বাংলাদেশের "ভুয়া" নির্বাচনের নিন্দা জানালেন নির্বাসিত বিরোধী দলের নেতা

ফাইল ছবিতে বিএনপি-র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য রবিবারের "ভুয়া" নির্বাচনকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকে দৃঢ় করার জন্য একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করে তার দলের এই নির্বাচন বর্জনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন নির্বাসিত বিরোধীদলীয় নেতা তারেক রহমান। বার্তা সংস্থা এএফপি কে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন।

বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল যারা বংশপরম্পরায় ক্ষমতায় এসেছে তারেক রহমান তার একটির উত্তরাধিকারী। অন্য রাজনৈতিক দলটি হচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল। তারেক রহমানের মা, দুইবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালে কারাগারে পাঠানো হবার পর থেকে তারেক রহমান বাংলাদেশের বৃহত্তম বিরোধী দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।

তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতেই শেখ হাসিনার নির্বাচনী জনসভায় গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ছয় বছর আগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে তার বিরুদ্ধে আনা ঐ অভিযোগটি বানোয়াট।

গত বছর প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে তার দল মাসব্যাপী বিক্ষোভ করে। ঐ বিক্ষোভের সময় কমপক্ষে ১১ জন নিহত হয় এবং হাজার হাজার সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত কয়েকবছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো রক্ত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৫৬ বছর বয়স্ক তারেক রহমান বলেন, “ফলাফল পূর্বনির্ধারিত” এমন একটি নির্বাচনে তার দলের অংশগ্রহণ সঠিক হতো না।

লন্ডন থেকে এএফপিকে পাঠানো এক ই-মেইলের মাধ্যমে তিনি জানান, “বাংলাদেশে আরেকটি ভুয়া নির্বাচন হতে যাচ্ছে।" জনাব রহমান ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনেই থাকছেন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্খার বিপরীতে গিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, রক্ত দিয়েছেন এবং জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের আত্মত্যাগের প্রতি অবমূল্যায়ন করা হবে।"

তারেক রহমান বলেন, তার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং আরও কয়েক ডজন দল যারা নির্বাচন বর্জন করছে তাদের বিপরীতে ক্ষমতার ভারসাম্য অনেক বেশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে আছে।

তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনকে বৈধতা দিতে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জোট বেঁধে " ডামি" বা
সাক্ষিগোপাল বিরোধী প্রার্থী দাঁড় করানো হচ্ছে।

এর মাধ্যমে এমন একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে এই নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে। জোশ ভোটার ফলাফল পুরোটাই পূর্বনির্ধারিত।

তিনি আরও দাবি করেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে যারা ভোট দেননি তাদের কাছ থেকে সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা আটকে রাখার হুমকি দিয়ে দলটি নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের হার বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশও এ সপ্তাহের ভোট গ্রহণের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের যে নির্বাচনগুলোতে বিজয়ী হয়েছিল সেগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছিল বলে পর্যবেক্ষকরা অভিযোগ তুললে তিনি এবারের নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে বারবার অঙ্গীকার করেছেন। শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন।

শনিবার এক নির্বাচনী জনসভায় শেখ হাসিনা বলেন, “সকালে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিন এবং বিশ্বকে দেখান যে আমরা জানি কী ভাবে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে হয়।”

বংশানুক্রমিক শাসন

১৯৭১ সাল থেকে ১২ বছর বাদ দিয়ে তারেক রহমান ও শেখ হাসিনার পরিবার বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনবহুল দেশটিকে শাসন করেছে।

শেখ হাসিনার বাবার হত্যার পর তারেক রহমানের বাবা সাবেক সেনাপ্রধান দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৮১ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

একটি নির্দিষ্ট সময় সামরিক শাসন চলার পর, তার মা বেগম খালেদা জিয়া একবার শেখ হাসিনার সাথে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে জোট বেঁধেছিলেন। তবে ১৯৯০-এর দশক থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় দু’জন তিক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার কিছুদিন আগে তারেক রহমান দেশ ত্যাগ করেন এবং লন্ডনে লো প্রোফাইলেই থাকেন। প্রবাসী বিশিষ্ট বাংলাদেশিদের বিয়ের অনুষ্ঠান ও জাতীয় দিবসগুলোর বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া জনসমক্ষে তাকে তেমন একটা দেখা যায় না।

তবে দূর্নীতির দায়ে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া কারাবন্দি হবার পর থেকে এবং এখন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় বন্দি অবস্থায় হাসপাতালে থাকায়, তারেক রহমানই দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির এই বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

তিনি প্রতিদিনই ফোন কিংবা ভিডিও সম্মেলনের মাধ্যমে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন।

গত বছর বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক সমাবেশ, শ্রমিক ধর্মঘট হরতাল এবং অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করে রাজধানীকে অচল করে দেয়। শেখ হাসিনা সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচনের যে সাংবিধানিক ব্যবস্থ্যা ছিল তা বিলুপ্ত করে দিয়েছিল।

গত অক্টোবরে বিএনপির একটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে হওয়া সহিংসতার ঘটনার পর নেমে আসা সরকারি দমনপীড়নে বিএনপির ২৫,০০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দলটি দাবি করে যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সংখ্যাটি ১১,০০০ বলে বলা হচ্ছে।

শেখ হাসিনা, তার সাম্প্রতিক এক নির্বাচনী প্রচারণা সমাবেশে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে লন্ডনে বসে সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ তুলে নির্বাচনের পর বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার সম্ভাবনার কথা তুলেছেন। "আমরা ওকে লন্ডন থেকে মানুষের ক্ষতিকরার ও হত্যা করার নির্দেশ দেয়াটা বরদাশত করবো না, " শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) এক সমাবেশে হাসিনা বলেন।

তার দলের বিরুদ্ধে আনা আন্দোলনের সময় অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালানোর এসব অভিযোগ তারেক রহমান অস্বীকার করে বলেন, বিরোধীদলের ওপর ক্র্যাকডাউন চালানোর একটি অজুহাত হিসেবে এসব অভিযোগ করা হচ্ছে।