মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাকেন্দ্র বলতে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ শুধু পাবনা মানসিক হাসপাতালকে বুঝলেও রাজধানী ঢাকা শহরের শেরে বাংলা নগরে প্রায় ২২ বছর ধরে ‘উন্নত চিকিৎসা’ দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। মাত্র ১০ টাকায় এখান থেকে চিকিৎসা নিতে পারেন দেশের যেকোনো অঞ্চলের মানুষ।
হাসপাতালটির চিকিৎসকেরা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, এখানকার চিকিৎসা প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় অনেকেই আসেন না। বর্তমান সক্ষমতায় হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার রোগীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হলেও চিকিৎসা নিতে আসেন ৪৫০ থেকে ৫০০ জন। তবে হাসপাতালটিতে ভর্তিযোগ্য রোগীর সংখ্যা প্রায়ই বেশি থাকে।
কীভাবে ভর্তি হতে হয়, কত টাকা খরচ হয়,কতদিন থাকা যায়-এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে সম্প্রতি হাসপাতালটি ঘুরে দেখেছেন এই প্রতিবেদক। চিকিৎসাপ্রত্যাশী রোগীদের পাশাপাশি কথা বলেছেন বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকের সঙ্গে।
শুরুতে বহির্বিভাগ
হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে হলে কাউন্টার থেকে প্রথমে ১০ টাকা মূল্যের টিকিট কেটে বহির্বিভাগে লাইনে দাঁড়াতে হয়। অবস্থা গুরুতর না হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে রোগীকে ছেড়ে দেন। তবে ফলোআপে আসতে বলা হয়। পাশাপাশি স্বজনকে বলে দেওয়া হয়, পারিবারিক পরিবেশে রোগীকে যত্নে রাখতে। কারো কাছে আবার ১০ টাকা না থাকলে আছে বিকল্প উপায়।
‘‘১০ টাকাও না থাকলে এখানে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে টিকিট কাটার ব্যবস্থা করা হয়,’’ জানিয়ে হাসপাতালটির অভ্যর্থনাকক্ষ থেকে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলা হয়, ‘‘এখানে আসা কোনো রোগীই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন না। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আসা মানুষ চিকিৎসা নিতে পারেন। শুক্রবার এবং সরকারি ছুটির দিন বাদে সকাল আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বহির্বিভাগে সেবা দেওয়া হয়। পাশাপাশি জরুরি বিভাগ ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে।’’
চিকিৎসা প্রক্রিয়া
বহির্বিভাগে ৯ জন কনসালট্যান্ট বিভিন্ন কক্ষে প্রথমে রোগীদের দেখেন। যাদের ‘গৃহপরিবেশে’ রেখে চিকিৎসা করানো সম্ভব, তাদের প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে বাসায় পাঠানো হয়। নির্দিষ্ট দিন পর এই রোগীরা ফলোআপ চিকিৎসা নিতে আসেন। এছাড়া যারা গুরুতর মানসিক সমস্যা নিয়ে আসেন অর্থাৎ যাদের বাড়ির পরিবেশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না, তাদের ১০১ নম্বর রুমে আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রেফার করা হয়।
রেফারড রোগীদের জন্য প্রতিদিন একটি বোর্ড বসে।এই বোর্ডে একজন আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট, একজন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং একজন সাইকিয়াট্রিস্ট সোশ্যাল ওয়ার্কার রোগীদের ভর্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। মাঝে মাঝে শয্যার তুলনায় ভর্তিযোগ্য রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। তখন রোগীদের অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়।
জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ওবজারভেশন ওয়ার্ড আছে। সেখানে ১২টি বেড।
হাসপাতালটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আট তলা ভবনটিতে একসাথে চার শতাধিক রোগী ভর্তি হতে পারেন। আগে ২০০ রোগী ভর্তি হতে পারত।
ভর্তিতে খরচ
বেডগুলোর মধ্যে ৭০ শতাংশ নন-পেয়িং। ৩০ শতাংশ পেয়িং বেড। যেসব রোগী নন-পেয়িং বেডে ভর্তি হন, তাদের ১০ টাকার পাশাপাশি মাত্র ১৫ টাকার ভর্তি ফি দরকার হয়।
এবিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার মোহাম্মদ জামাল হোসেন বলেন, ‘‘যতদিন ভর্তি থাকবেন, ততদিন বাবদই এই ১৫ টাকা দিতে হবে। অধিকাংশ ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। আমার জানামতে ৯০ শতাংশ ওষুধই বিনামূল্যে হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। পাশাপাশি শুধুমাত্র রোগীর জন্য তিনবেলা খাবার দেওয়া হয়।’’
‘‘যেসব রোগী একবারে দরিদ্র, কোনো ওষুধই বাইরে থেকে কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের হাসপাতালের সমাজসেবা কার্যালয় থেকে আর্থিক সাহায্য করা হয়।এমনকি যদি কারো যাতায়াত ভাড়াও না থাকে, আমরা দূরত্ব অনুযায়ী সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত সাহায্য করি। প্রতিদিন তিন থেকে চারজন রোগীকে এই ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়।’’
তিনি জানান, পেয়িং সেকশনে সম্প্রতি কেবিন বাড়ানো হয়েছে। আগে ছিল ১৫টি। বাকিগুলো বেড।পেয়িং বেডে সরকারি খরচ প্রতি দশদিনে ২ হাজার ৭৫০ টাকা। ওষুধ এবং খাবার বিনামূল্যেই পাওয়া যায়। ভর্তির সময় রোগীকে দশদিনের টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হয়। কোনো কারণে বেশি সময় থাকতে হলে নির্দিষ্ট সময় পরপর বাকি টাকা জমা দিতে হয়। রোগীকে আগেভাগে ছেড়ে দেওয়া হলে অবশিষ্ট টাকা অ্যাকাউন্ট সেকশন থেকে ফেরত দেওয়া হয়।
আউটডোর থেকে ইনডোরে ভর্তি হতে আসা রোগীদের জন্য ছয়টি বিভাগ আছে। প্রতিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানেই একজন প্রফেসর অথবা অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর থাকেন। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, মেডিকেল অফিসার এবং পর্যাপ্ত ট্রেইনি ফিজিশিয়ান রয়েছেন, যারা হাসপাতালটিতে বিভিন্ন কোর্সে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এরমধ্যে সরকারি-বেসরকারি ডাক্তার রয়েছেন।
এবিষয়ে জামাল হোসেন বলেন, ‘‘সরকারি ডাক্তাররা তাদের নির্ধারিত পোস্টের সাথে সাথে আমাদের নিয়মিত শিক্ষার্থী। তারাও অ্যাকাডেমিং এবং ক্লিনিক্যাল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বেসরকারি ডাক্তারদের অনেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে তারা ভর্তি হন। সব বিভাগের সঙ্গে সূচি অনুযায়ী কাজ করেন।’’
যে ধরনের রোগী বেশি দেখা যায়
বহির্বিভাগে লাইনে দাঁড়ানো কমপক্ষে ১০ জন রোগীর স্বজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের চারজন ‘আবেগজনিত মানসিক সমস্যার’ কথা উল্লেখ করেন।
পরে হাসপাতাল সূত্রেও জানা যায়, এই ধরনের রোগীর সংখ্যা সম্প্রতি বেশি দেখা যাচ্ছে। অ্যাডমিশন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভর্তি হওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেয়েছি বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার রোগী। এটি একটি আবেগজনিত মানসিক সমস্যা। দ্বিপ্রান্তিক মানসিক রোগ।’
বাইপোলার অর্থ দুটি পোল বা মেরু। এক মেরুতে বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন। আরেক দিকে অতি উৎফুল্লতা বা ম্যানিয়া। এখানে আবেগের প্রকাশ বেশি। এই রোগীরা স্বাভাবিক পরিবেশ বুঝতে পারেন না। অসম্ভব কল্পনায় ডুবে থাকেন।
রোগটির বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের চিকিৎসকেরা খুবই অল্প সময়ে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনেন। এই ধরনের রোগীদের ছুটি দেওয়ার সময় বলে দিতে হয় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করবেন না। রোগটি যেন বারবার না হয়, সে জন্য ফলোআপ চিকিৎসা নিতে আসতে বলা হয়।’’
তিনি জানান, এর পাশাপাশি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যাও যথেষ্ট। তৃতীয় সর্বোচ্চ রোগী নেশাগ্রস্ত। অর্থাৎ নেশার কারণে যাদের মানসিক সমস্যা হয়েছে। নারীদের মধ্যে বেশি রোগী আসেন কনভারশন ডিসঅর্ডার সমস্যা নিয়ে। জীবনের কোনো স্ট্রেস বা দুর্ঘটনা থেকে এই রোগীদের মানসিক রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। এর পাশাপাশি বেশ কিছু ডিপ্রেশনের রোগীও ভর্তি হন। সন্তান জন্মদানের পর অনেক নারীর মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। কমিউনিটি পর্যায়ে যখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তখন এখানে ভর্তি করানো হয়।
