প্রশাসনিক আদেশেই খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়া সম্ভব: ভয়েস অফ আমেরিকাকে মির্জা ফখরুল

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেয়া প্রসঙ্গে বিএনপি‘র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, "সরকার ইচ্ছা করলে প্রশাসনিক আদেশেই খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।"

তিনি বলেন, "সরকার যে আদেশে বেগম খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করেছেন। সেখানে দুইটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে। তার একটি শর্ত হলো বিদেশে যাওয়া যাবে না। এই শর্তটি তুলে দিলেই খালেদা জিয়া বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করে আবার দেশে আসতে পারবেন। শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বিএনপি‘র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা প্রসঙ্গে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হলে তাকে আগে আদালতে আত্নসমর্পন করে জেলে যেতে হবে। এর বাইরে আইনগত কোন সুযোগ আছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি‘র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর এই কথাটি সঠিক নয়। কারণ যে আদেশে সরকার বেগম খালেদা জিয়ার সাজা মাপ না করে স্থগিত করেছেন। সেখানে দুইটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে। তার একটি শর্ত হলো বিদেশে যাওয়া যাবে না। এই শর্তটি তুলে দিলেই খালেদা জিয়া বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করে আবার দেশে আসতে পারবেন।"

মির্জা ফখরুল বলেন, "সরকার মূলত একটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটা মামলা তৈরি করেছেন। তৈরি করা এই মামলায় সাজাটাও দিয়েছেন ফরমায়েশী সাজা। পাঁচ বছরের সাজাকে দশ বছর করা হয়েছে। তারপর থেকে তাকে কারাগারে নেয়া হয়েছে। এখন তো তিনি অসুস্থ, এতো অসুস্থ যে পরিবার থেকে বেগম জিয়াকে বিদেশে নেয়ার জন্য বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকার যদি তাকে চিকিৎসা নেয়ার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগে তাকে আবার কারাগারে নেয়ার কথা বলে তাহলে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে, যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এটা তাদের সদিচ্চার ওপর নির্ভর করে। সরকার ইচ্ছা করলে প্রশাসনিক আদেশেই খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।"

ভয়েস অফ আমেরিকা সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নততর চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, "তবে হ্যাঁ, যেটুকু করতে পেরেছি তার জন্য সেটা হচ্ছে, আমার যেটুকু সরকার হিসেবে ক্ষমতা আছে, সেটা আমি তার সাজাটা স্থগিত করে তাকে বাড়িতে থাকার পারমিশন এবং তার চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে নিজেই চিকিৎসা নিচ্ছে এখন। বাংলাদেশের সব থেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর যদি তাদের যেতে হয় বাইরে, এই এখন যে তাকে আমি বাসায় থাকার পারমিশনটা দিয়েছি; এটা আমাকে উইথড্র করতে হবে। তাকে আবার জেলে যেতে হবে এবং কোর্টে যেতে হবে। কোর্টের কাছে আবেদন করতে হবে। কোর্ট যদি রায় দেয়, তখন যেতে পারবে। এটা হলো বাস্তবতা।"

ওদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার বিষয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে বলে শনিবার জানিয়েছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন।

আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, “খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে ছিলেন। তার স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তার সাজা স্থগিত করে বাড়িতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।” তার সম্ভাব্য সর্বোত্তম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “খালেদা জিয়ার ভাই তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করলেও কিছু আইনি জটিলতা রয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা আবেদনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এর পরে, আমরা যদি কিছু করতে চাই; তবে আমাদের আইন অনুসরণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।”

বিএনপি‘র নেতাদের মামলা প্রসঙ্গে

ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মামলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করেন, সন্ত্রাসী বোমাবাজী আগুন পুড়িয়ে মানুষ হত্যার কারণে বিএনপি'র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ বিষয় জানতে চাইলে বিএনপি‘র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভয়েস অফ আমেরিকাকে গত প্রায় ১৫ বছর আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিরোধী দলকে রাজনীতি থেকে সরানোর জন্য বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করেছেন বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, "তার মধ্যে একটি হচ্ছে মিথ্যা মামলা দেয়া, গায়েবী মামলা দেয়া এবং মামলাগুলোতে প্রথমে বিএনপি‘র নেতাকর্মীদের কিছু নাম দিয়ে দেয়া। সে সঙ্গে অজ্ঞাতনামা জুড়ে দেয়া। এইভাবে তারা একটা সুযোগ নিয়ে ১৪০০/১৫০০ লোককে একসাথে একটি মামলায় আসামী করে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে বিএনপি‘র নেতাকর্মীদের নামে মামলার সংখ্যা দাড়িয়েছে দেড় লাখের ওপরে। এসব মামলায় অভিযুক্ত আসামীর সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, যারা নির্বাচন করে, গণতন্ত্র চর্চা করে, তাদের ৪৫ লাখ লোকের বিরুদ্ধে যদি মিথ্যা মামলা থাকে, গায়েবী মামলা থাকে। তাহলে ওই মামলার জন্য তো নিযমিত কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। তাহলে রাজনীতির কি অবস্থা হয়েছে, রাজনীতি কোন জায়গায় গিয়ে পৌছেঁছে সেটা বুঝতেই পারেন।"

বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, "মামলা দেয়ার সময় যে সমস্ত কথাগুলো ওরা বলছে, আসলে এই সব ঘটনাতো সরকারই ঘটিয়েছে। তারা দলীয় লোকজন এবং বিভিন্ন এজেন্সীর লোকজন দিয়ে ঘটনা ঘটিয়ে এসব মামলা দিয়েছেন। আবার কতগুলো জায়গায়, এই ধরনের কোন ঘটনাও ঘটেনি, তারপরেও তারা মামলা তৈরি করে দিয়েছে। সুতরাং এইসব কথা বলে লাভ নেই। গত ১৫ বছর ধরে এই অনির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ধবংস করার জন্য যত রকমের অপকৌশল আছে, তারা সেই অপকৌশল নিচ্ছে। ফলে আজকে লাখ লাখ মানুষ সাফার করছে। তাদেরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। প্রধানমন্ত্রী যেভাবেই বলুক এই দেশের মানুষ কেন সারা পৃথিবীর মানুষ তা মেনে নিচ্ছে না।"

সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, বিএনপি‘র সিনিয়র নেতাদের মামলাগুলোকে রাজনৈতিকভাবে নয় বরং আইনগতভাবেই পরিচালনা করা হচ্ছে, আদালত স্বাধীনভাবে বিচার কাজ পরিচালনা করছে। কিন্তু বিএনপির মহাসচিবের অভিযোগ, "সরকার এখন বিএনপির সিনিয়র নেতাদের তালিকা তৈরি করেছেন। আইন মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা তৈরি করে বিচারকদেরকে চাপ দিচ্ছেন যে, অতি দ্রুত এই মামলাগুলোকে নিস্পত্তি করার জন্য। এই মামলাগুলোতে যারা অভিযুক্ত আছেন, তাদেরকে সাজা দেয়ার জন্য। ইতিমধ্যে আদালত সাজা দেয়া শুরু করেছে, আমাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সিনিয়র নেতা আমান উল্লাহ আমান, তার স্ত্রী, বিএনপি‘র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে সাজা দেয়া হয়েছে। আমাদের বিএনপি নেতা সাতক্ষীরা হাবিবুর রহমানকে ১৪ বছর সাজা দিয়েছে, ইশ্বরদীতে আমাদের নয়জন কে নেতাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন। এভাবে সাজা দিয়ে নির্বাচনের আগে আমাদের ভালো প্রার্থী যারা তাদেরকে নির্বাচন থেকে আইনগতভাবে দৃরে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।"

বিএনপি‘র নেতাকর্মীদের গুম প্রসঙ্গে

বাংলাদেশে গুম প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারে দেয়া বক্তব্যের দৃষ্টি আর্কষণ করলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "এখানে গুম হয়েছে, গুম হওয়ার প্রমাণ আছে এবং সরকারও অনেক ক্ষেত্রে বলতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদকে গুম করে ভারতে জেলে দেয়া হয়েছে। এখনও তিনি সেখানে আছেন। আমাদের ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে, এটা কি প্রধানমন্ত্রী অস্বীকার করতে পারবেন, যে ইলিয়াস আলী গুম হয়নি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তদন্তে গুম হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।"

গুম হওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে জাতিসংঘ কেন তদন্ত করছে না প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের জবাবে বিএনপি‘র মহাসচিব ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমরা নিজেরা তদন্ত করেছি, তদন্ত করেই বলেছি। উনারা কেন তদন্ত করছেন না। সরকারের দায়িত্ব গুমের তদন্ত করা। উনারা কি জন্য সরকারে আছেন। উনারা কেন তদন্ত করে কোন কিছু করছেন না। আমরা তো বারবার বলছি গুম হয়েছে।"

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, "র‌্যাব একটা বাহিনী। তাদেরকে মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের অফিসারদেরকেও স্যাংশন দিয়েছে। র‌্যাব যে গুম, গণহত্যা, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড সচরাচর যেগুলো করেছে তার সব কিছুই সামনে চলে এসেছে। সুতরাং ওইসব কথা বলে লাভ নেই। তারা একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা এই সব কাজগুলো করছে। সরকার বিরোধীদলবিহীন একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়।"

(এই প্রতিবেদনের অংশবিশেষ ইউএনবি থেকে নেয়া হয়েছে।)