দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবন যাত্রার ব্যয় বিবেচনায় তৈরি পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত ন্যূনতম ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরি বাস্তব সম্মত নয় বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও পোষাকখাতের শ্রমিকরা। এই অবস্থায় নূন্যতম মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গত সপ্তাহ ধরে বড় ধরনের আন্দোলনে নেমেছে শ্রমিকরা।
এরই মধ্যে রোববার সরকার পোষাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। শ্রমিকরা এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাখ্যান করে তা পুনঃবিবেচনার দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও এই আন্দোলনে শ্রমিকরা ব্যাপক দমন পীড়নের শিকার হচ্ছেন।
এদিকে গত ৭ নভেম্বর সরকার ঘোষিত ১২ হাজার ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি বর্তমান বাজার দরের সাথে কোনভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ন নয় বলে দাবী শ্রমিকদের। এই অবস্থায় তৈরি পোষাক খাতে নূন্যতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরে আন্দোলনে নেমেছে শ্রমিকরা।
এই আন্দোলনে (রোববার, ১২ নভেম্বর) পর্যন্ত চার জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছে। এছাড়াও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২০ হাজার জনকে আসামী করা হয়েছে এবং ৯৮ জন গ্রেফতার হয়েছে।
এই আন্দোলন দমন করতে সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও মালিকপক্ষের 'পেটোয়া বাহিনী' শ্রমিক আন্দোলনে ব্যাপক দমন পীড়ন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিকরা। তাদের দাবি, আন্দোলন দমনের নামে পুলিশ অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করছে। শুধু তাই নয় পুলিশ শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে এবং তাদেরকে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নূন্যতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করে প্রজ্ঞাপন জারি
গত ৭ নভেম্বর তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পোশাকশ্রমিকদের মজুরি নিয়ে গঠিত বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় এই মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ওই ঘোষণার পর থেকে শ্রমিকরা তা ২৫ হাজার টাকা করার জন্য আন্দোলন করছে। যদিও মালিকপক্ষ ও সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে তা নাকচ করে দেয়া হয়েছে।
রোববার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রালয়। এদিকে ন্যূনতম মজুরি আগে সাতটি গ্রেড থাকলেও বর্তমানে তা কমিয়ে পাঁচটি করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন গ্রেড-৫ এ ন্যূনতম বেতন ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ৬ হাজার ৭০০ টাকা, বাড়িভাড়া ৩ হাজার ৩৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা খাদ্যভাতা রাখা হয়েছে ১ হাজার ২৫০ টাকা। আর গ্রেড-১ বা সর্বোচ্চ গ্রেডের মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা। যেখানে মাসিক মূল মজুরি বা বেতন ধরা হয়েছে ৮ হাজার ২০০ টাকা, বাড়ী ভাড়া ৪ হাজার ১০০ টাকা, চিকিৎসা ৭৫০ টাকা যাতায়াত ৪৫০ টাকা খাদ্য ভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকাসহ মোট বেতন ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা। সব গ্রেডের মূল মজুরি মাত্র ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কম বেশি হলেও বাড়ীভাড়া, চিকিৎসা, খাদ্য ও যাতায়াত ভাতা একই। আর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মজুরির মূল বেতনের পার্থক্য রাখা হয়েছে মাত্র ২ হাজার ২৫০ টাকা। এ ব্যাপারে মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ ভয়েস অফ আমেরিকাকে নিশ্চিত করে বলেছেন, প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরির গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
দারিদ্র সীমার ওপরে থাকতে হলে নূন্যতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা প্রয়োজন
অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদের মতে, বাংলাদেশের নূন্যতম মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকার কথা বলা হচ্ছে। এই টাকা দিয়ে চার সদস্যের একটা পরিবার দারিদ্রসীমার ওপরে বসবাস করতে যে অর্থের প্রয়োজন এটা তার তিন ভাগের এক ভাগ।
অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, "বর্তমানে দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগারের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে যে নূন্যতম মুজুরি ঘোষণা করেছে সেটা মিলছে না। যে হারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে সে হারে মজুরি বাড়েনি। এতে করে ঢাকা শহরে দারিদ্রতা বেড়েছে। একের পর এক ধাক্কা আসছে। এতে করে শ্রমিকের জীবন চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শ্রমিকরা তাদের চাহিদা কমিয়ে এনেছে। তার মানে হলো, যে কোন ধাক্কা নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বেশি লাগে।"
