মেনোপজ মানেই  দুশ্চিন্তা, ভয় আর অবসাদ নয়, মত বিশেষজ্ঞদের

প্রতীকী ছবি

“তখন আমার বছর ৪৩ এর কাছাকাছি। বেশ কিছুদিন ধরেই খেয়াল করছিলাম অফিসে মাঝে মাঝেই অসম্ভব গরম লাগছে। কান মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ঘাড়ে মুখে চোখে জল দিয়ে এলে সাময়িক আরাম হলেও সেই অস্বস্তি যেন কাটছে না। দৈনন্দিন কাজকর্ম, সন্তানদের যত্ন, কর্তব্যের খাতিরে করতাম ঠিকই কিন্তু সবসময়ে মন চাইত না। খাওয়ার ক্ষেত্রে অরুচি লাগছিলো। ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করতো। আমার স্বামী আগেই গত হয়েছেন। ফলত, প্রাথমিক ভাবে ঘরের কাজ, অফিসের কাজ সবমিলিয়ে হয়ত এই অস্বস্তি ,অবসাদ লাগছে বলে মনে করি। একদিন আমার কন্যার জন্যই শিশু চিকিৎসকের কাছে যাই এবং খুব সাধারণভাবেই শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতার কথা প্রকাশ করি। তখন তিনিই প্রথম আমাকে সতর্ক করেন যে আমার মেনোপজের সময় মনে হচ্ছে এগিয়ে আসছে। প্রয়োজনে আমি যেন কোন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিই। সৌভাগ্যক্রমে আমার পরিবারের এক সদস্যা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তার কাছে গোটা বিষয়টা জানানোর পর তিনি নিশ্চিত করলেন” – প্রায় দুই দশক আগের অভিজ্ঞতা ভয়েস অফ আমেরিকা-কে শোনালেন ষাটোর্ধ তপতী ঘোষ।

আবার কাকলী বন্দ্যোপাধ্যায় জানান – “বছর দুয়েক আগে থেকে হঠাৎ করে দেখি রক্তচাপের মাত্রা বাড়ছে কমছে, চোখ মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। কাজ করতে ইচ্ছে করছে না, কারুর সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। ঘুমের ওষুধ আমাকে খেতেই হতো বেশ কয়েক বছর ধরেই ডাক্তারের পরামর্শে কিন্তু ঐ সময়ে যেন সেটাও কাজ করত না। আবার ছেলে তার পছন্দ মতো কোন খাবার হয়ত রাতে খেতে চাইছে আর তাতেই হয়ত মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। করতে ইচ্ছে করছে না। প্রথমে বুঝতে পারিনি কেন এটা হচ্ছে। পরে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং জানতে পারি মেনোপজের সময় এসে গেছে।"

মেনোপজ সম্পর্কে ধারণার সময়ের সঙ্গে যথার্থ বিকাশ হয়েছে কিনা, অনেক মহিলা ভাবেন 'ঝামেলা থেকে মুক্তি' আবার আরেক দল মহিলা ভাবতে হয়ত তাদের এবার বুড়িয়ে যাওয়ার পালা শুরু - তাহলে কোন ভাবনাটি আদতে ঠিক আর কোনটি নয় নাকি দুটোই ভুল – এই যাবতীয় দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে এবং নারী, পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে ১৮ অক্টোবর ‘বিশ্ব মেনোপজ দিবস’ উপলক্ষে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।

মেনোপজ কী

মহিলাদের মাসিক চক্রের পরিবর্তনকে মেনোপজাল ট্রানজিশন বলা হয়। সাধারণত একজন মহিলার শেষ মাসিকের ১২ মাস পর যদি তার আর মাসিক না হয় তাহলে তাকে মেনোপজ বলা হয়।

পরিসংখ্যানগত ভাবে ভারতীয় মহিলাদের মেনোপজের গড় বয়স ৪৬.৫ বছর। আর রেঞ্জ হল ৪৪-৫০ বছর। তবে এই সময়সীমার সামান্য আগে বা পরে হলেও কোন ক্ষতি নেই। তবে, ৪০ বছরের নীচে বন্ধ হলে প্রি মেনোপজ আর ৫২ বছরের পরেও বেশ কিছুদিন চললে তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় ডিলেইড মেনোপজ বলা হয় বলে জানিয়েছেন বর্ষীয়ান স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়।

