ভারতে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় স্ক্যাম মহাদেব বেটিং চক্র

ভারতে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় স্ক্যাম মহাদেব বেটিং চক্র

সৌরভ চন্দ্রাকার এই নামটিই এখন তোলপাড় ফেলে দিয়েছে সারা ভারতে। আর্থিক দুর্নীতি সংক্রান্ত যতগুলি মামলা ইদানীংকালে ভারতে হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে আগেই থাকবে মহাদেব বেটিং চক্র। কারণ এই স্ক্যামে নাম জড়িয়েছে বলিউডের তাবড় অভিনেতাদের। এই চক্রের যিনি মাথা সেই সৌরভ চন্দ্রকার একসময় রাস্তায় ফলের রস বিক্রি করতেন। আজ তিনি পাঁচ হাজার কোটির মালিক। নিজের বিয়েতেই খরচ করেছেন ২০০ কোটি টাকা।

মহাদেব অনলাইন বেটিং অ্যাপ-এর মাধ্যমে ফুটবল, ক্রিকেট, হর্স রেসিং, টেনিস, পোকার সহ বিভিন্ন খেলায় বিনিয়োগ করা হত। যার মাধ্যমে চলত কোটি কোটি টাকার প্রতারণা। সৌরভের বয়স আনুমানিক ৩৫। বাড়ি ভারতের ছত্তীসগঢ়ের প্রত্যন্ত এলাকা ভিলাইতে। বর্তমান ঠিকানা ছিল সৌদি আরব। সেখানেই ব্যবসা জমিয়ে বসেছিলেন। ‘অনলাইনে বেটিং অ্যাপ’ খুলে কোটি কোটি টাকা রোজগার করতেন সৌরভ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সৌদি আরবে ধূমধাম করে বিয়ে করেন সৌরভ। একদিনের অনুষ্ঠানেই খরচ হয়েছিল ২০০ কোটি টাকা। বিয়েতে নিমন্ত্রিত আত্মীয়রা প্রত্যেকে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত বিমানে। আমন্ত্রিত ছিলেন বলিউডের একাধিক তারকা। বিয়েতে ‘পারফর্ম’ করেছেন আতিফ আসলাম, নেহা কক্কর, বিশাল দাদলানিরা। এই সৌরভ চন্দ্রাকারই দেশের ৫ হাজার কোটি টাকার ‘স্ক্যামে’র মূল চক্রী বলে দাবি করেছেন তদন্তকারীরা।

সৌরভের এই সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার নেপথ্যে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম রাজ গুপ্তা ওরফে রাজ ভাইয়া। ইডি জানতে পেরেছে, ভিলাইয়ের চার-পাঁচজন যুবককে নিয়ে প্রতারণার কারবার শুরু করেছিলেন সৌরভ। রাজই মূলত ওই অ্যাপের কাস্টমার ইউজার আইডি তৈরি করা থেকে কী ভাবে টাকার লেনদেন হবে, তা দেখভাল করতেন। এই দলে ছিলেন সৌরভের অন্যতম সহযোগী রবি উপ্পল। তাকেও হন্যে হয়ে খুঁজছে ইডি। জানা গিয়েছে, করোনার পর থেকে এই ব্যবসার রমরমা শুরু হলে লাইফস্টাইল পাল্টে যায় অভিযুক্তদের। বছরখানেক আগে এই অ্যাপে প্রতারিত হয়ে এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে পুলিশ মহাদেব অ্যাপের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। এরপরেই রাজের থেকে বেটিং অ্যাপের ব্যবসার কন্ট্রোল নিয়ে নেন সৌরভ।

ইডির র‌্যাডারে পড়েন এই চক্রের দুই পান্ডা সৌরভ চন্দ্রাকার ও রবি উপ্পাল। রবিও ছত্তীসগঢ়ের বাসিন্দা। প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে, প্রথমে ছোট কোনও বেসরকারি সংস্থাতে কাজ করতেন। পরে এই ‘অনলাইন বেটিং’ চক্রের ফাঁদ পাতেন। পরে তারা চলে যান দুবাই। সৌদি আরবে ছিল ‘মহাদেব বেটিং অ্যাপ’ সংস্থার সদর অফিস। সেখান থেকেই ভারতের মেট্রো শহরগুলিতে বেটিং চক্রের শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সৌরভ। ব্যবসার বেশিরভাগ টাকা হাওয়ালার মাধ্যমে বিদেশে যেত।

অনলাইনে বিভিন্ন খেলায় বেটিং-এর নামে অ্যাপটি চালু করা হলেও, এর আসল উদ্দেশ্য ছিল মানি লন্ডারিং। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে যারা বিদেশে টাকা ট্রান্সফার করতে চাইতেন, তারা ওই অ্যাপের কর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। ইডি সূত্রের খবর, বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বেশ কয়েকটি বস্তি এলাকার যুবকদের খোঁজ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তা থেকে জানা গিয়েছে, ওই যুবকদের অ্যাকাউন্ট এবং ইউপিআই আইডি-র মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে টাকা ইতিমধ্যেই বিদেশে পাচার করা হয়ে গেছে। বস্তি এলাকার অভাবী যুবকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে সেখান থেকে টাকা পাচার করা হত যাতে সন্দেহ না হয়। কিন্তু মহাদেব বেটিং অ্যাপ নিয়ে তদন্ত করতে করতে একেবারে গভীরে পৌঁছে যান ইডির অফিসাররা। তখনই সামনে আসে সবটা।

একাধিক রাজ্যে এই মহাদেব বেটিং অনলাইন চক্রের তদন্ত চালাচ্ছে ইডি। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে উদ্ধার হয়েছে ৪১৭ কোটি টাকা। ইডি এখনও অবধি যে তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে তাতে জানা গেছে, ১১২ কোটি টাকা হাওয়ালার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়েছে। একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে সেই টাকা দেওয়া হয়েছে। ৪২ কোটি টাকার হোটেল বুকিং হয়েছে সেই হাওয়ালার টাকা দিয়ে। ১৪ জন বলিউড তারকার নাম জড়িয়েছে এই বেটিং অ্যাপ চক্রে। ইডি-আধিকারিকরা দাবি করছেন, এই বেটিং অ্যাপ, তার সংস্থার প্রচারের জন্য একটি বিশাল অঙ্কের টাকা বিজ্ঞাপনের পিছনে খরচ করত। তারকাদের দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতেন, যাতে গ্রাহক আকৃষ্ট হন। ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়ার জন্য আরও লোক বিনিয়োগ করেন সৌরভ। কলকাতায় এই ব্যবসা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন বিকাশ ছাপাড়িয়া নামে এক ব্যক্তির ওপর। তাকেও খুঁজছেন গোয়েন্দা অফিসাররা।