জামাল হোসেনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটিতে প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীরাই বেশি ভর্তি হন, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬০। শিশুদের বহির্বিভাগে বেশি চিকিৎসা দেওয়া হয়। শিশুদের জন্য পারিবারিক পরিবেশই সবচেয়ে ভালো বলে মনে করা হয়।
ওষুধ-ভিত্তিক চিকিৎসার পাশাপাশি কাউন্সিলিংও করা হয়। বিভিন্ন ধরনের থেরাপিও দেওয়া হয়।
বাড়ি ফিরতে থাকা কমপক্ষে পাঁচজন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের তিনজন সর্বোচ্চ একমাস ভর্তি ছিলেন। বাকিরা দুই সপ্তাহ করে। এই রোগীর স্বজনেরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক মাসের বেশি সময় রাখা হয় না।
অন্যদিকে বহির্বিভাগে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার রোগী। এরপর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, অফসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, সাবসটেন্স ডিসঅর্ডার। অনেক রোগী আছেন, যাদের মানসিক রোগের সব উপসর্গ থাকে না কিন্তু নিজে সমস্যা অনুভব করেন-এই ধরনের রোগীও এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। এই রোগীদের অনেক ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি নিতে হয়।
থেরাপির বিষয়ে জামাল হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের এখানে সরকারিভাবে ক্লিনিক্যাল সাইকোথেরাপিস্টের সংখ্যা কম হলেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং গ্রাজুয়েশন লেভেলের প্রচুর প্লেসমেন্ট শিক্ষার্থী আছেন। তারা খুবই দক্ষ। প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ জন রোগীকে তারা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।’’
গবেষণা ও জরিপ
হাসপাতালটির চিকিৎসকেরা গবেষণা কাজেও নিয়োজিত। জাতীয় পর্যায়ে প্রায় প্রতি বছর বড় ধরনের জরিপ করা হয়। হাসপাতালটির করা ২০১৯ সালের একটি জরিপ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। সেই জরিপের বিষয়ে তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘দেশের ১৬.৮ শতাংশ মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।’’
তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালে যত মানুষ চিকিৎসার প্রত্যাশা নিয়ে আসেন, তাদের ৩০ শতাংশ রোগীরই আন্ডারলাইন কোনো না কোনো মানসিক রোগ আছে।’’
পাবনার সঙ্গে পার্থক্য
পাবনা মানসিক হাসপাতালের সঙ্গে এই হাসপাতালের পার্থক্য জানতে চাইলে জামাল হোসেন বলেন, ‘‘এক কথায় দুটোই মানসিক হাসপাতাল। আমাদের এখানে অ্যাকাডেমিক কোর্স আছে। এফসিপিএস ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটে যারা পার্ট-১ পাশ করেন, তারা পরবর্তী চার অথবা পাঁচ বছর কোর্সের মাধ্যমে থাকেন। এখানে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তারা পরীক্ষা দেন। বেইসিক এমডি কোর্স আছে।’’
‘‘পাবনা মূলত দীর্ঘমেয়াদী আবাসিক সুবিধার মানসিক হাসপাতাল। একটা সময় সেখানে ছয়মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত রোগী রাখা হতো। এখন তারা হয়তো তিন থেকে ছয়মাস রোগী রাখে। কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে আরও বেশিদিন রোগীরা থাকেন।’’
‘‘আমাদের এখানে সেইসব রোগী বেশি আসেন, যারা নিজেদের মানসিক সমস্যা ধরতে পারেন, সমস্যার কথা নিজেই ডাক্তারকে বলতে পারেন।’’
‘‘অন্যদিকে যেসব রোগী নিজেদের মানসিক সমস্যা বুঝতে পারেন না, স্বীকার করেন না, সমস্যার কথা নিজে বলেন না, ঘর থেকে বেরিয়ে যান, অন্য কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন-পাবনায় এই ধরনের রোগী বেশি। পৃথিবীতে ১ থেকে ১.১ শতাংশ এই রোগী দেখা যায়।’’
‘‘পাবনার সঙ্গে আমাদের খুবই ভালো যোগাযোগ,’’ মন্তব্য করে জামাল হোসেন আরও বলেন, ‘‘আমাদের এখানে রোগীর সঙ্গে স্বজনের উপস্থিতি থাকতে হয়। পাবনায় স্বজন ছাড়াও অনেককে সরকারিভাবে ভর্তি করা হয়। আমাদের এখানে যেসব রোগীর সঙ্গে স্বজনেরা থাকতে পারেন না, তাদের পাবনায় রেফার করা হয়।’’