তিনি জানান “মেনোপজকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে নানা মিথ তৈরি হয়েছে। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, এটি কোনো অসুখ নয়। এটি একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। ঠিক যেমন প্রেগনেন্সি। প্রেগনেন্সির সময়ে যেমন আমাদের যত্ন পরিচর্যার প্রয়োজন, মেনোপজও ঠিক তাই। শরীরের কোনও রোগ নয়, তাই আলাদা করে চিকিৎসা দরকার নেই। নিয়মিত একটা অভ্যাসের হঠাৎ বন্ধ হওয়া ছাড়া আর কোন শারীরিক পরিবর্তন হয় না এইসময়ে। তাই অযথা দুশ্চিন্তা বা ভয়ের কোন কারণ নেই।”

এই সময়পর্বের উপসর্গসমূহ

অল্প সময়ের মধ্যে বা হঠাৎ করে মেনোপজ হওয়া সম্ভব নয়। কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া এগিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে শুভব্রতা বসু তার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে – “এক এক সময়ে মনে হতো কান ও মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে যেন আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে, অবসাদও গ্রাস করছে, মুড সুইং হচ্ছে সঙ্গে টেনশনের মাত্রাও অযথা বেড়ে যাচ্ছে। সেই সময়ে কী করব ভেবে না পেরে তাই খানিক বাধ্য হয়েই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি”।

বিশেষজ্ঞরাও জানিয়েছেন কোনও শারীরিক পরিবর্তন না হলেও বেশ কিছু উপসর্গ মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়; যেমন –

১) হট ফ্লাশ

২) নাইট সোয়েট

৩) রাতে ঘুম ভাঙার পর আবার ঘুম আসতে দেরি হওয়া বা অনিদ্রা

৪) মন-মেজাজের ঘনঘন পরিবর্তন

৫) জননাঙ্গে শুষ্ক ভাব

৬) একাকীত্বের ভাব

৭) ডিপ্রেশন বা অবসাদ

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ চান্দ্রেয়ী ভট্টাচার্য-র সঙ্গে। তিনি বলেন, মেনোপজের হয়ত মাস ছয়েক আগে থেকেই হট ফ্লাশ অর্থাৎ হঠাৎ করে নারীর শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে গরম হল্কা বের হওয়ার অনুভূতি দেখা দিতে পারে। হট ফ্লাশ-এর স্থায়িত্ব মেনোপজের পরে ছয় মাস থেকে দুই বছর ধরেও চলতে পারে।

নাইট সোয়েট বা রাতে ঘুম ভেঙে সারা শরীর ভিজে জবজবে হয়েছে, এমনও দেখা যেতে পারে আবার প্রচণ্ড মুড সুইং হয়, মাথাধরা, ভুলে যাওয়া বা মনোযোগের অভাব, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাও হয়ে থাকে। অনেক মহিলাদের এই সময়ে ইউরিনের মাত্রাও বেড়ে যায় এমনও দেখা যায়। সেই সঙ্গে এই পর্যায়ে মহিলাদের জননাঙ্গে শুষ্ক ভাব দেখা যায়, ফলে, শারীরিক সম্পর্কে অনীহা দেখা দিতে পারে। এই বিষয়গুলি মূলত ইস্ট্রোজেনের অভাবজনিত কারণেই হয়ে থাকে। তবে এসবের কোনোটিই দীর্ঘস্থায়ী হয় না বলে জানিয়েছেন ডঃ ভট্টাচার্য। কিন্তু কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে সমস্যা গুরুতর হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

“শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক অবসাদও এই পর্যায়ে মহিলাদের গ্রাস করে। তারা একাকীত্বে ভুগতে থাকেন যাকে এম্পটিনেস সিনড্রোম বলা হয়। এটি হয় সাধারণত, একদিকে সন্তানদের বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনো যেখানে তারা নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চেষ্টা করছে অন্যদিকে পার্টনারের চূড়ান্ত কর্মব্যস্ততা- ফলত এই হঠাৎ করেই কাজের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা তৈরি হচ্ছে যা মহিলাদের ডিপ্রেশনে নিয়ে যায়। আবার এর থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় হীনমন্যতা, যা একপ্রকার সমাজ নিয়ন্ত্রিতও বটে। আমার সৌন্দর্য কমে যাবে – আমার আর যৌন সক্ষমতা থাকবে না ফলে আমার পার্টনার আমাকে হয়ত আর পচ্ছন্দ করবে না বা আমার শরীরে এবার হাজার রোগ বাসা বাঁধবে অর্থাৎ লোকে কী মনে করবে – এইসব নানা নেতিবাচক চিন্তা মহিলাদের মানসিক অস্থিরতায় ফেলে” – জানিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার পাভলভ হাসপাতালের মনোবিদ গীতশ্রী সাহা।

