ড. ইউনূসের ৬ মাসের কারাদণ্ড, শর্তসাপেক্ষে জামিন

আদালত প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ঢাকা, ১ জানুয়ারী।

শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায়, বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি শ্রম আদালত।

একই সঙ্গে তাদের ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। পরে, আপিলের শর্তে দণ্ডিত সকল ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করে বিচারিক আদালত।

সোমবার (১ জানুয়ারি) ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন। এর আগে, দুপুর পৌনে দুইটার দিকে ড. ইউনূস আদালতে পৌঁছান।

রাষ্ট্রপক্ষ ও অভিযুক্ত পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর। এরপর, রায় ঘোষণার জন্য ১ জানুয়ারি দিন ধার্য করে আদালত।

এর আগে, ২০২৩ সালের ৬ জুন ঢাকার শ্রম আদালত-৩ চার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে।

মামলায় অনান্য অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন; গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের সিইও আশরাফুল হাসান, ট্রাস্টি নূরজাহান বেগম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাহজাহান।

অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ড. ইউনূসসহ তিন জন, মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে আবেদন করেন।

এরপর, গত বছরের ২৩ জুলাই চার জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গঠনের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না; তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট।

গত ৩ আগস্ট ড. ইউনূস এবং অন্যদের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে অভিযোগ গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুলে রুল নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টকে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে এই মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে গিয়ে অধিদপ্তরের পরিদর্শকরা দেখতে পান, ১০১ জন শ্রমিক ও কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু তা করা হয়নি।

এ ছাড়া, তাদের জন্য কোনো অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি; আর, আইন অনুযায়ী কোম্পানির মুনাফার পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের দেয়া হয়নি।

এসব অভিযোগের ভিত্তিতে, শ্রম আইনের ৪, ৭, ৮, ১১৭, ২৩৪ ধারায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়।

শর্তসাপেক্ষে জামিন

ছয় মাসের কারাদণ্ড পাওয়ার পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে শর্তসাপেক্ষ জামিন দিয়েছেন আদালত।

ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা তাদের জামিন মঞ্জুর করেন।

ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “আপিলের শর্তে আদালত সবাইকে এক মাসের জামিন দিয়েছে।”

রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন ব্যারিস্টার মামুন। তিনি বলেন, “আমরা ন্যায়বিচার পাইনি এবং উচ্চ আদালতে আপিল করবো।”

"প্রফেসর ইউনুস বা কারো জন্য (আইন) ভিন্ন হওয়া উচিত না"- শহিদুল আলম

অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ভয়েস অফ আমেরিকাকে ডঃ শহিদুল আলম বলেন, "আইন সকলের ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। এটা প্রফেসর ইউনুস বা কারো জন্য ভিন্ন হওয়া উচিত না। আমরা যেখানে প্রকাশ্যে দেখছি যে, চারিদিকে এতগুলি অন্যায় হচ্ছে এবং সেটার ক্ষেত্রে কোন কিছুই করা হচ্ছে না। অথচ প্রফেসর ইউনুসের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে অল্প সময়ের মধ্যে রায় দিয়ে দেওয়া এবং তাকে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া এটা খুব সন্দেহজনক।"

তিনি বলেন, "এটাতো বলা হচ্ছে শ্রমিকের অধিকারের জন্য। এইখানে তারা যে বঞ্চিত হচ্ছে সেটা শুনে মনে হয় না কিন্তু এই একই দেশে যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেঁচে থাকার জন্য তাদের নূন্যতম যে বেতন পাওয়ার কথা সেই বেতনের দাবিতে যখন রাস্তায় নামে তখন তাদের আক্রমণ করা হয়, এরেস্ট করা হয়, খুন করা হয়। এই জায়গায় ন্যায় বিচার হচ্ছে এটা আমার জন্য বিশ্বাস করা খুব কঠিন।"

"তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে না-দেওয়ার জন্য"- ড. হাছান মাহমুদ

নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার রায় প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, "পৃথিবীতে অনেক নোবেলজয়ী ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেকে জেলও খেটেছেন। ড. ইউনূসের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাচ্ছি, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে না-দেওয়ার জন্য। তিনি শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে দেননি, বহু বছর ধরে।"

একই সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার বিষয়ে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর ভূমিকার সমালোচনাও করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, "আশা করি, বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও এ নিয়ে কথা বলবেন। শ্রমিকের অধিকার ও পাওনা বুঝিয়ে না দেওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে মামলা হয়েছে।"

সোমবার (১ জানুয়ারি) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়কালে এসব কথা বলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা

ড. ইউনূসের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে ১৬০ বিশ্বনেতার খোলা চিঠি

১০০জনের বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০জন বিশ্বনেতা বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুরক্ষা ও সুস্থতার বিষয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি লেখেন ২০২৩-এর আগস্ট মাসে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি সম্বোধন করা চিঠিতে সই করাদের মধ্যে ছিলেন- যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, হোসে রামোস-হোর্তা, মেরি রবিনসন, মারেড করিগান-ম্যাগুয়াইয়ার, শিরিন এবাদি, ডেনিস মুকওয়েগে, নাদিয়া মুরাদ, মারিয়া রেসা, অস্কার আরিয়াস সানচেজ, জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস, বান কি-মুন, লরা বোলড্রিনি, পল ডেভিড হিউসন (বোনো) এবং স্যার রিচার্ড ব্রানসন প্রমুখ।

ড. মোহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়াকে "বিচারিক হয়রানি" বলে অভিহিত করে সইকারীরা তার বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

চিঠিতে লেখা হয়েছিল, "বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তা হলো―নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা। আমরা উদ্বিগ্ন, সম্প্রতি তাকে টার্গেট করা হয়েছে। এটা ক্রমাগত বিচারিক হয়রানি বলেই আমাদের বিশ্বাস।"

এতে আরও বলা হয়েছিল, "আমরা সসম্মানে অনুরোধ করছি আপনি অবিলম্বে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করুন, তারপরে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণসহ আপনার দেশের মধ্যে থেকে নিরপেক্ষ বিচারকদের একটি প্যানেল দ্বারা অভিযোগ পর্যালোচনা করা হবে। আমরা নিশ্চিত, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী ও শ্রম আইনের মামলাগুলোর যে কোনও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হলে তিনি খালাস পাবেন।"

ঐ চিঠির প্রেক্ষিতে ২৯ আগস্ট পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, "বাংলাদেশের একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা রয়েছে এবং আদালত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন।"

ড. ইউনূসের পক্ষে যারা চিঠি লিখেছেন তাদের প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "তারা (বিচার) প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।"

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করার আহ্বান ‘নজিরবিহীন’।

এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন খালেদ হোসেন।