বিশ্ব দৃষ্টি দিবস: অন্ধত্ব থেকে রক্ষা পেতে চোখের যত্নে সতর্ক হতে হবে

প্রতীকী ছবি

মানবদেহের সংবেদনশীল অঙ্গগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয় আমাদের চোখ। অথচ চোখের যত্নের ব্যাপারে আমরা সবচেয়ে বেশি উদাসীন। আজকের আধুনিক বিশ্বে দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিন টাইম, ধুলোবালি, দূষণ ইত্যাদির কারণে আমাদের চোখের সুস্থতা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। চোখের সমস্যাগুলোর অবহেলার পরিণতি হতে পারে চিরদিনের মতো অন্ধত্বকে বরণ করে নেয়া।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্ধত্ব প্রতিরোধের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা 'ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস' (IAPB) যৌথভাবে জানাচ্ছে, সারা বিশ্বে আনুমানিক ৪০ থেকে ৪৫ মিলিয়ন মানুষ দৃষ্টিশক্তিহীন এবং ১৩৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন। সচেতনতা এবং সঠিক যত্নের মাধ্যমে এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ক্ষতি প্রতিরোধ বা নিরাময় করা যেতে পারে।

বৈশ্বিক পর্যায়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা এবং অন্ধত্বের প্রধান কারণ হল প্রতিসরণ ত্রুটি (refractive error) এবং ছানি। প্রতিসরণ ত্রুটি অর্থাৎ চোখে ঝাপসা দেখা, কাছের বস্তু কিংবা দূরের বস্তু কম দেখা অর্থাৎ সাধারণ ভাষায় যে সমস্যাগুলিকে চোখের পাওয়ারের সমস্যা বলা হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো বলছে, সময়মত সনাক্তকরণের অভাবে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেলে কিংবা হারিয়ে গেলে তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব জনজীবনে এবং অর্থনীতিতে পড়তে পারে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা সব বয়সের মানুষকে প্রভাবিত করে যার মধ্যে শিশু থেকে পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি রয়েছেন। বাংলাদেশের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক কোটি ৪৩ লাখ লোক দৃষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধতার প্রধান কারণ ছানি।

বিশ্ব দৃষ্টি দিবস

প্ৰতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অন্ধত্ব এবং চোখের বিকলতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে গোটা বিশ্বজুড়ে ‘বিশ্ব দৃষ্টি দিবস’ পালন করা হয়। ২০০০ সালে লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক অনুষ্ঠিত সাইট—ফার্স্ট—ক্যাম্পেইনের ফলশ্রুতিতে এই দিবসের শুরু হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় এবং ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস (IAPB)-এর পরিচালনায় এই দিবসটি বহুল ভাবে প্রচারিত হয়ে আসছে। এবারে ১২ অক্টোবর, ২০২৩—এ বিশ্ব দৃষ্টি দিবসের মূল থিম, “Love your eyes at work” অর্থাৎ দিবসটি কর্মক্ষেত্রে চোখের স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা প্রচার করছে।

কর্মক্ষেত্রে চোখের সমস্যা ও সতর্কতা

বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে চোখের কী ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসছেন সে বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভয়েস অফ আমেরিকা-কে জানালেন শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞ এবং কনসালটেন্ট অপথালমোলজিস্ট ডা. সারওয়াত সালেক। তিনি বলেন, "আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এখন স্ক্রিন যোগ হয়েছে। ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ট্যাব, কম্পিউটার এগুলোর দিকে তাকিয়ে আমাদের দিনের বেশিরভাগ সময় চলে যাচ্ছে। যারা অফিসে কম্পিউটারে কাজ করেন এবং পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজে স্ক্রিন বেশি ব্যবহার করেন তাদের চোখের ড্রাইনেসের সমস্যা হয়। আমরা এটাকে ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম’ বলি। আমাদের চোখের ব্লিঙ্কিং-এর একটা রেট আছে, কিন্তু যখনই আমরা স্ক্রিনে থাকি বা স্ক্রিন ছাড়াও যখন কোনও কাজ মনোযোগ দিয়ে করি তখন ব্লিঙ্কিং রেট কমে যায়। তখন আমাদের চোখের যে পানি লেয়ার থাকে সেটার প্রপার ডিস্ট্রিবিউশন হয় না।