ইউরোপভিত্তিক শ্রমিক অধিকার জোট ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন (সিসিসি) এক বিবৃতিতে গত ৯ নভেম্বর বলেছে পোষাক শ্রমিকদের দারিদ্রসীমার উপরে উঠতে মাসে ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা প্রয়োজন। একইসঙ্গে তারা আরও বলেছে বাংলাদেশে তারা অস্বচ্ছ প্রক্রিযায় বাংলাদেশে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে ১২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে মজুরি বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করার দাবি করছে তৈরি পোষাক শ্রমিকরা।
বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম
গত চার দশক ধরে বাংলাদেশে তৈরি পোষাক খাতের ব্যাপক বিকাশ ঘটলেও শ্রমিকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী মজুরি বাড়েনি। অথচ এই শিল্পে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে এমন দেশগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি বাংলাদেশের শ্রমিকদের চেয়ে অনেক বেশি।
অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, "বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন, অথচ বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের যে রপ্তানি এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে তা দেখে বুঝা যায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের সক্ষমতাটা।"
সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ছিল ৮ হাজার টাকা। তখন প্রতি ডলার (১ ডলার সমান ৮৫ টাকা) হিসাবে তার পরিমাণ ছিল ৯৫ ডলার। সর্বশেষ প্রস্তাবিত নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১১৩ ডলার। ফলে ডলার হিসাবে বেতন বেড়েছে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ। যদিও মালিকপক্ষের দাবি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেতন বাড়ানো হয়েছে।
অন্যদিকে বর্তমানে চীনের শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ৩০৩ ডলার। সিপিডি‘র তথ্য অনুসারে ভিয়েতনাম ১৭০ ডলার, ভারত ১৭১ ডলার, কম্বোডিয়া ২০০ ডলার এবং ইন্দোনেশিয়ার শ্রমিকরা ২৪৩ ডলার নূন্যতম মজুরি পাচ্ছে। বিপরীতে বাংলাদেশে শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ১১২ ডলার।
বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় কম এই প্রসঙ্গে মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, "অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের তুলনা হবে না। কারণ আমাদের দেশে কোন কাঁচামাল নাই। আমাদের দেশে বায়ার অর্ডার করে অনেক বেশি রিস্কে থাকে। তার কারণ তুলা নাই, ডিপ সি পোর্ট নাই। ফলে আমাদের সময় বেশি লাগে, বিনিয়োগও বেশি লাগে। ফলে কারো এই টাকায় না হলে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে যেখানে বেশি বেতন পাবে সেখানে চলে যেতে পারে।"
"মালিকরা যা বলে সরকারও তাই বলে"
মালিকরা যে মজুরি প্রস্তাব করেছিল মজুরি বোর্ড সেটাই ঘোষণা করেছে। মজুরি বোর্ড শ্রমিকদের কোন প্রস্তাব আমলে না নিয়ে মালিকদের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেছে। এই ক্ষেত্রে বাজারের চিত্র ও শ্রমিকদের জীবন যাত্রার ব্যয়ের কথা বিবেচনা করা হযনি। এখন মালিকদের পক্ষ নিয়ে সরকার আবার শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিকরা।
এ ব্যাপারে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "সরকার ঘোষিত ১২ হাজার ৫০০ টাকা শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত না। ফলে আমরা তা প্রত্যাখান করছি। কারণ মালিকরা যে মজুরি প্রস্তাব করেছিল সেটাই মজুরি বোর্ড ঘোষণা করেছে।"
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার ভয়েস অফ আমেরিকা বলেন, "গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকদের যদি যথেষ্ট মজুরি দেয়া না হয় তাহলে শ্রমিকরা বাঁচতে পারবে না। কিন্তু শ্রমিকদের কথা কেউ শুনে না। মালিকরা যা বলে সরকারও তাই বলে।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশের মন্ত্রী বলেন, মেয়র বলেন কিংবা বড় বড় পদে যারা আছেন সবাই সরকারের অংশ। তারা মালিক তারাই সরকার। তারা যা বলে তাই হয়। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। শ্রমিকদের যে মজুরি দিয়েছে এটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আমরা যদি অন্তত ২০ হাজার টাকা পাই সেটাও বর্তমান বাজারের তুলনায় কিছুই না। ফলে নূন্যতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা এটা পুনঃবিবেচনা করা দরকার।"