মেনোপজের সময় নিজেকে সুস্থ রাখতে হলে জীবনধারা কেমন হবে

ডঃ চান্দ্রেয়ী ভট্টাচার্যের কথায় - “পোস্ট মেনোপজাল পিরিয়ডে মহিলাদের কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ, অস্টিওপোরোসিস ও ক্যান্সারের ( বিশেষ করে সারভাইকাল ক্যান্সর ও ব্রেস্ট ক্যান্সর) সম্ভবনা বৃদ্ধি পায় তাই এই বিষয়ে বিশেষ সচেতনতা ও যত্নের প্রয়োজন। মহিলাদের নিয়ম করে মাসে একবার অন্তত ব্রেস্ট পরীক্ষা করা দরকার। এর জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, সঠিক পদ্ধতি জেনে নিয়ে বাড়িতেই করা যেতে পারে। তবে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।"

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা আমরি হসপিটাল (ঢাকুরিয়া)-র মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল মহিলাদের শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পরামর্শ দেন –

১) নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীর চর্চা, যাপিত জীবনে পরিবর্তন, পর্যাপ্ত ঘুম, ওজন নিয়ন্ত্রণ, যোগাসন, মেডিটেশন মন প্রফুল্ল রাখতে সাহায্য করে।

২) অনেকের ক্ষেত্রে এই সময় ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা থাকে যার ফলে এই ৫-৭ বছরের মধ্যেই হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই যথাসম্ভব হাই কার্বোহাইড্রেট, হাই ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলা প্রয়োজন।

৩) ধূমপান, মদ্যপান বর্জন করাই বাঞ্ছনীয় কারণ এতে ডিপ্রেশন, মানসিক অস্থিরতার সঙ্গে হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে।

৪) যাদের রাতে ঘুমের সমস্যা আছে তারা এই সময়ে রাতে খুব মশলাযুক্ত খাবার খাবেন না, এতে অনিদ্রার সম্ভবনা আরও বেড়ে যায়।

৫) যারা দীর্ঘদিন হাড়ের সমস্যায় ভুগছেন বা বলা ভালো অস্টিওপোরোসিসের শিকার তারা হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন – দুগ্ধজাত দ্রব্য, দই, মাছ ইত্যাদি খেতে পারেন। অতিরিক্ত ভিটামিন ডি-র অভাব থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টও নেওয়া যেতে পারে। তবে সবক্ষেত্রেই অবস্থা গুরুতর হলে অবশ্যই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।

মনোবিদ গীতশ্রী সাহা মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা বিষয়ে বললেন –

১) ঋতুস্রাবের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে বয়ঃসন্ধিতে স্বাভাবিক নিয়মে যা শুরু হয়েছে মধ্যবয়সে এসে তা বন্ধ হবেই। এই সহজ বিষয়টিকে প্রথম থেকেই আমাদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে মাথায় ঢুকিয়ে নিতে হবে।

২) মনে রাখতে হবে, এটা আমার আপনার একার নয় বিশ্বের সব মেয়েদের আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। সুতরাং প্রতিটি মহিলাকেই এই পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যেতেই হবে। তাই আলাদা দুশ্চিন্তা বা ভয়ের কোন কারণই নেই। জীবনের প্রত্যেক পর্যায়েরই নিজস্ব বয়সোচিত সৌন্দর্য থাকে তাকে লালন করুন, প্রকাশ করুন।

৩) নিজেকে ভালবাসা নিজের যত্ন নেওয়া ভীষণ জরুরি। সেক্ষেত্রে চাইলে আপনি সৃজনশীল কিছু কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন। নতুন কিছু শিখতেও পারেন। এতে নেতিবাচক চিন্তা থেকে দূরে থাকবেন ও মন ভালো থাকবে।

৪) মন খুলে কথা বলতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে। হীনমন্যতায় না ভুগে বা লজ্জা না পেয়ে পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দর আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য এবং সর্বোপরি পার্টনারের সচেতনতা, সহযোগিতা ভীষণ কাম্য।