ইসরাইল হামাসঃ গাজায় তীব্র লড়াইয়ের মাঝে যুদ্ধবিরতির ডাক

গাজার উত্তরে এক সংঘর্ষে ১০জন সৈন্য নিহত হয়েছে বলেই ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে। ফাইল ফটো

ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বুধবার ঘোষণা করেছে, উত্তর গাজা ভূখণ্ডে হামাসকে নির্মূলের অভিযানে অংশ নেওয়ার সময় ১০ জন সেনা নিহত হয়েছে।

ইসরাইলি সেনাবাহিনী আরও জানিয়েছে, গত একদিনে তারা ২৫০ টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।

গাজায় এক অভিযান পরিচালনার সময় ইসরাইলি সেনারা দুই জিম্মির মরদেহ উদ্ধার করেছে। অক্টোবরে হামাস ইসরাইলি ভূখণ্ডে হামলা চালানোর সময় এই দুই ব্যক্তিকে জিম্মি করেছিল। হামাসের হামলার পর থেকে গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র জানান, হামাস গাজার জনবহুল অংশে মাটির নিচে জিম্মিদের আটকে রেখেছে। যার ফলে তাদের উদ্ধার কার্যক্রমে জটিলতা দেখা দিয়েছে। তবে তিনি জানান, ইসরাইল প্রত্যেক জিম্মিকে উদ্ধারের অভিযান থেকে বিচ্যুত হবে না।

গাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে নতুন করে সতর্কবাণী আসলেও যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্দি বুধবার বলেন, “মর্মান্তিক হলেও, আমরা আশঙ্কা করছি এই অঞ্চলে আরও অনেক বেসামরিক ব্যক্তি দুর্দশায় পড়বেন এবং অনেকে নিহত হবেন। এ ছাড়া, এখানে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।”

পোপ ফ্রান্সিস আবারও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর এবং হামাসের হাতে বন্দি জিম্মিদের মুক্তিরও আহ্বান জানান।

পোপ ফ্রান্সিস

বাইডেনের অসন্তুষ্টি

যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানের ফলে বেসামরিক ব্যক্তি নিহতের সংখ্যা মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। ইসরাইলের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থন বজায় রাখলেও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মঙ্গলবার জনসম্মুখে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেন।

এক সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন বলেন, “আমরা ইসরাইলিদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করেছি, এবং তারা এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন…নিরীহ ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণে, তারা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলো এমন হতে হবে যাতে নিরীহ ফিলিস্তিনি বেসামরিক ব্যক্তিরা আহত, নিহত বা নিখোঁজ না হয়।”

তিন মাস ধরে চলমান ইসরাইলের সামরিক অভিযান নিয়ে সমালোচনায় বাইডেন সম্প্রতি আরও উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন। মঙ্গলবার ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুনর্নিবাচিত হওয়ার প্রচারণার অংশ হিসেবে ডেমোক্র্যাট দলের দাতাদের সঙ্গে আলাপ করতে যেয়ে বাইডেন বলেন, “নির্বিচারে বোমা ফেলে” ইসরাইল সারা বিশ্বের সমর্থন হারাতে চলেছে।

এই অনুষ্ঠানে বাইডেনের সামনে কোনো ক্যামেরা না থাকলেও হোয়াইট হাউস প্রকাশিত এক বিবরণীতে এই তথ্য জানা গেছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব

এমন সময় বাইডেনের এই মন্তব্য এলো যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বেশির ভাগ ভোট পেয়েছে। এ ঘটনায় ওয়াশিংটন আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ১৯৩ সদস্যের বৈশ্বিক সংস্থার ১৫৩ সদস্য এর পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট পড়ে ১০ এবং ২৩ সদস্য ভোট দানে বিরত থাকে।

জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্থায়ী পর্যবেক্ষক রিয়াদ মানসুর বলেন, “আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যারা এখনো বেঁচে আছেন, তাদেরকে বাঁচাতে এই প্রস্তাবকে বাস্তবায়ন করা এবং ইসরাইলকে এটা মেনে নিতে বাধ্য করা। এবং যারা ইসরাইলকে সুরক্ষা দিচ্ছে, তাদেরকেও বৈশ্বিক জনমত মেনে নিতে বাধ্য করা।”

গত সপ্তাহে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে একই ধরনের একটি প্রস্তাবে ভোটগ্রহণ হয়। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেলেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার প্রয়োগে উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। সাধারণ পরিষদে কোনো ভেটো প্রক্রিয়া নেই।

সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এর রয়েছে রাজনৈতিক গুরুত্ব। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সংকট সংক্রান্ত সংস্থার পরিচালক রিচার্ড গোয়ান বলছেন, “এ ক্ষেত্রে যা বর্ণিত হয়েছে, তা হল, যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই একক অবস্থান নিয়েছে” এবং “(তারা) যুক্তরাষ্ট্রের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য এক ধরনের নৈতিক চাপ সৃষ্টিতে সব ধরনের উপায় খুঁজছে”।

তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “জাতিসংঘে আরব গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায়”। “তারা চায় এমন বার্তা পাঠাতে যে এ ধরনের অবস্থান বজায় রাখার কারণে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম হারাচ্ছে।”

প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ইসরাইলের অন্যান্য সমর্থকরা বলছেন, তারা মানবিক কারণে যুদ্ধে বিরতি দেওয়ার বিষয়টিকে সমর্থন করেন, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি আরোপ করা হলে (যুক্তরাষ্ট্রের) চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংগঠন হামাস আবার সংগঠিত হতে এবং ভবিষ্যতে আরও হামলার পরিকল্পনা করতে পারবে।

৭ অক্টোবর হামাসের যোদ্ধারা গাজা ভূখণ্ড থেকে নিকটবর্তী ইসরাইলি শহরগুলোতে অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় তারা ১ হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা করে এবং ২০০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরাইলের সামরিক পালটা হামলায় অন্তত ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং ১৮ হাজারেরও বেশি নিহত হয়েছেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে এটাই সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।

ভয়েস অফ আমেরিকার জাতিসংঘ বিষয়ক সংবাদদাতা মার্গারেট বেশির এই প্রতিবেদনে কাজ করেছেন।