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নূন্যতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার করা হয়েছে
মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "রানাপ্লাজা ধ্বসের পরে যখন তৈরি পোষাকখাত মাত্র ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন আসলো কোভিড, তারপর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। আমাদের নির্ভর করতে হয় ইউরোপ আমেরিকার বাজার কেমন (তার উপর)। বর্তমানে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থায় আছে। এই অবস্থার মধ্যে আমরা ৫৬.২৫ শতাংশ বেতন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বৃদ্ধি করেছি। এর চেয়ে বেশি বেতন দেয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরা নূন্যতম মজুরি ১১ হাজার টাকার বেশি দিতে চাইছিলাম না। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা বাড়িয়ে সাড়ে ১২ হাজার করা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "আমরা বিশ্বাস করি আমাদের শ্রমিক ভাইবোনদেরও নূন্যতম মজুরি নিয়ে কোন দ্বিমত নাই। কিছু সংখ্যাক উস্কানিদাতা দ্বারা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে অরাজকতা করছে।"
মজুরি নির্ধারণে ১০টি বিষয়ের পরিবর্তে কেবল মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে লেবার অ্যাক্টে পরিষ্কার করে বলা আছে ১০টি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, নূন্যতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেবল মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনার কথা বলা হয়। এর বাইরে বাকি যে বিষয়গুলোর কথা বলা হয়েছে যেমন কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা, অন্যান্য খাতের মজুরি, আর্থিক খাতে অন্যান্য দেশের মজুরি, চাকরির সক্ষমতা, শ্রমিকদের জীবন মান ও জীবন ব্যয় এই ধরনের বিভিন্ন বিষয়গুলো কিন্তু বিবেচনা করার কথা। কিন্তু নূন্যতম মজুরি বোর্ডেও আমরা এই ধরনের আলোচনা দেখি না।"
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কিছুদিন আগে সিপিডির গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শ্রমিকদের নূন্যতম (গ্রেড -৭) মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা বা এর কাছাকাছি থাকা প্রয়োজন..."সেখানে আমরা দেখিয়েছি শ্রমিকদের খাদ্যজনিত ব্যয় যেমন বেড়েছে এর বাইরে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যজনিত ব্যয়ও অনেক বেড়েছে। এই ব্যয়গুলো শ্রমিকরা মেটাতে পারছে না বলে বর্তমানে ৩৩ শতাংশ শ্রমিকদের কোন না কোনভাবে দেনায় রয়েছে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ শ্রমিকের ১০ হাজার টাকার বেশি ঋণ আছে। এখান থেকে বুঝা যায় শ্রমিকরা যে মজুরি পাচ্ছেন এটা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়।"
তিনি বলেন, "আমরা গবেষণা করে দেখিয়েছি মালিকদের ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে। যদিও এতে তাদের মুনাফা কিছুটা কমে আসবে। তবে মালিকদের পাশাপাশি ব্যান্ড ও বায়ারদেরও বড় দায়িত্ব রয়েছে। তারা যদি তাদের পণ্যের মূল্য ৬ থেকে ৭ শতাংশ বাড়িয়ে দেন তাহলেও এটা দেয়া সম্ভব। ইতিমধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপের বড় বড় ব্যান্ড ও বায়াররা বলেছেন এই দায়িত্ব তারা পরিপালন করবে এবং কিছুটা মূল্য বাড়িয়ে দিবেন।"
নূন্যতম বেতন আরও বাড়ানো হলে অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাবে
এদিকে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ‘র সভাপতি ফারুক হাসান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা চেয়ে বেশি বেতন বাড়ানো হয়েছে। এর চেয়ে বেশি বাড়ানো হলে অনেক গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার মালিক শ্রমিক ও মজুরি বোর্ড সবাই মিলেই এটা ঠিক করেছে। এই পরিস্থিতিতে নূন্যতম বেতন আর বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই।"
তিনি বলেন, "নূন্যতম বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার মাধ্যমে, ৫৬ শতাংশ বেতন এবং ৬৩ শতাংশ বেসিক বেড়েছে। তাদের ওভার টাইম বাড়বে, বোনাস বাড়ছে। ফলে মাসের শেষে তারা যখন বেতন নিয়ে যাবে তখন তারা বুঝতে পারবে।"
অন্যদিকে গাজীপুরের টঙ্গীর আলম টাওয়ার ব্রাভো অ্যাপারেলসে কর্মকত কৃষ্ণ দাস (অপারেটর) ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমি বর্তমানে মাত্র ৯ হাজার ৭৮০ টাকা বেতন পাচ্ছি। এই টাকা দিয়ে আমার মা, ছোট ভাই এবং আমাকেসহ তিন জনের সংসার চালাতে হয়। কিন্তু এই টাকা দিয়ে আমার চলতে অনেক কষ্ট হয়। গত ৩ বছর ৬ মাস ধরে চাকরি করছি। কোন উন্নতি নেই। নূন্যতম বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বাড়ানোর জন্য যারা আন্দোলন করছে আমি তাদের সাথে একমত। এই আন্দোলন আমি সমর্থন করি।"
ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনে ৪ জন নিহতসহ অনেকে আহত ও গ্রেফতার ৯৮
ন্যূনতম মজুরি বাড়াতে গিয়ে শ্রমিকরা পোষাকশিল্প অধ্যুষিত এলাকায় আন্দোলন করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৪ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। অসংখ্য শ্রমিক আহত এবং ৯৮ জন গ্রেফতার হয়েছে। আবার কেউ কেউ গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ফলে তৈরি পোষাকখাতে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। গত কয়েকদিনে ঢাকা, গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারে শত শত পোশাক কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে শ্রমিক ও মালিকরা। এছাড়াও বেশ কিছু কারখানা অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের দাবি করছে মালিকপক্ষ।
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণভাবে অন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলনে পুলিশ যেভাবে হামলা করছে, শ্রমিকদের ওপর গুলি করছে, স্থানীয় মাস্তান দিয়ে শ্রমিকদের পিটানো হচ্ছে এগুলো সরকারকে থামাতে হবে।"
ইতিমধ্যে সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে তা পুনঃবিবেচনার দাবি জানিয়েছে শ্রমিকরা।
এ ব্যাপারে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আখতার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "ঘোষিত ন্যূনতম মজুরী আমরা প্রত্যাখান করেছি এবং সরকারের কাছে এটা পুনঃবিবেচনার আহবান করে আমরা রোববার (১২ নভেম্বর) সরকারের কাছে আপত্তি জানিয়েছি।"
তিনি আরও বলেন, "এই পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি সরকার যদি দমনের পদ বেছে নেয়, সেটা করতে পারে।...এসব আন্দোলনে ৯৮ জন শ্রমিক গ্রেফতার হয়েছে এবং ২০ হাজার শ্রমিককে আসামী করে ৩২টা মামলা দেয়া হয়েছে।"
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "গত কয়েকদিন ধরে যে পরিমাণ শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়েছে এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। শ্রমিক হত্যা করে মজুরি পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। আমরা মনে করি শ্রমিক হত্যা ও গ্রেফতারের জন্য সরকার এবং মালিক একসাথে দায়ী। এসব বন্ধ করে সব কারখানা খুলে দিয়ে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হবে।"
ওদিকে রবিবার (১২ নভেম্বর) বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) জানিয়েছে যে জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় পোশাক কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন মালিকরা।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “যদি কোনো কারখানায় শ্রমিক ভাই-বোনেরা কাজ না করেন, কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে যান এবং কারখানা ভাঙচুর করেন; তবে, কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ভাই-বোন ও সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষায় শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন।”
পোশাক শ্রমিকদের আরো দাবি থাকলে আলোচনা করে ফয়সালা করা যাবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
রবিবার (১২ নভেম্বর) বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর আন্দোলনে বিরোধী দল বিএনপির ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “শ্রমিকদের আরো কিছু দাবি থাকলে, সেগুলো বিজিএমইএ’র নেতাদের সঙ্গে বসে ফয়সালা করা যাবে।”
আসাদুজ্জামান খান বলেন, “বিএনপির কর্মীরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের উস্কে দিচ্ছে। সব দিকে ব্যর্থ হয়ে গার্মেন্টস খাতে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে বিএনপি।” তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী এর আগেও গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন বাড়িয়েছেন, আবার বেতন বাড়িয়েছেন। গার্মেন্টস খাতের সমস্যা মালিকরা সমাধান করবেন।”
ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে দেয়ার পরও তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা চলছে; এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, শ্রমিকদের ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ মজুরি বাড়ানো হয়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী পোশাক ব্যবসায়ীরা এই বেতন বাড়িয়েছেন। ৮ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা করেছেন।”
আগুন, ভাঙচুর কিংবা রাস্তা অবরোধ করে এই সমস্যার সমাধান হবে না বলে জানান আসাদুজ্জামান খান।
এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ ইউএনবি থেকে নেওয়া হয়েছে।