬ তম স্বাধীনতা দিবসে বিলকিসকাণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় গুজরাট সরকার। তার আগে, মুক্তির জন্য শীর্ষ আদালতে আবেদন জানিয়েছিলেন ওই ধর্ষণের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা। সেই আবেদনের ভিত্তিতে গুজরাট সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিল আদালত। এর পর আদালতের সম্মতিতে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
সরকারি তরফে জানানো হয়, জেলে ওই ১১ জন অপরাধীর ব্যবহার দেখেই তাদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কী কী মানদণ্ড বিবেচনা করে ওই ১১ জন অপরাধীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তথ্যের অধিকার আইনে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু মুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্যানেলের বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে তথ্য দিতে চায়নি গুজরাট সরকার। তাই শীর্ষ আদালতে পাল্টা মামলা দায়ের হয়।
২০০২ সালে গোধরা-কাণ্ডের পর গুজরাটে সাম্প্রদায়িক হিংসা চলাকালীন, ৩ মে দাহোড় জেলার দেবগড় বারিয়া গ্রামে হামলা চালানো হয়। গ্রামের বাসিন্দা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ করা হয়। বিলকিসের চোখের সামনেই তার ৩ বছরের মেয়েকে নৃশংসভাবে খুন করে অপরাধীরা।
এই অপরাধকে ‘বিরল থেকে বিরলতম’ বলেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। মুম্বইয়ের সিবিআই আদালতে অপরাধীদের কঠোর সাজা দেওয়ার আর্জিও জানানো হয়েছিল। ২০০৮ সালের ২১ জানুয়ারি মোট ১২ জনের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছিল ওই বিশেষ আদালত। মামলা চলাকালীন ১ জনের মৃত্যু হয়। বাকি ১১ জন ধর্ষক ও খুনি মুক্তি পায়।
সোমবার সেই নির্দেশ খারিজ করে ওই ১১ জন সাজাপ্রাপ্তকে ফের কারাগারে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ রায় অনুযায়ী, অপরাধীদের আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে হবে।