সেক্ষেত্রে আমরা পরামর্শ দেই, চোখটা কিছুক্ষণ পরপর বন্ধ করতে। টানা স্ক্রীন ইউজ করতে মানা করি। বারবার চোখের পলক ফেলতে হবে। কিছু আর্টিফিশিয়াল টিয়ার পাওয়া যায় সেরকম আর্টিফিশিয়াল টিয়ার তারা ব্যবহার করতে পারেন। আমরা বলি কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রতি বিশ মিনিট অন্তর চোখ বন্ধ করে রাখতে হবে অথবা দূরে যদি তাকানোর কিছু সুযোগ থাকে যেমন চোখের সামনে বারান্দা, আকাশ, সবুজ গাছপালা ইত্যাদির দিকে তাকাতে হবে। মোট কথা চোখকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিতে হবে।

ফ্যাক্টরি ওয়ার্কশপ ইন্ডাস্ট্রি এগুলোতে যারা কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী কিছু নিয়মনীতি আছে যেগুলো ফলো করা হয় না। কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজ আছে, যেগুলোতে চোখে কোনো অবজেক্ট এসে পড়ার কিংবা আঘাত লাগার সম্ভবনা আছে। আমরা এগুলোকে ‘ফরেন বডি’ বলি। সে ক্ষেত্রে প্রোটেকটিভ গ্লাস অথবা শিল্ড ব্যবহার করতে হবে। যেমন, রাস্তার ধারে ওয়ার্কশপে যারা কাজ করেন, লেদ মেশিনে যারা কাজ করেন, এ ধরণের কারখানায় একটা কিছুতে বাড়ি দিলো কোন একটা মেটেরিয়াল সেখান থেকে চোখে যাওয়া, সেটা ইঁটের গুড়া হতে পারে, লোহার কণাও হতে পারে। এ ধরনের জিনিস ছুটে এসে চোখে খুব জোরে আঘাত লাগে এবং ফ্রিকোয়েন্টলি এ ধরনের পেশেন্ট আমরা আউটডোরে পাই। তাই যারা এ ধরণের কাজ করেন তারা অবশ্যই যেন প্রটেকশন নিয়ে কাজ করেন। কারখানাগুলোতে প্রটেক্টিভ গ্লাস অথবা শিল্ড অবশ্যই অ্যাভেইলেবল থাকতে হবে।”

ডা. সারওয়াত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর কাজের পরিবেশ সম্পর্কে বলেন, “আমি নিজে গিয়ে দেখেছি, গার্মেন্টস এবং নিটিং ফ্যাক্টরিতে যারা কাজ করেন তাদের চোখের ভেতরে চুল, চোখের পাতা এবং উলের আঁশ চলে যায়। এগুলো দু ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে। একটা হচ্ছে শ্বাসনালীতে গিয়ে শ্বসনতন্ত্রে সমস্যা তৈরি করে, তার পাশাপাশি চোখেরও সমস্যা হয়। এই আঁশ থেকে এলার্জি সমস্যা হবে, চোখে চুলকানি হবে, চোখে ঝাপসা দেখবে। এ ধরনের কাজ যারা করেন তাদেরও চোখের প্রটেকশন নিয়ে কাজ করা উচিত।” ডা. সারওয়াত আরো বলেন, “এছাড়া যারা গার্মেন্টসে সুতা কাটার কাজ করে তাদের হাতে এক ধরনের চোখা বস্তু থাকে, নিডল থাকে এটা খুবই রিস্কি। এটা থেকে চোখে ইনজুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই জিনিসগুলা এতটাই শার্প এবং হঠাৎ করে এত জোরেই চোখে যায় যে অনেক ক্ষেত্রে চোখকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে যায়। পার্মানেন্টলি একটা চোখ চলে যেতে পারে। গার্মেন্টেসে যারা কাপড় কাটেন তাদের কাপড়ের আঁশগুলো উড়ে, উলের ফ্যাক্টরিতেও তাই হয় এবং টেক্সটাইলগুলোতেও তাই হয়। এটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল হ্যাজার্ড-এর মধ্যেই পড়ে। এটা ফুসফুস এবং চোখ উভয়েরই সমস্যা তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে মাস্ক পড়া এবং চোখের প্রটেকশন নেয়াটা খুব জরুরী।"

