ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামের 'রাস্তার মাস্টারমশাই' মনোনীত ইউনেস্কো-র গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড-এর তালিকায়

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামের 'রাস্তার মাস্টারমশাই' মনোনীত ইউনেস্কো-র গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড-এর তালিকায়

দীপনারায়ণ নায়েক, পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়া স্থানীয় আদিবাসী শিশু আর তাদের বাবা-মায়েদের কাছে যিনি পরিচিত ‘রাস্তার মাস্টার’ নামে। আগামী ৮ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে ঘোষিত হবে বিশ্বের সেরা শিক্ষকের নাম। সেখানে দশজনের তালিকায় মনোনীত হয়েছেন শিক্ষক দীপনারায়ণ নায়েক।

পাকা চার দেওয়ালের মধ্যে নয়, খোলা রাস্তাতেই রোজ বসে তাঁর স্কুল। প্রথাগত শিক্ষা শুধু নয় আদিবাসী সমাজের শিশুদের জীবনের পাঠ দিচ্ছেন তিনি রোজ। সেইজন্যই পশ্চিমবঙ্গের এই মাস্টারমশাইকেই বিশ্বের সেরা দশজন শিক্ষকের তালিকায় বেছে নিয়েছে ইউনেস্কো। একমাত্র ভারতীয় হিসেবে তিনি ইউনেস্কোর গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড-এ মনোনয়ন পেয়েছেন।

রাস্তাতেই তার স্কুল, তাই তিনি 'রাস্তার মাস্টারমশাই'। জামুড়িয়ার আদিবাসী অধ্যুষিত তিলকামাঝি গ্রামের আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে রোজ বসে তার রাস্তার স্কুল। বাড়ির নিকোনো দেওয়ালে রঙ করিয়ে সেখানেই তৈরি হয়েছে ব্ল্যাকবোর্ড। রাস্তায় আসন পেতে বসেই অক্ষর চিনছে পড়ুয়ারা। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা বর্ণমালা। বাড়ির বাইরে পা রাখলে শুধু খেলাধূলা নয়, পড়াশোনাও আকর্ষণ করছে তাদের। গোটা গ্রামই যেন এক পাঠশালা। বই-খাতা, পেন-পেন্সিল পর্যাপ্ত না থাকলেও চলছে পড়াশোনা।

তার নিজের শৈশব কেটেছে চরম অর্থকষ্টে। বাবা ওষুধের দোকানের স্বল্প বেতনের কর্মী ছিলেন। বইপত্র কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন। তাই গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিশুগুলির পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান তিনি।

তিলকামাঝি গ্রামে শিক্ষকতার পাশাপাশি রাস্তাতেও আদিবাসী গ্রামের বাচ্চাদের পড়ান তিনি। বড় স্কুলে পড়াশোনা করার সামর্থ্য নেই যে শিশুদের, তাদের জন্য স্কুলকে পথেই নিয়ে এসেছেন এই মাস্টারমশাই। ২০২০ সালে কোভিড লকডাউনের আগে থেকেই দুঃস্থ শিশুদের বিনামূল্যে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। লকডাউন শুরু হওয়ার পরে তার দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। দীপনারায়ণ নায়েক বলেছেন, গোড়ায় একজন, দু’জন ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু হয়েছিল পথচলা। এরপর ধীরে ধীরে ৭ জন, ১১ জন করে বাড়তে বাড়তে এখন স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা শতাধিক। নতুন ছাত্রছাত্রীরা আসছে। তারা পড়াশোনা করতে খুবই উৎসাহী।

তিনি আরও বলছেন, আদিবাসী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখাতে গিয়ে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা হল এরা সকলেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। পরিবারের সকলেই নিরক্ষর। তাই শিশুদের পাশাপাশি তাদের বাবা-মা, পরিবারের অন্যদেরও লেখাপড়া শেখানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দীপনারায়ণ। “একদিকে বাবা-মা-ঠাকুমা-দাদুরা পড়ছেন, অন্যদিকে তাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা পড়া মুখস্থ করছে। কে আগে লিখতে-পড়তে শিখবে সে নিয়ে প্রতিযোগিতাও চলে,” জানিয়েছেন 'রাস্তার মাস্টারমশাই'।

কখনও ইংরাজি, কখনও নামতার ক্লাস আবার কখনও পিটি ক্লাস, রাস্তার স্কুলে সবই শেখে শিশুরা। দীপনারায়ণ বলেছেন, "এই তিলকামাঝি গ্রামের বেশিরভাগ আদিবাসী মায়েরাই এখন নিজের নাম লিখতে পারেন। তাঁরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেন। নিয়মিত স্কুলে আসেন।"

দীপনারায়ণ গ্রামে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালু করেছেন। নানা রকম বই নিয়ে তিলকামাঝি গ্রামের নানা প্রান্তে ছুটছে তার মোবাইল লাইব্রেরি। কখনও তিনি, কখনও পড়ুয়াদের বাবা-মায়েরা উদ্যোগ নিয়ে বই বিলি করছেন পাড়ায় পাড়ায়। শিক্ষাকে শুধু সিলেবাসে বন্দি করছেন না দীপনারায়ণ, আদিবাসী সমাজে প্রকৃত জীবনের পাঠ পড়াচ্ছেন তিনি নিঃস্বার্থভাবে। তারা পড়াশোনা শেখানোর প্রক্রিয়ায় কোনও সামাজিক বার্তা নেই, কোনও সংস্কারের ঘেরাটোপ নেই। আছে শুধু অনাবিল আনন্দ। শিশু ও তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোই তার লক্ষ্য।