শিশুদের চোখের সমস্যা ও যত্ন

ডা. সারওয়াত বাড়ির বাইরে অর্থাৎ স্কুলে শিশুরা চোখের কী ধরণের দুর্ঘটনায় পড়তে পারে সে সম্পর্কে বলেন, “শিশুদের ক্ষেত্রে স্কুলে যতক্ষণ থাকবে খুব ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে ট্রমার শিকার হচ্ছে কি না। স্কুলে শিশুদের হাতে পেন্সিল, কলম, ধারালো স্কেল এ জাতীয় জিনিস হাতে থাকে। অনেকসময় দুষ্টুমি করে একজন আরেকজনকে এসব বন্তু দিয়ে আঘাত করে ফেলে। এটার ব্যাপারে সবাইকে কেয়ারফুল থাকতে হবে এবং এ ধরনের কিছু হলে সাথে সাথে কোনো চক্ষু হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যেতে হবে। এ ধরণের পেশেন্ট আমরা বেশি পেয়ে থাকি। “ তিনি জানালেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আবার আরেক ধরনের সমস্যা দেখা যায়। মাদ্রাসার বাচ্চাদের শাস্তিস্বরূপ অনেকসময় লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। ডা. সারওয়াত বললেন, অনেক সময় এক্সিডেন্টালি চোখে লেগে যায়। এ থেকেও শিশু চোখে মারাত্মক আঘাত পেতে পারে।

চক্ষু হাসপাতালে আর কী ধরণের সমস্যা নিয়ে শিশুরা আসে সে প্রশ্নে উত্তরে ডা. সারওয়াত জানালেন,

“এখন যেহেতু আমাদের স্ক্রিন টাইম খুব বেশি তাই ড্রাইনেস রিলেটেড রোগী আমরা হাসপাতালে বেশি পাই। এছাড়া এমনকি একই কারণে আমরা বেশিরভাগ শিশুদের চোখের পাওয়ারের সমস্যা পাচ্ছি। শিশুদের চোখের পাওয়ারের সমস্যা বাড়ছে। এটা খুব বেশি হচ্ছে শিশুদের অতিরিক্ত পরিমাণ ডিভাইস নির্ভর করার ফলে। এমনকি দেড় বছর বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও আমরা এই দৃষ্টি ক্ষীনতার সমস্যা লক্ষ্য করছি। তার একটাই কারণ হচ্ছে অনেক বেশি সময় তারা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাচ্ছে। এছাড়াও চোখের ড্রাইনেসের সমস্যা হচ্ছে। চোখ চুলকাচ্ছে, চোখের শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে, এলার্জির সমস্যা হচ্ছে এবং চোখে কম দেখছে।”

চোখের সাধারণ যত্ন

দৈনন্দিন জীবনে চোখের সাধারণ কিছু যত্ন চোখকে ভালো রাখে। যেমন :

· রোদের হাত থেকে চোখকে রক্ষা করার জন্য যারা চশমা পরেন তারা ইউভি প্রোটেকটিভ লেন্স ব্যবহার করতে পারেন। যারা চশমা পরেন না তারা ভালো সানগ্লাস ব্যবহার করতে পারেন।

· স্ক্রিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সতর্ক হোন। প্রয়োজন ছাড়া সারাক্ষণ মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।

· চোখের কোনো সমস্যা না থাকলে বছরে একবার নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করান।

· ক্রনিক ডিজিজের পেশেন্ট যেমন হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী, ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে চোখে যদি সমস্যা না থাকে তাহলে ছয় মাস থেকে এক বছর পর পর চেক আপ করানো উচিত। আর যদি সমস্যা হয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চেক আপে থাকতে হবে।